আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ আবদুল মালেক বাদল একজন স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক। তবে তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারী ব্যবহার করতেন পাজেরো। অধিদফতরের মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়ি ব্যক্তিগত গাড়িতে পরিণত করেছেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়, রাজধানীর তুরাগে গাড়িচালক আবদুল মালেকের রয়েছে ২৪টি ফ্ল্যাটবিশিষ্ট সাত তলার দুটি বিলাসবহুল বাড়ি। একই এলাকায় ১২ কাঠার প্লট। এছাড়া হাতিরপুলে ১০ তলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসনকে জিম্মি করে চিকিৎসকদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন। চিকিৎসকদের বদলি-পদোন্নতিতেও ছিল তার হাত। নিয়োগ, বদলি ও পদন্নোতিতে তদবিরের নামে-বেনামে আদায় করেছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। যার বদৌলতে অল্প দিনেই শতকোটি টাকারও বেশি অর্থ-সম্পদের মালিক এই মালেক ড্রাইভার।
শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরে ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজে সেই সংগঠনের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ওই পদের ক্ষমতাবলে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালকদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন। তাদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নামেও তিনি হাতিয়েছেন বিপুল পরিমাণ টাকা। ক্ষমতা দেখিয়ে অধিদফতরের বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়েছেন ডজনখানেক নিজের আত্মীয়-স্বজনকে।
অবৈধ অস্ত্র, জাল নোট ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রোববার (২০ সেপ্টেম্বর) ভোরে রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে ড্রাইভার মালেককে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ বাংলাদেশি জাল নোট, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইলফোন উদ্ধার করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ব্যক্তিগত জীবনে দুটি বিবাহ করেছেন আবদুল মালেক। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের পাশে ছয়কাঠা জায়গার ওপর ৭ তলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক ভবন রয়েছে তার। যেখানে তার ২৪টি ফ্ল্যাট। পাশাপাশি স্থানেই আনুমানিক ১০-১২ কাঠার প্লট রয়েছে। বর্তমানে সপরিবারে সেখানকার একটি ভবনের তৃতীয় তলায় বসবাস করেন এবং বাকি ফ্ল্যাটগুলোর কয়েকটি ভাড়া দেয়া রয়েছে। এর বাইরে ২৩, ফ্রি স্কুল রোড, হাতিরপুলে পৈতৃক সাড়ে চার কাঠা জায়গার ওপর দশতলা নির্মাণাধীন ভবন আছে।
মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় প্রায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে, যাতে প্রায় ৫০টি বাছুরসহ গাভী রয়েছে।
অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠা আবদুল মালেকের অধিদফতরের একাধিক কর্মচারীর সঙ্গেও ছিল যোগাযোগ। সে সম্পর্কে তিনি কাজে লাগিয়েছেন নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন পদে নিজের পরিবারেরই সাতজনকে চাকরি দিয়েছেন মালেক ড্রাইভার। মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলিকে অধিদফতরের অফিস সহকারী, ভাই আব্দুল খালেককে অফিস সহায়ক, ভাতিজা আব্দুল হাকিমকে অফিস সহায়ক, বড় মেয়ে বেবির স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার, ভাগ্নে সোহেল ও ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার, নিকটাত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক পদে চাকরি দিয়েছেন।
আবদুল মালেক স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক। মহাপরিচালক অন্য একটি গাড়িতে চড়েন এবং চালকও আলাদা। অথচ আবদুল মালেক মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত একটি সাদা পাজেরো জিপ (ঢাকা মেট্রো গ- ১৩-২৯৭৯) নিয়মিত ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবেই ব্যবহার করতেন।
এর বাইরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও দুটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন ড্রাইভার আবদুল মালেক। একটি পিকআপ গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঠ-১৩-৭০০১) তার ডেইরি ফার্মের দুধ বিক্রি এবং তার মেয়ের জামাই পরিচালিত অধিদফতরের ক্যান্টিনের মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হয়, যার গাড়িচালক মাহবুব।
অপর একটি মাইক্রো (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৬৭৪১) স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত মালেকের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ব্যবহার করেন, যার গাড়িচালক কামরুল।
প্রাথমিক জিজজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতরে সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকারও বেশি অর্থ অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন মালেক ড্রাইভার। বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাকে দুদকে তলব করা হয়েছে।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি র্যাবের প্রাথমিক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে রাজধানীর তুরাগ এলাকায় জনৈক আবদুল মালেক ওরফে ড্রাইভার মালেকের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকা ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাওয়া যায়। একজন তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ কর্মচারী হয়েও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণে অর্থ গচ্ছিত আছে বলে জানা যায়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-১ বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব-১ অধিনায়ক আরও বলেন, ‘তিনি পেশায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলের একজন ড্রাইভার। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পে ড্রাইভার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি শুরু করেন।’
‘বর্তমানে তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদফতরে কর্মরত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল নোট ব্যবসাসহ অস্ত্রের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।’
লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন ও জাল টাকা রাখার দায়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পরবর্তীতে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের নাম বেরিয়ে আসবে বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু মালেক বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক, সেহেতু তার সম্পদ রক্ষা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি অবৈধ অস্ত্র সঙ্গে রাখতেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। আমরা মনে করি, তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ-সম্পদের বিষয়ে দুদক ও সিআইডি তদন্ত করবে।