রাকিব হাসান রাফি, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়াঃ কোভিড-১৯ নিঃসন্দেহে বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। কোনো ধরনের অস্ত্র নয়, নয় কোনো ধরনের পারমাণবিক যুদ্ধ, সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের এক ক্ষুদ্র আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ অসহায়। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। এ ছাড়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতি গোটা পৃথিবীকে এক বিশাল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে, যা আগামী দিনগুলো সবার জন্য হতে চলেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অবস্থার।
৩১ জানুয়ারি ইউরোপে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। ইতালির রাজধানী রোমে সর্বপ্রথম এক চীনা পর্যটকের শরীরে এ ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। দুই মাসের ব্যবধানে পুরো ইতালির চিত্র সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় গোটা ইতালি। প্রতিবেশী ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রিয়াসহ ধীরে ধীরে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে ইউরোপে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও গত জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আবারও করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হতে থাকে। অনেকে একে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস, মন্টেনেগ্রো, অস্ট্রিয়াসহ সব দেশ প্রথম ধাপে করোনা মোকাবিলায় যেখানে ছিল অনেকটা সফল, দ্বিতীয় ধাপে এসব দেশকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে।
ইউরোপে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশ শিক্ষার্থী। করোনা পরিস্থিতি বলতে গেলে তাঁদের গলায় ফাঁসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও যাঁরা বিভিন্ন স্কলারশিপ প্রোগ্রামের অধীনে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনা করছেন, তাঁরা তুলনামূলক স্বস্তিতে আছেন।
ইউরোপে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশ নিজের খরচে পড়াশোনা করেন। তাঁদের আমরা সেলফ ফাইনান্সিং স্টুডেন্ট বলে থাকি। তাঁদের অনেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করেন। মূলত নিজেদের থাকা-খাওয়ার খরচ মেটানোর জন্য তাঁরা অবসর সময়ে বিভিন্ন ধরনের পেশাভিত্তিক কাজের সন্ধান করেন। অনেকে আবার পার্টটাইম কাজের মাধ্যমে নিজেদের টিউশন ফি জোগাড়ের এক প্রচেষ্টা চালান। ইউরোপে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের বড় অংশ কাজের জন্য বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট কিংবা কফিশপ অথবা পানশালাকে বেছে নেন। কেননা, রেস্টুরেন্ট কিংবা কফিশপ অথবা
পানশালায় কাজ করতে হলে তেমন কোনো শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে না এবং ওয়েটার ছাড়া অন্য কোনো পদে কাজ করতে হলে স্থানীয় ভাষা কিংবা বিশেষ কোনো দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে না।
লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থার কারণে বেশির ভাগ রেস্টুরেন্ট, কফিশপ ও পানশালা বন্ধ থাকায় বলতে গেলে একটা দীর্ঘ সময় কর্মহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছেন অনেকে। যদিও ইউরোপের অনেক সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যাঁদের বৈধ ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে, কোনোও একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধভাবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যেও বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ পরিশোধ করার জন্য (যদিও সে সময় কারও কাজ না থাকে)। তবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন একটা আশার খবর বয়ে আনতে পারেনি, কেননা তাঁরা কেউই ফুলটাইম ওয়ার্কার না এবং বেশির ভাগ দেশগুলোয় তাই তাঁরা কোনোও ধরনের চুক্তি ছাড়াই কাজ করে থাকেন। ইউরোপের কিছু দেশ শিক্ষার্থীদের আর্থিকভাবে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেটা উল্লেখযোগ্য কোনোও কিছু নয় সে অর্থে। যেমন: স্লোভেনিয়ার বর্তমান সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্লোভেনিয়ার পারমানেন্ট রেডি সেন্ট কার্ড যাদের রয়েছে, তাদের এপ্রিল এবং মে দুই মাস ১৫০ ইউরো করে অনুদানের ঘোষণা দেয়। ১৫০ ইউরো বলতে গেলে স্লোভেনিয়াতে কারও এক মাস চলার জন্য খুব একটি বড় অ্যামাউন্ট না। অনেক দেশের সরকারের পক্ষ থেকে সে দেশের স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সুবিধা দেওয়া হলেও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন সে রকম আর্থিক সহায়তা ছিল না বললেই চলে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো একককালীন যে অর্থ সহায়তা প্রদান করে, সেটাও তেমনভাবে উল্লেখ করার মতো কোনো বড় একটি অ্যামাউন্ট ছিল না।