আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ সাধারণ মানুষ স্বল্প ব্যয়ে যে যানবাহনে যাতায়াত করেন, তা-ই গণপরিবহন। এ দেশের প্রেক্ষাপটে ট্রেন একটি অন্যতম গণপরিবহন হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে যাত্রা শুরুর পর থেকেই। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আপামর মানুষের কাছে স্বল্পতম খরচে যাতায়াতের অন্যতম একটি যান হচ্ছে ট্রেন। পণ্য পরিবহনেও এর বিকল্প নেই। কিন্তু সম্প্রতি কিছু সিদ্ধান্তের কারণে ট্রেন আর গণমানুষের থাকছে না; গণপরিবহনের খাতা থেকে কাটা পড়ে যেতে পারে রেলের নাম। কাউন্টারের পরিবর্তে অনলাইন পদ্ধতি প্রয়োগের কারণে ট্রেনযাত্রার সুযোগ থেকে এমনিতেই বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ অনেক যাত্রী। কারণ তাদের মোবাইল বা অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা নেই। আর অবশিষ্ট যে পরিমাণ যাত্রী আছেন তারাও অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে ট্রেনের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়তে পারেন। কারণ বাংলাদেশ রেলওয়েতে যাত্রী পরিবহনে ২৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পণ্য পরিবহনেও ভাটা পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এ ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে সর্বশেষ ৭.২৩ শতাংশ হারে বাড়ানো হয় রেলের ভাড়া।
করোনাকালে ভাড়া বৃদ্ধির খবরে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যুক্তিতে আপাতত প্রস্তুতির কাজ সেরে রাখার কথা বলা হয়েছে। পরে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। গতকাল রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব আলোচনা হয়। বৈঠক প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন আমাদের সময়কে বলেছেন, রেলে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতেই একটি প্রেজেন্টেশন ছিল। সেখানে সার্ভিস নিশ্চিত করতে নানা বিষয়ে কথা হয়। আলোচনা আসে ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারেও। রেল যেহেতু সরকারি গণপরিবহন। এ মুহূর্তে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। আগে সেবা নিশ্চিত করে পরবর্তী সময় সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সূত্রের খবর, বৈঠকে ভাড়া বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনা আনা হয়েছে, সেটি যেন আপাতত জানাজানি না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে গতকাল বুধবার। আর ভাড়া বাড়ানোর
যুক্তি হিসেবে অপারেশনাল খরচ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে যাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা বা সামর্থ্য কিংবা এ সংক্রান্ত শিক্ষা নেই, তাদের ট্রেনে চড়ার সুযোগ কমছে অনলাইন পদ্ধতি প্রয়োগের কারণে। অধিকাংশ মানুষেরই রেলের টিকিট কাটার অ্যাপ বা অ্যাকাউন্ট নেই। দেশের সাধারণ মানুষের অনেকেই দরিদ্র ও অশিক্ষিত। অনলাইনের সাহায্য ছাড়া তারা ট্রেনে চড়তে পারবেন না।
যদিও আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেছিলেন, অ্যাপস বা অনলাইনের মাধ্যমে টিকিট কিনলে হয়রানি দূর হবে। যারা মুঠোফোন বা অনলাইন ব্যবহার করতে জানেন না, তারা শিখে ফেলবেন বলেই মনে করেন তিনি। বলেন, আমি মনে করি, এতে সমস্যা হবে না।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ট্রেনে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্ত হলেও পৃথিবীর কোথাও এমন নজির নেই। সাধারণ মানুষের স্বল্প খরচে যাতায়াতে রেলে বছরে হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। গত অর্থ বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ভতুর্কি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক মানুষের ট্রেনে চড়ার সুযোগ সীমিত হয়েছে শতভাগ টিকিটে অনলাইনে দেওয়ায়। ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে থাকা মানুষকে আরেকজনের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে বাস্তবতা হলো অধিকাংশ রুটে সকাল ৬টায় টিকিট ছাড়ার পর কয়েক মিনিটেই শেষ হয়ে যায়।
সরকারি হিসাবে দেশে ছয় কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার না করলেও আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট আর কোনো দিন কাউন্টারে মিলবে না। ট্রেনে চড়তে প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে হবে। ইন্টারনেট, স্মার্ট ডিভাইস, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার; দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষে সামর্থ্যরে বাইরে হলেও রেলের যুক্তি প্রথম কয়েক মাস অসুবিধা হলে ধীরে ধীরে সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার শিখে যাবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জ্বালানি ব্যয়, কর্মচারী খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। ২০১৬ সালে ৭.