ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার – এনেসথেশিয়া ও ইনটেন্সিভ কেয়ার কনসালট্যান্ট ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড:
আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার কিছু দিক নিয়ে আলোচনাঃ
বাংলাদেশে যেমন “পাবলিক” অর্থাৎ সার্বজনীন সরকারী স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা আছে এবং একই সাথে “প্রাইভেট” অর্থাৎ বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা আছে, এদেশেও পাবলিক এবং প্রাইভেট চিকিৎসা ব্যাবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলাদেশে পাবলিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা সকল জনগণের জন্য স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত করতে এখনো সক্ষম হয়নি। সেই বিবেচনায় এই দেশের পাবলিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত করেছে। এই যে স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত তার অনেকটাই কিন্তু আমাদের সকলের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ আমরা উপার্জনের যে ট্যাক্স প্রদান করি সেই ট্যাক্সের অর্থ দিয়ে দেশের জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া “প্রাইভেট” ব্যাবস্থা যারা বিত্তশালী তারা স্বাস্থ্য ইনশিওরেন্সের মাধ্যমে কিংবা নিজের পকেট থেকে ব্যয় করে গ্রহণ করতে পারেন।
আয়ারল্যান্ডের বৈধ সকল রেসিডেন্ট (নাগরিক কিংবা অনাগরিক) পাবলিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় সেবা অর্জনের পূর্ন অধিকার ভোগ করেন। ৬ বছর বয়স পর্য্যন্ত শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা আর মায়েদের মেটার্নিটি সেবা এই দেশে সম্পূর্ন ফ্রি।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কেউ যদি সরাসরি চিকিৎসা নিতে আসেন তাহলে তাকে ১০০ ইউরো ফি দিতে হয় তবে যদি তারা জেনারেল ফিজিশিয়ান অর্থাৎ জি পি কে আগে দেখিয়ে তার রেফারেল নিয়ে আসেন তাহলে তিনি ফ্রি চিকিৎসা পাবেন।
মেডিকেল কার্ডঃ
কারা মেডিকেল কার্ড পাবেন?যারা রাষ্ট্র থেকে কল্যাণ ভাতা পান, যাদের উপার্জন প্রয়োজনের তুলনায় কম, বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত ব্যাক্তি এবং আরও কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে মেডিকেল কার্ড প্রদান করা হয়। এছাড়াও যারা থেলিডোমাইড সিন্ড্রোম, সিম্ফাইজোটোমি কিংবা যেসকল শিশুরা ক্যান্সারে আক্রান্ত তারাও মেডিকেল কার্ড পাবেন।
মেডিকেল কার্ডের সুবিধা কি?
যাদের মেডিকেল কার্ড আছে তারা সম্পুর্ন বিনা পয়সায় হাসপাতাল চিকিৎসা, জি পি চিকিৎসা, দাঁতের, চোখের ও কানের চিকিৎসা, প্রেসক্রিপশন ঔষধ (প্রেসক্রিপশন ঔষধের জন্য স্বল্প কিছু দেয়া লাগতে পারে) ও যন্ত্রপাতি বিনে পয়সায় পাবেন। বর্তমানে এই দেশের ৩১.৯% মানুষের মেডিকেল কার্ড আছে।
জি পি কার্ডঃ
এছাড়াও কিছু রেসিডেন্ট যাদের উপার্জন একটু বেশী কিন্তু খুব বেশী না তারা জি পি কার্ড পাবেন। শুধুমাত্র জি পি কে দেখানোর জন্য তাদের কোন ফি দিতে হবেনা। ৭০ বছর বয়সের উপরে বয়সে যারা মেডিকেল কার্ড কিংবা জি পি কার্ড পাবেন না তারা বছরে ৪০০ ইউরো নগদ পাবেন।
সকলের জন্য প্রযোজ্যঃ