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং পলিসির কারণে সরাসরি বিদেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানো সম্ভব হলেও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চাইলে সহজেই কেউ টাকা পাঠাতে পারেন না। তাই এ পরিস্থিতিতে অনেকে বাধ্য হয়ে হুন্ডির আশ্রয় নেন। সে ক্ষেত্রে যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো নিকটস্থ কারও সন্ধান করা, যিনি বাংলাদেশে টাকা পাঠাবেন। তিনি সে টাকা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে সরাসরি তাঁর হাতে তুলে দেন এবং বাংলাদেশে থেকে তাঁর পরিবারের কোনোও সদস্য ওই লোকের বিশ্বস্ত কারও কাছে এর সমপরিমাণ অর্থ পৌঁছে দেন। এতে সরকারের রেমিট্যান্স প্রবাহে ঘাটতি তৈরি হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে যেহেতু দীর্ঘদিন অনেকের কাজ ছিল না এবং একই সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং পলিসির কারণে অনেকের পক্ষে বাংলাদেশ থেকে টাকা আনা সম্ভব হয়নি। অনেকের পরিবারের আবার সে সামর্থ্যটুকু নেই।
এখন ইউরোপে গ্রীষ্মকাল চলছে। ইউরোপের অর্থনীতির একটা বড় অংশ আসে ট্যুরিজম থেকে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় ইউরোপে এ সময় ট্যুরিজম সেক্টরটি সবচেয়ে বেশি চাঙা থাকে। তবে এ বছর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, ফলে লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পরও অনেকে কাজে ফিরতে পারছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তাদের অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতির মাঝখানে যখন আমরা দাঁড়িয়ে, তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় ধাপে করোনার সংক্রমণ যেনও মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে চলেছে। যেহেতু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফের করোনার আঘাত এসেছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন, আগামী সেমিস্টারের শিক্ষা কার্যক্রমও কি অনলাইনে পরিচালিত হবে? যদি গত সেমিস্টারের মতো আগামী সেমিস্টারের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হয়, সে ক্ষেত্রে তাহলে বিদেশে অবস্থান করার যৌক্তিকতা কতটুকু? কিংবা সে ক্ষেত্রে কেন বা পুরো টিউশন ফি প্রদান করতে হবে? কিংবা করোনা পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় যদি কোনো দেশের সরকার বলে বসে, এখনই সে দেশে অবস্থানরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের সে দেশ থেকে চলে যেতে হবে?
জেরিন ফাতেমা, একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। বর্তমানে হাঙ্গেরিতে ইউনিভার্সিটি অব ডেব্রেসেন থেকে ডেটা সায়েন্সে (স্নাতক) পড়ছেন। করোনায় অন্য অনেকের মতো তাঁর জীবনকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটিকে তিনি আবেদনে জানিয়েছেন, এ পরিস্থিতি বিবেচনায় তাঁকে যেনও টিউশন ফির ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়; কিন্তু ইউনিভার্সিটি এ আবেদনে সাড়া দেয়নি। ফলে একধরনের হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি।
ইকরাম হোসাইন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের ইউনিভার্সিটি দ্য লিব্রে ব্রাসেলস থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করছেন মাইগ্রেশন, রাইটস অ্যান্ড পলিসি বিষয়ে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনা করতে হলে কোনো ধরনের টিউশন ফি প্রদান করতে হয় না। তবে প্রতিবছর টেম্পোরারি রেসিডেন্ট নবায়ন করার ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের কোনো ব্যাংকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা করতে হয়, যেটাকে আমরা অনেকে সচরাচর ব্লক অ্যাকাউন্ট বলে থাকি। করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন তিনি কাজে যেতে পারেননি, এমনকি এখনো যে তিনি স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসতে পেরেছেন, এমনটি নয়। অন্যদিকে, এ মুহূর্তে তাঁর পরিবারের অবস্থা তেমন একটা আশানুরূপ নয়। ফলে ব্লক অ্যাকাউন্টের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, সেটা জোগাড় করতে এখন তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট নবায়ন করতে পারার বিষয়টি নিয়ে তিনি একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
জেরিন ফাতেমা ও ইকরাম হোসাইনের মতো অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ইউরোপে বসবাসরত অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, যাঁরা মূলত নিজ খরচে পড়াশোনার জন্য ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কেউ রীতিমতো চিন্তিত পরবর্তী সেমিস্টারের টিউশন ফি পরিশোধ নিয়ে, কেউবা আবার চিন্তিত টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রিনিউ করা নিয়ে। আবার যেহেতু এখনো অনেকে পুরোভাবে পার্টটাইম চাকরিতে ফিরতে পারেননি এবং বাংলাদেশের ব্যাংকিং পলিসির কারণে দেশের থেকেও সেভাবে টাকা আনা সম্ভব হয় না, তাই অনেকে অর্থনৈতিকভাবে চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাঁদের ভবিষ্যৎ, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ইউরোপে তাঁদের টিকে থাকা। কেউ আবার দেশে ফিরে যেতে চাইছেন। এ অবস্থায় অনেকে আমাদের সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন, যাতে বাংলাদেশ সরকার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এসব বিষয়ে একটা কার্যকর সমাধানের পথ বের করতে পারে।