২৩ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। সেই যুক্তিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সঙ্গে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনা করেছে রেলওয়ে। বলা হয়েছে ৩৩ শতাংশ খরচ বেড়েছে। ৪ বছর আগের ভাড়া বৃদ্ধি, তেলের দাম, অপারেশন ও মেইনটেনেন্স খরচসহ আনুষঙ্গিক বিবেচনায় ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। তা ছাড়া আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, এডিবির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণের শর্ত ছিল প্রতিবছর ভাড়া বৃদ্ধি। এসব কারণ দেখিয়ে যাত্রী পরিবহনে ২৫ ভাগ এবং পণ্য পরিবহনে ২০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটের এসি/নন এসি বাসের ভাড়ার সঙ্গে তুলনা করে ট্রেনের ভাড়া ২৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ট্রেনে বর্তমান ভাড়া এসি ৬৫৬ টাকা এবং নন এসি ভাড়া ৩৪৫ টাকা দেখানো হয়। ২৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে প্রস্তাবিত ভাড়া এসির ক্ষেত্রে ১০৮০ টাকা এবং নন এসির ক্ষেত্রে ৪৩২ টাকা। একইভাবে সিলেটের জন্য এসি ৬১০ টাকা থেকে বেড়ে ১০৭০ টাকা এবং নন এসির ক্ষেত্রে ৩২০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা ধরা হয়। রাজশাহী রুটের জন্য ৬৫৬ টাকা এসির ভাড়া হবে ১০১০ টাকা। নন এসির জন্য ৩৪০ থেকে ৪২৫ টাকা দাঁড়াবে। একইভাবে দিনাজপুরের জন্য থেকে ৮৯২ টাকার এসি ভাড়া হবে ১৩৩০ টাকা। নন এসির ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে এ দূরত্বে ৪৬৫ থেকে ৫৮২ টাকা। পঞ্চগড়ের জন্য ঢাকা থেকে এসি ভাড়া বর্তমানে ১০৫৩ টাকা; বেড়ে তা হবে ১৪৭০ টাকা। আর নন এসির জন্য ৫৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৬৮৮ টাকা। রংপুরের জন্য ভাড়া হবে ৯৬৬ টাকার এসি ভাড়া ১৪০০ টাকা এবং নন এসি হলে ৫০৫ টাকার ভাড়া গুনতে হবে ৬৩২ টাকা। লালমনি স্টেশনের জন্য ৯৬৬ টাকার বর্তমান ভাড়া এসি হিসেবে দাঁড়াবে ১৪০০ টাকা আর নন এসি হলে তা হবে ৫০৫ টাকার বদলে ৬৩২ টাকা। ঢাকা থেকে খুলনার জন্য ভাড়া এসি ভাড়া বর্তমানে ৯৬৬ টাকা। তা দাঁড়াবে ১৩৯০ টাকা আর নন এসি হলে এ দূরত্বের ভাড়া ৫০৫ থেকে ৬৩২ টাকা হবে। প্রস্তাবিত দূরত্বে এসি চেয়ার, এসি বার্থ ভিন্ন ভাড়ার কথা বলা হয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসি চেয়ার হলে ৬৫৬ টাকা ভাড়া, এসি বার্থ হলে ১১৭৯ টাকা বর্তমান ভাড়া। প্রস্তাবিত ভাড়া হচ্ছে এসি চেয়ারের জন্য ১০৮০ টাকা এবং এসি বার্থের জন্য ১৯৮০ টাকা। রাজশাহীর জন্য ৬১০ টাকায় বর্তমানে এসি চেয়ার, এসি বার্থ ১১৭৯ টাকা। প্রস্তাব করা হয়েছে এসি চেয়ারের জন্য ১০৭০ টাকা এবং এসি বার্থের জন্য ১৯৭০ টাকা। এ রকম সিলেটের জন্য ১১৭৩ টাকায় এসি বার্থ, এসি চেয়ার ৬৫৬ টাকা বর্তমান ভাড়া। নতুন প্রস্তাবে এসি চেয়ারের জন্য ১০১০ টাকা এবং এসি বার্থের জন্য ১৮৪০ টাকা। দিনাজপুরের জন্য প্রস্তাবিত এসি বার্থ ২৪৩০ টাকা, এসি চেয়ার ১৩৩০ টাকা। পঞ্চগড়ের জন্য ২৬৯০ টাকা এসি বার্থ এবং এসি চেয়ারের জন্য ১৪৭০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিভিন্ন শ্রেণির ন্যূনতম ভাড়াও নতুন করে নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে সাধারণ নন এসি ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা, মেইল ১৫ টাকার স্থলে ২০ টাকা এবং এবং কমিউটার ট্রেনে ২০ টাকার বদলে ২৫ টাকা ন্যূনতম ভাড়া গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেয় ট্যারিফ কমিটি। এছাড়া ট্রেনের সুলভ আসনের জন্য সর্বনি¤œ ৪৫, শোভন ৫৫, শোভন চেয়ার ৬৫, ১ম সিট এসি চেয়ার ১১০, ১ম বার্থ ১৩০, এসি বার্থ ১৬৫ টাকা নির্ধারণের কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাড়া সংস্কার, ট্যারিফ সমন্বয়, হিসাব পদ্ধতি আধুনিকায়ন, কন্টেইনার কোম্পানি স্থাপনসহ বেশকিছু বিষয় পর্যালোচনায় গতকাল রেলমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। রেলভবনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সচিব, রেলওয়ের ডিজিসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গতকালের বৈঠক সূত্রে জানা যায়, যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পার্শেল ও কন্টেইনারেও ভাড়া বাড়ছে। বৃদ্ধির পরিমাণ ২০ শতাংশ। ট্রেনে ১৪ শ্রেনীতে পন্য পরিবহন করা হয়। কন্টেইনার পরিবহনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম-ঢাকা পথে ২০ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়। আর চট্টগ্রাম-ঢাকা পথে আগের ৫০ শতাংশ এর পরিবর্তে ২৫ শতাংশ রেয়াতি সুবিধা প্রদান করার কথা বলা হয়েছে।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৫-১৬ সালে রেলের জ্বালানি খাতে খরচ ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খরচ হয় ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ হয় ৩৬ লাখ ৫১ হাজার যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। একইভাবে বেতন বাবদ ১২১ কোটি ৩৯ আখ ২৭ হাজার এবং ১৬২ কোটি ১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। সেহিসাবে সর্বমোচ খরচ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২৫ কোটি ৩৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬৬ কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ৭.২৩ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি হয়। তাতে কতটুকু লাভ হলো তার সুনির্দিষ্ট যুক্তি নেই।