অনন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পঃ আমেরিকানিজম বনাম ট্রাম্পিজম


ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ আমাদের ধারনায়, পূর্বতন অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিচক্ষণতার সাথে তাদের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতিতে, আদর্শ এবং বাস্তবের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন, ব্যাতিক্রম হচ্ছেন রিপাবলিকান দল থেকে মনোনয়নে বিজয়ী হওয়া ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার আগের অধিকাংশ নেতারা দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতি, অসাম্য, বর্নবাদ আর দুরাচারকে লুকিয়ে রেখে নিয়ন্ত্রণের ব্যার্থ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, তাদের আচার আচরনে। সম্ভবতঃ ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছেন প্রথম এবং অনন্য একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি আদর্শ, বাস্তব, সাম্য, আচার কিংবা কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার এসবের কোনই তোয়াক্কা করেন নি। তিনি যা চেয়েছেন তা করতে কিংবা যা বলতে চেয়েছেন তা প্রকাশ করতে কোন ভদ্রতা কিংবা শিষ্টাচারের কাছাকাছিও যান নি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন থেকে বারাক ওবামা পর্য্যন্ত সকল প্রেসিডেন্ট “আমেরিকানিজম” নীতিকে ধারণ করেই তাদের কার্য্যক্রম পরিচালনা করেছেন। আপনাদের মনে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, এই “আমেরিকানিজম” কি আর এই “ট্রাম্পিজম” ই  বা কি?

আমেরিকানিজম হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সম্মিলিত দেশপ্রেমিক মূল্যবোধ। আমেরিকার পতাকা, ঐতিহ্য, রীতিনীতি, সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারের প্রতি এক অনন্য অনুরাগ, আনুগত্য এবং বিশ্বস্ততার নামই হচ্ছে আমেরিকানিজম। থিওডোর রুজভেল্টের ভাষায়, “আমেরিকানিজম একটি মনোভাব, আত্নপ্রত্যয় এবং অভিপ্রায় এখানে কোন ধর্ম কিংবা জন্মস্থানের প্রশ্ন আসেনা।” 

আমেরিকানিজম দুটি ধারনার উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথমটি হচ্ছে আমেরিকানদের একটি অনন্য ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ধারা আছে যার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত তাদের গণতন্ত্র, ব্যাক্তি স্বাধীনতা, সমঅধিকার, আইনের শাসন এবং অর্থনীতি, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে অনন্য। আর দ্বিতীয়টি, যুক্তরাষ্ট্রের অনন্য দায়িত্ব হচ্ছে বহির্বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে তাদের এই অনন্য মতবাদ রপ্তানি করে বৈশ্বিক রূপান্তর ঘটানো। 

আমেরিকানিজমের অনন্য বৈশিষ্ট হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এবং বিশ্ব দরবারে তাদের নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রভাব রক্ষায় এতই বদ্ধপরিকর যে, প্রয়োজনে নিজ দেশের সুরক্ষায় তারা যে কোন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেও দ্বীধা করেনা। উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমার ব্যাবহার, গন বিধ্বংসী অস্ত্র মুক্ত করনের মিথ্যা অজুহাতে ২০১৩ সালে ইরাক দখল অন্যতম। 

এছাড়াও সফল আমেরিকার প্রশাসন, বিশ্বজুড়ে উদার মূল্যবোধের নিঃস্বার্থ প্রবক্তা হিসাবে আমেরিকার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বাড়াতে দক্ষতার সাথে উভয় নীতিকে প্রয়োগ করেছে  এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে তাদের সাথে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রক্ষা করেছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমেরিকানিজমের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনন্য ব্যাতিক্রমী একজন প্রেসিডেন্ট। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে আইনের শাসন ভিত্তিহীন, গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল, বাক স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে বর্নবাদ কতটা তীব্র। সমগ্র শাসনকাল জুড়ে তিনি এমন কাণ্ড কারখানা করেছেন যে, বহির্বিশ্বে আমেরিকার ভাবমূর্তি আজ শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখা বিভক্তি আর দ্বন্দ্বকে দিনের আলোর মত প্রস্ফুটিত করে দিয়েছেন, এই অনন্য গণতান্ত্রিক দেশের অনন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

