অক্সিজেনের গল্প (শেষ পর্ব)

ডাঃ মোঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার, এনেসথেশিয়া ও ইনটেন্সিভ কেয়ার কনসালট্যান্ট ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড: এই লেখার শুরুতে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, মনে আছে? বাতাসে অতিরিক্ত অক্সিজেন থাকলে কি হত? কিংবা যদি জিজ্ঞেস করি, একজন মানুষকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অক্সিজেন দিলে কি হবে? বলছি। প্রথমতঃ আমাদের জানা প্রয়োজন যে, অক্সিজেন নিজে জলেনা কিন্তু অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে অর্থাৎ কোনভাবে যদি উচ্চচাপে সংরক্ষিত অক্সিজেন আগুণের সংস্পর্শে আসতে পারে তাহলে এই সিলিন্ডার কিংবা সংরক্ষণ ব্যাবস্থাগুলো আগুণের বোমা হয়ে উঠতে পারে। জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে এধরনের দুর্ঘটনা এখনো অহরহ ঘটছে। দ্বিতীয়তঃ আমরা বাতাস থেকে যখন নিঃশ্বাস গ্রহণ করি তখন যে অক্সিজেন আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে তার সঙ্গে বেশ কিছুটা জলীয় বাষ্প মিশে যায়। যদি তেমনটা না হত, যদি শুষ্ক অক্সিজেন শ্বাস নালীতে প্রবেশ করত, তাহলে সেটা শ্বাসনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করত। একসময় এই প্রদাহ বেড়ে গিয়ে শ্বাস নালীতে মারাত্নক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারত। এর জন্যেই স্রষ্টা বাতাসে বাষ্প মিশ্রিত করেই রেখেছেন। যতগুলো অক্সিজেন থেরাপি ডিভাইসের কথা বললাম, তার মধ্যে হাই ফ্লো নেজাল কেনুলা ছাড়া আর কোন যন্ত্র জলীয় বাষ্প মিশ্রণ করে অক্সিজেন দিতে পারেনা। যার ফলে সকল অক্সিজেন শুষ্ক অবস্থায় শরীরে প্রবেশ করে। আর এই শুষ্ক অক্সিজেন যত বেশী সময় ধরে দেয়া হবে তত বেশী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

2017 - Keele University

তৃতীয়তঃ শুকনো অক্সিজেন কম মাত্রায় দিলে সমস্যা ত আছেই, এমনকি বাষ্পযুক্ত অক্সিজেন ৬০% এর অধিক মাত্রায় যদি বেশী সময় ধরে কাউকে দেয়া হয় তাহলে শ্বাস নালীর প্রদাহ থেকে শুরু করে ফুসফুসের প্রদাহ, নিউমোনিয়া এমনকি একিউট রেসপাইরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোম (এ আর ডি এস) নামক মারাত্নক জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে এই জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন নিজেই জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এবার আসি এই সময়ের ভয়ংকর ত্রাস, কোভিড-১৯ সম্পর্কে। পত্র পত্রিকা মারফত কিংবা মানুষের মুখে মুখে শুনে হোক, কমবেশি আমরা সবাই জেনে গেছি, এই রোগে আক্রান্ত হলে, রুগীর যে নিউমোনিয়া হয়, তখন রোগীকে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন দিতে হয়। আর উপরের আলোচনা থেকে আমরা এটাও বুঝে গেলাম, অতিরিক্ত অক্সিজেন সেই একই রোগকে বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। শুধু তা ই না, এই অক্সিজেন দীর্ঘ সময় ধরে দেয়া হলে মানুষের স্নায়ুর উপর আক্রমণ করে মানুষকে উত্তেজিত, বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে, খিচুনিও দেখা দিতে পারে। ধীরে ধীরে অবসাদ দেখা দেয়, চেতনা হারিয়ে ফেলে, কোমা এমনকি মৃত্যুও সংঘঠিত করতে পারে। এছাড়াও এই অক্সিজেন কিডনি, লিভার এবং শরীরের অন্যান্য প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কোষ সমূহকে ধ্বংস করে দিয়ে অকার্য্যকর করে দিতে পারে। �তাই, অত্যবশ্যক না হলে কোন অবস্থায়ই অতিরিক্ত অক্সিজেন ব্যাবহার করা উচিৎ নয়। যদি অতিরিক্ত অক্সিজেন দেয়ার প্রয়োজন হয়েই পড়ে তাহলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সার্বক্ষনিক মনিটারিং করে, যত কম মাত্রায় সম্ভব অক্সিজেন দেয়া প্রয়োজন শুধু ততটুকুই দেয়া উত্তম এবং সেই অবস্থায় পরিমিত মাত্রায় অক্সিজেন অক্সিজেন প্রদান করা নিশ্চিত করা জরুরী। যদি খুব বেশী মাত্রায় অর্থাৎ ৬০% এর অতিরিক্ত অক্সিজেন অধিক সময় দেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে তাহলে বিশেষায়িত পদ্ধতি অর্থাৎ বাষ্প যুক্ত হাই ফ্লো নেজাল কেনুলার সাহায্য নেয়া অত্যাবশ্যক। অন্যথায় অতি বিশেষায়িত পদ্ধতি সিপেপ/বাইপেপ কিংবা ভেন্টিলেশনের কথা ভাবতে হবে। পরিশেষে বলব, পালস অক্সিমিটারে অক্সিজেনের পরিমাণ ৯০% এর উপরে রাখার প্রয়োজনে যত কম অক্সিজেন দিয়ে রাখা যায় ততই উত্তম। যত বেশী মাত্রায় অক্সিজেন দেয়া হবে অক্সিজেনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি ততই বাড়তে থাকবে। কোনভাবেই অক্সিজেন থেরাপি ডিভাইস দিয়ে ৬০% এর অতিরিক্ত শুষ্ক অক্সিজেন দীর্ঘক্ষন দিয়ে রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। যদি এরকম প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তাহলে জলীয়বাষ্প যুক্ত যন্ত্রের সাহায্য নেয়া আবশ্যিক। অন্যদিকে কোনভাবেই পালস অক্সিমিটারে ৯০% এর কম সেচুরেশনও গ্রহণযোগ্য নয়।�এখন ভেবে দেখুন স্রষ্টা বাতাসে আমাদের জন্য বাষ্পযুক্ত অক্সিজেন শুধুমাত্র ২১% দিয়েছেন এর কম হলে যেভাবে জীবন ধারণ সম্ভব নয় এর অতিরিক্তও জীবনের জন শুভ নয়, যত বেশী অতিরিক্ত অক্সিজেন ব্যাবহার করা হবে জীবনের ঝুঁকি ততই বেড়ে যাবে। চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে প্রয়োজনে পরিমিত অক্সিজেন গ্রহণ করাই আমাদের জন্য নিরাপদ। শেষ

SHARE THIS ARTICLE