যারা মেডিকেল কার্ড পাবার অধিকারী নন এমন লোকদের অর্থাৎ জনসংখ্যার ৬৮.১% লোকদের অবশ্যই কিছু স্বাস্থ্যসেবা ফি দিতে হবে। যারা জি পি রেফারেল ছাড়া ইমার্জেন্সিতে আসবেন তাদেরকে ১০০ ইউরো ফি দিতে হবে।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য প্রতিদিনের ফি ৮০ ইউরো করে দিতে হবে তবে পুরো বছরে যদি তাকে কোন কারণে বেশিদিন হাসপাতালে থাকতে হয় যার জন্য তার ফি সর্বমোট ৮০০ ইউরোর বেশী হয় তাহলে তাকে ৮০০ ইউরোর উপরে আর কোন ফি দিতে হবেনা। এই ৮০ ইউরো ফি প্রদানের মাধ্যমে হাসপাতালের সকল পরিষেবা অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন এবং ডায়াগনস্টিক মূল্যায়ন (যেমন এক্স-রে, ল্যাবরেটরি পরীক্ষা, ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি) সকল কিছুই অন্তর্গত থাকে। যদি কোনও ব্যক্তি হাসপাতালের ফি দিতে না পারেন তাহলে এইচ এস ই বিনা মূল্যে এই পরিষেবা প্রদান করবে।
ড্রাগ পেমেন্ট স্কিম কি?
ড্রাগ পেমেন্ট স্কিমের আওতায় জি পি কর্তৃক অনুমোদিত প্রেসক্রিপশনকৃত ঔষধ এবং কিছু সরঞ্জামের জন্য সকল রেসিডেন্ট ভর্তুকি পাবেন। এই ভর্তুকির আওতায় কোন মাসে যদি কোন পরিবার কর্তৃক ১২৪ ইউরোর উর্ধে ব্যয়ের প্রয়োজন হয় তাহলে ১২৪ ইউরোর উর্ধে সকল ব্যয় সরকার ভর্তুকি দেবে। এখানে শর্ত হলো অবশ্যই তাদের সেই কার্ড সরকার থেকে নিয়ে রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সকল রেসিডেন্ট এই কার্ড পাবার অধিকারী।
ইউরোপিয়ান হেলথ ইনশিওরেন্স কার্ডঃ
দেশে বসবাসকারী প্রত্যেকে এবং আয়ারল্যান্ডে আগত দর্শনার্থীরা যারা ইউরোপীয় স্বাস্থ্য বীমা কার্ড রাখেন, তারা জনস্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা ব্যবহারের অধিকারী। শুধুমাত্র ব্রিটিশ নাগরিকদের এই কার্ড লাগবেনা, এন এইচ এস এর কার্ড থাকলেই তারা এই সুবিধা পাবেন। আয়ারল্যান্ডের নাগরিক যারা ইউরোপিয়ান হেলথ ইনশিওরেন্স কার্ড করেছেন তারা ইউরোপের যে কোন দেশের পাবলিক স্বাস্থ্য পরিসেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন।
কিছু সমস্যাঃ
আয়ারল্যান্ডের স্বাস্থ্যসেবার প্রধান সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘ ওয়েটিং লিস্ট। এই দেশে জরুরী চিকিৎসা সকলকেই দ্রুত প্রদান করা সম্ভব কিন্তু যে সকল চিকিৎসা জরুরী নয় তাদেরকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। এটা হচ্ছে এই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। কোন কোন ক্ষেত্রে এই দীর্ঘ সূত্রিতা ৬ থেকে ৯ মাস এমনকি ১২ মাসও হতে পারে। এই দীর্ঘ সূত্রিতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট পার্চেজ ফান্ড (এন টি পি এফ) এর আওতায় প্রাইভেট সেক্টরকে ব্যাবহার করে কিছু চিকিৎসা করার ব্যাবস্থা সরকার গ্রহণ করেছে। তারপরও এই অপেক্ষার লাইন এখনও অনেক দীর্ঘ। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এই দীর্ঘসূত্রিতা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
তবে আমরা যদি বুঝি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের সমস্যা সাধারণ, যা জি পিরাই সমাধান করতে পারেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা জি পিদের মাধ্যমেই করা সম্ভব। যখন জি পি রা সমাধান করতে পারেনা শুধুমাত্র তখনি তারা বিশেষজ্ঞের নিকট রেফার করার কথা। কিছু ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা জি পিদের উপর নির্ভর করতে পারিনা। আমরা চাই বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে, কিন্তু এদেশের জি পি প্রত্যেকেই একজন বিশেষজ্ঞ হওয়ার কথা। তাই তাদের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করা যায়।