আমরা মনে করি, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছেন, তিনি আমেরিকান সংস্কৃতির, অতীত, বর্তমান এবং সম্ভবত ভবিষ্যতের কুৎসিত প্রায় সব কিছুকেই আলিঙ্গন করেছেন, প্রকাশিত করে দিয়েছেন কিংবা উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন। যাদের শুধুই ইতিবাচক দিক দেখার প্রবনতা তাদের চোখেও আঙ্গুল ঢুকে দেখিয়ে দিয়েছেন, দিবালোকের মত স্পষ্ট এবং বোধগম্য করে দিয়েছেন। এই সপ্তাহের নির্বাচন আমাদেরকে কি দেখিয়েছে, এটা ট্রাম্পবাদকে প্রত্যাখ্যান করার শুভ সংবাদ মোটেও নয় বরং গতবারের চেয়ে আরও প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের এই মতবাদের সাথে সংযুক্তি, নূতন করে ৪০ লক্ষ মানুষের চিন্তা জগতে প্রবেশ করেছে ট্রাম্প মতবাদ, এটাই আজকের বাস্তবতা। এটা ব্যাক্তির বিষয় নয় আমেরিকার ৭ কোটিরও অধিক নাগরিক তার এই মানসিকতাকে সমর্থন দিয়ে এটাকে মতবাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন, স্থান দিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।

তিনি আমেরিকার অনন্য মতবাদকে কদর্য্যতা দিয়েছেন-যার মধ্যে রয়েছে বর্ণবাদ, ব্যতিক্রমবাদ, বেপরোয়াত্ব, অহংকার এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পথে ধমক দেওয়ার প্রবণতা- এরই নাম আমেরিকানবাদের ঘাড়ে চেপে বসা ট্রাম্পবাদ। ট্রাম্পবাদ এখন ডিকশনারির পাতায় লিপিবদ্ধ, যদিও বর্নবাদ কিংবা সাদাদের আধিপত্য আরও সুসম, সৌন্দর্যমন্ডিত শব্দ হতে পারত, তবুও ট্রাম্পবাদ সহজে কার্য্যকর বিকল্প শব্দ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এখানে একটি বিস্তৃত শ্রেণীর মানুষ যুক্ত হয়েছেন, শুধুমাত্র যারা বর্নবাদী তারাই নন, এদের মধ্যে কিছু আছেন তাদের সুবিধার জন্য, কিছু আছেন যারা সমস্যাটিকে তুচ্ছ করে দেখতে ভালোবাসেন তারাও যুক্ত হয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, অনুধাবনের সময়, কত দ্রুত সারা আমেরিকান জাতি এই রোগ নিরাময়ে তৎপর হয়ে এগিয়ে আসেন। আমরা জানি সাদা আধিপত্যবাদিরা এই সমস্যাটিকে আবারো খাটো করে দেখার কিংবা অসাড় প্রমাণ করার উদ্যোগ নেবেন, তবুও আমাদের দেখতে হবে ট্রাম্পিজম কতদূর প্রসারিত হয়।  

বিশ্ববাসী দেখেছে, ট্রাম্পিজম কিভাবে নাগরিক জীবনকে মূল্যায়ন করেছে, কিভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক স্তম্ভ আর প্রশাসনকে লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেলেছে এই মতবাদ। কোভিড-১৯ মহামারিকে তুচ্ছ হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে কিভাবে আড়াই লক্ষ মানুষের জীবনকে হেলায় হারিয়ে যেতে দিয়েছে, কিভাবে আমেরিকার মত দেশে এক কোটি মানুষকে কোভিডে সংক্রমিত হতে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।

আর এই কদর্য্য মতবাদ, সর্বশেষ কুঠার হাতে নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে অবলীলায়, আমেরিকার ঐতিহ্য আর গৌরবের লালিত নির্বাচনী ব্যাবস্থাকে অসাঢ় প্রমাণের লক্ষ্যে বিচার ব্যাবস্থা আর নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানকে আজ দাড় করিয়ে দিয়েছে প্রত্যক্ষ সমরে। খোলা চোখে বিশ্ববাসী দেখছে, কিন্তু আদৌ কি অনুভব করতে পারছে কদর্য্য এই মতবাদ কিভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে শক্তি আর সম্মান নিয়ে যারা কয়েক যুগ ধরে রাজত্ব করছে তাদের নিজস্ব আংগন কত বিভক্ত, কত অসুন্দর আর কত ভঙ্গুর।। 

SHARE THIS ARTICLE