এক দেশ-দুই ব্যাবস্থার মৃত্যুপূরীঃ হংকং

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ চীনের করা নূতন আইনের মাধ্যমে কড়াকড়ি আরোপের পর স্তিমিত হয়ে গেছে হংকং এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ার। যুক্তরাজ্য কর্তৃক চীনের নিকট হংকং হস্তান্তরের ২৩তম বার্ষিকীর মাত্র এক ঘণ্টা আগে ২০২০ সালের ৩০শে জুন রাত ১১ টায় হংকংয়ে চীনের আরোপিত নূতন জাতীয় সুরক্ষা আইন কার্য্যকর করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে, বিতর্কিত এই আইনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে, হংকংয়ের উপর বেজিংয়ের কঠোর মুষ্ঠি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং এক বছর আগে থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ার ও বিশাল বিক্ষোভ আজ স্তিমিত হয়ে এসেছে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে চলেছেন, কিন্তু বেইজিংয়ের সমর্থকরা এগুলিকে “দাঙ্গা” হিসাবে বর্ণনা করছেন এবং অশান্তি কাটাতে নূতন আইনটির প্রয়োজন বলে জোর দিচ্ছেন।আন্দোলনের নেতাকর্মীরা এখন কারাবাসের মুখোমুখি হচ্ছেন, গণতন্ত্রপন্থী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, এমনকি একজন বিশিষ্ট মেডিয়া মোগলকে আটকের পর অনেকেরই আশংকা যে “একটি দেশ, দুটি ব্যবস্থা”র যে নীতির ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্য হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তর করেছিলো সেই চুক্তিটি এখন মৃত এবং এই চুক্তির সমাধি হয়ে গেছে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে হংকং অন্যান্য চীনা শহর থেকে আলাদা।

এটি বোঝার জন্য, আমাদেরকে এর ইতিহাস দেখতে হবে। ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হংকং একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ১৮৪২ সালে যুদ্ধের পর হংকং দ্বীপ যুক্তরাজ্যের হস্তগত হয়, পরবর্তীতে হংকংয়ের বাকী অংশ- নতুন অঞ্চল – ব্রিটিশদের কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয় চীন। ব্রিটিশ ঔপনিবিশিকতার অন্তরে ধীরে ধীরে হংকং বাণিজ্য বন্দরে রূপান্তরিত হয়, ১৯৫০ এর দশকে হংকং উৎপাদনের কেন্দ্র হিসাবে পরিণত হয়। একই সাথে এই অঞ্চলটি মূল ভূখণ্ড চীনের অভ্যন্তর থেকে অস্থিতিশীলতা, দারিদ্র ও অত্যচার থেকে পালিয়ে আসা অভিবাসীদের জন্য অভয়ারন্য হয়ে উঠে। এদিকে ৯৯ বছরের ইজারার সময়সীমা এগিয়ে আসলে ব্রিটেন এবং চীন, হংকংয়ের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা শুরু করে ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে। চীনের কমিউনিস্ট সরকার, চুক্তির মেয়াদ শেষে পুরো হংকংকেই চীনা শাসনে ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানায়। ১৯৮৪ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, এই চুক্তি অনুসারে ১৯৯৭ সালে “একটি দেশ- দুটি ব্যবস্থা” এই নীতির অধীনে চীনে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ব্রিটেন রাজী হয়। একটি দেশ-দুটি ব্যাবস্থা নীতির আওতায় হংকং চীনের সাথে যুক্ত হলেও আগামী ৫০ বছর “বিদেশী এবং প্রতিরক্ষা” এই দুটি বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে অধিকতর স্বায়ত্ত্বশাসন উপভোগ করবে হংকং, এটাই ছিল চুক্তির মূল প্রতিপাদ্য। এই চুক্তির ফলস্বরূপ, হংকংয়ের নিজস্ব আইন এবং সীমানা রয়েছে, সমাবেশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সহ আর কিছু ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে।উদাহরণস্বরূপ, হংকং চীনা ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে এমন কয়েকটি জায়গার মধ্যে একটি যেখানের নাগরিকরা ১৯৮৯ তিয়ানানমেন স্কয়ার ক্র্যাকডাউনকে স্মরণ করতে পারে, যেখানে বেইজিংয়ে নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীদের উপর সামরিক বাহিনী গুলি চালিয়েছিল।কিন্তু হংকং এর স্বাধিকারের দিন শেষ হয়ে এসেছে, নূতন সুরক্ষা আইন করে চীন ২৩ বছরের মাথায় ৫০ বছরের চুক্তির উপর হাতল চালিয়েছে। দমন পীড়ন শুরু হয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে দেয়া হয়েছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করার জন্য বিশেষ বাহিনী নামিয়েছে। মাত্র ৬% যোগ্য ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হংকংয়ের নেতা, প্রধান নির্বাহী, বর্তমানে ১১০০ সদস্যের একটি নির্বাচন কমিটি দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন – যেখানে বেশিরভাগই বেজিংপন্থী। হংকং এর আইন প্রণয়নকারী সংস্থা, আইন পরিষদের ৭০ সদস্যের সবাই হংকংয়ের ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন না। সরাসরি নির্বাচিত নয় বেশিরভাগ আসন বেইজিংপন্থী আইন প্রণেতারা দখল করেছেন। বেইজিং একটি বিতর্কিত আইনী রায় জারি করে প্রত্যক্ষ নির্বাচিত সদস্যদের কার্যকরভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। হংকংয়ের ক্ষুদ্র সংবিধান, বেসিক আইন অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত নেতা এবং আইন পরিষদ উভয়কেই আরও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত করার কথা থাকলেও – এটা কিভাবে কার্য্যকরী করা হবে তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ২০১৪ সালে চীন সরকার বলেছিল যে তারা বেইজিংপন্থী কমিটির মাধ্যমে একটি অনুমোদিত তালিকা দেবে এবং সেই তালিকা থেকে ভোটারদের নেতা নির্বাচনের অনুমতি দেবে চীন সরকার। সমালোচকরা এটিকে ‘লজ্জা গণতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন এবং হংকংয়ের আইনসভায় ভোটে এটিকে বাতিল করে দেয়া হয়। আজ থেকে ২৮ বছরের মাথায়, মূল চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে- এর পরে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনের কী ঘটে তা আজ ভীষণ অস্পষ্ট।

মূলসূত্রঃ বি বি সি, সি এন এন, আলজাজিরা, পিপল পাওয়ার

SHARE THIS ARTICLE