স্বাস্থ্য বিভাগের এই সমস্যা নিয়ে সমাজে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো এব্যাপারে কথা বলছে। আমাদের উচিত স্বাস্থ্য সেবা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া। আমাদের নিজেদের দুজন নির্বাচিত কাউন্সিলর আছেন, আমরা বিভিন্ন সময় তাদের সহায়তা কামনা করতে পারি আর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্য থেকে আরও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে নূতন নেতৃত্ব তৈরি করতে যেন আমরা পিছপা না হই। সামাজিক ঐক্য এক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক।
আমাদের সমস্যাঃ
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা আমাদের অধিকার কি জানিনা। এই দেশে অধিকার অর্জনের জন্য কথা বলতে হয়। ভিন্ন ভাষায় কথা বলার জড়তা এখনো আমরা অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বারে বারে টেলিফোন করে কথা বললে অনুরোধ করলে কিংবা উষ্মা প্রকাশ করলে দ্রুত এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া সম্ভব হয়। সাধারণতঃ নার্স কিংবা চিকিৎসকরা সহানুভূতিশীল কিন্তু আমাদের প্রকাশের জড়তা আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। এই ক্ষেত্রে আমরা ইংরেজি ভাষার জড়তা কাটিয়ে তোলার জন্য কিছু কাজ করতে আগ্রহী। বিশেষ করে আমাদের মা- বোনরা অনেকেই এখনো জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে আমরা জি পি দের কাছে গিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যা ওদের বোঝাতে পারিনা। এক্ষেত্রে এই সাপোর্ট গ্রুপ সহায়তা করতে পারে, যেমন এই গ্রুপে আলোচনা করে জেনে নিতে পারেন কিভাবে আপনার সমস্যা জি পি দের কাছে প্রকাশ করবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েকদিন আগে একজন টেলিফোন করেছিলেন আমাকে কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে। উনি আমাকে জানালে আমি জি পির কাছে যাবার উপদেশ দিলে তিনি জানতে চেয়েছিলেন ওখানে কি বলতে হবে? আমি বললাম আপনি বলবেন আমার “হার্ড স্টুল এন্ড ব্লিডিং ডিউরিং ডিফিকেশন” অর্থাৎ শক্ত পায়খানা এবং পায়খানার সাথে রক্ত আসে। আশা করি উনি উপকৃত হয়েছিলেন।
জি পিরা সাধারণতঃ খুব সহানুভূতিশীল হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রোগ নির্নয় করতে বেগ পেতে হয়। এসকল ক্ষেত্রে আমরা এই সাপোর্ট গ্রুপে আলোচনা করে সমাধান খোজার চেষ্টা করতে পারি। কি কি পরীক্ষা প্রয়োজন আলোচনা করে জি পিদের দ্বারস্থ হতে পারি।
আমাদের সমাজের বেশ কিছু সন্তান এ ডি এইচ ডি কিংবা অটিসম নামক রোগে আক্রান্ত। আমরা অনেকেই এব্যাপারে হীনমন্যতায় ভোগে থাকি। সমাজে এই রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারনা না থাকায় আমরা অনেকেই সামাজিক সমস্যায় থাকি। এই গ্রুপে এই ব্যাপারে আলোচনা করে নিজেদেরকে শক্তিশালী করতে পারি, সচেতনতা সৃষ্টি করে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। বিশেষ করে সমজাকে সচেতন করে তোলার জন্য এই গ্রুপ অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে।