কাউছার আহমদ খানঃ বৈবাহিক সম্পর্ক শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষা নয়, বরং দাম্পত্যজীবন হৃদয় ও আত্মার মেলবন্ধন। আইন পালন ও নিয়ম রক্ষার মাধ্যমে পারিবারিক সুখ-সমৃদ্ধি টিকিয়ে থাকতে পারে না কোনো সুস্থ সমাজে।
ইসলামে নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম মানুষকে আইনের ঊধর্ে্ব উঠে নৈতিকতার ওপর চলতে তার অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করে। বরং কল্যাণ তখনই হবে, স্বামী-স্ত্রী যখন রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের সুন্নাতের ওপর চলতে সচেষ্ট হবে।
এজন্যেই রাসুল (সাঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সমাজে, রান্না-বান্নার কাজ নারীরাই করতেন। নবীজি (সাঃ)-এর পবিত্র স্ত্রী ও কন্যারা ঘরের কাজ নিজেরাই করতেন।
হযরত ফাতেমা (রাঃ) মহিলাদের জন্যে আদর্শ। আদরের কন্যা ফাতেমা (রাঃ)কে স্বামীর গৃহে পাঠানোর পর প্রিয় নবী (সাঃ) এভাবে কাজ ভাগ করে দিয়েছিলেন যে, ঘরের ভেতরের কাজ স্ত্রী করবে, আর বাহিরের কাজ করবে স্বামী। [যাদুল মা’আদ; ৫ (১৬৯)]
দুহাত তুলে তাঁর জন্য দোয়া করলেন এবং বললেন, ‘মা কখনও স্বামীর আদেশ অমান্য করো না। তার সুখ দুঃখের সমভাগ হবে। তার সেবায় নিজকে নিয়োজিত করিও। মনে রেখো, কেয়ামতের দিন যে সমস্ত মহিলা দোযখী হবে তাদের অধিকাংশ স্বামীর আর্দশ অমান্যকারী। কোনো সময় কোনো কিছুর জন্য হযরত আলীকে চাপ দিও না। সে দরিদ্র। স্বামীর পদতলেই স্ত্রীর বেহেশত সবর্দা এ কথা স্মরণ রেখে স্বামীর ঘর করবে। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে যেনো তোমার হাসি মুখ দেখে। মনে রেখো, স্বামী যদি স্ত্রীর মলিন মুখ দেখে তাতে যে কষ্ট পায় এরূপ দুঃখ আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। যে পুরুষ তার স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকে মহান আল্লাহ ওই স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন।’
হযরত ফাতেমা (রাঃ) যাতা ঘুরাবার কারণে হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিলো। তজ্জন্য পিতার কাছে দাসী চেয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসির পরিবর্তে শিক্ষা দিয়েছেন তাসবীহ। [বুখারি হাদিস; ৩১১৩]। এটাই হলো আদর্শ ও নৈতিকতার ব্যাপার।
অনেক উচ্চ শিক্ষিত পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর বাড়ির খেদমত করা আইনের দৃষ্টিতে তার উপর বর্তায় না বলে এড়িয়ে যায়। তারা ভুলে যান আইনের শুষ্ক-রুক্ষ পথে সুখের সংসার রচিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, ভালোবাসা, অন্যকে নিজের উপর প্রাধান্য দেয়ার মানসিকতা, সেবা ইত্যাদি মহৎ গুণাবলির চর্চা করা। সুখের নীড় রচিত করতে পুত্রবধূর উচিত সেচ্ছায় শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা। ইহাকে সৌভাগ্যের, সাওয়াব ও পরকালীন মুক্তির বিষয় মনে করা। মনে রাখতে হবে, শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা আইনত ফরজ না হলেও নৈতিক ফরজ।
প্রত্যেক সন্তান চায় তার পিতা-মাতা শান্তিতে থাকুন। সে নর হোক বা নারী। নারী যেমন চায় নিজ মা বাবা তার ভাইয়ের স্ত্রীদের নিকটে আদর-যত্নে থাকুক। ঠিক তেমনি স্বামীও চায় তার স্ত্রী মা বাবার খেদমত করবে।
স্ত্রী হিসাবে স্বামীর সকল খেদমত করা ফরজ। পাশাপাশি শ্বশুর-শাশুড়ি, অন্যদের সেবা করা, মানবতাবোধ ও নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ। তবে এখানে অবশ্যই স্মরণীয় যে, স্বামীর মা-বাবাকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান ও সমীহের চোখে দেখবেন। তাঁদের ভালোবাসা, সেবা করা পরম সৌভাগ্যের মনে করবেন। সাওয়াবের অধিকারী হয়ে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই জান্নাতী হবেন। অনুরূপ শ্বশুর-শাশুড়িও পুত্রবধূকে নিজ মেয়ের মতো আদর খাতির করবেন। কিন্তু দেখা যায়, কোনো কোনো শ্বশুর-শাশুড়ি পুত্রবধূকে আদর-স্নেহ করেন না, যেমনটা নিজ মেয়ের বেলায় করেন।
এমতবস্থায় পুত্রবধূর দায়িত্ব হলো, তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার না করে সম্মানের সাথে শান্তভাবে সময় বুঝে ইসলামের আলোকে বুঝিয়ে বলা। কারণ বয়সের দরূণ তারা এমনটি করে থাকে, মানুষের বয়স হলে সে শিশুর মতো আচরণ করে। কেননা হযরত আসমা (রাঃ) তার মায়ের ব্যাপারে রাসূলে আকরাম (সাঃ)কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার মায়ের সাথে কীরূপ আচরণ করবো? উল্লেখ্য তখনও তাঁর মা মুসলিম হননি। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তাঁর সাথে সদ্ব্যবহার করো’। পবিত্র কুরআন বলে, ‘উত্তম দিয়ে নিকৃষ্টকে দূর করতে হবে’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, তুমি তার সাথে ভালো ব্যবহার করো’।
তাই ইসলাম দুর্ব্যবহারের জবাবে দুর্ব্যবহার করা, গালির বদলে গালি দেয়া, রাগের জন্য রাগ দেখানো, সম্পর্কছিন্নকারীর সাথে সম্পর্ক না রাখা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছে। কেননা এর দ্বারা অশান্তি বাড়ে। অতএব ক্ষমা, মহত্ম, ধৈর্য, সহমর্মিতা, নমনীয়তা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হতে হবে।
আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে (আল্লাহর নিকট) সাহায্য প্রার্থনা করো।’ [সুরা বাকারা, ২;১৫৩]।
সুরা যুমারে রয়েছে, ‘বস্তুত ধৈর্যশীলদের তো অপরিমিত পুরস্কার পুরোপুরিভাবেই দেয়া হবে’। (৩৯ : ১০)।
আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা যদি ওদেরকে মার্জনা কর, ওদের দোষত্রুটি উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর তবে জেনে রেখো, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [সূরা তাগাবুন, ৬৪;১৪]। বস্তুত আল্লাহর খাঁটি বান্দা হতে হলে বিনয়ী হওয়া আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘রাহমানের (আল্লাহর) বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে বিনয়ের সাথে চলাফেরা করে।’ (সূরা ফুরকান, ২৫;৬৩)।
আমাদের সমাজের আবহমানকালের চলমান রীতি হলো, পুত্রবধূরা শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-যত্ন করে থাকেন, এটাকে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে মনে করা হয়। শ্বশুর -শাশুড়ির সেবা করার এ রীতি সাহাবায়ে কেরামের জীবনেও দেখা যায়। হযরত কাবশা বিনতে কা’ব বিন মালেক (রাঃ) ছিলেন হযরত আবু কাতাদা (রাঃ)-এর পুত্রবধূ। কাবশা (রাঃ) বণর্না করেন, একবার আবু কাতাদা (রাঃ) [কাবশা (রাঃ)-এর শ্বশুর] ঘরে প্রবেশ করে অযূর পানি খোঁজ করেন। তখন কাবশা (রাঃ) শ্বশুরকে নিজ হাতে পানি ঢেলে দেন। [আবু দাউদ, হাদিস নং-৭৫]। যেটা সাহাবিদের সুন্নাত, সেটা আধুনিক পুত্রবধূরা কীভাবে লঙ্ঘন করে?
তাছাড়াও সৃষ্টির সেবা করা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। সকল সৃষ্টির মাঝে আল্লাহ তায়ালার নিকট সবচেয়ে প্রিয় সে ব্যক্তি যে আল্লাহর পরিজনের প্রতি ইহসান করে।’ (বায়হাকী)।
আর মানুষতো সৃষ্টির সেরা জীব। সুতরাং শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা না করার কোনো অযুহাত প্রকাশ করাই নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে স্ত্রীর কর্তব্য নৈতিকতাবোধ দ্বারা চালিত হওয়া। স্ত্রী নৈতিকতার ভিত্তিতে যা করবেন, তা রান্না-বান্না হোক, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা হোক বা অন্য কিছু, তা তিনি যতটুকুই করবেন, তাকে সতন্ত্র মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং তার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা করতে হবে। স্ত্রীর ওপর স্বামীর কর্তৃত্ব থাকবে আল্লাহর নির্দেশে।
আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের ওপরে কর্তৃত্বশীল এজন্যে যে, আল্লাহ একের উপর অপরজনের বৈশিষ্ট্য মর্যাদা দিয়েছেন’। [সূরা নিসা, আয়াত-৩৪]। আবার স্ত্রীর কাজে স্বামী সহায়তা করতে হবে এবং স্বামীর কাজে স্ত্রীকে সহায়তা করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পরস্পরের উপর এটা কর্তব্য। যা স্বয়ং রাসূলে আকরাম (সাঃ) করতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন পুরুষদের আছে তাদের ওপর। আর নারীদের ওপরে পুরুষদের মর্যাদা। [সূরা বাকারা, ২ঃ২২৮]।
এখন পরিবারের মেয়ে বড় হলে পরে অন্যের ঘরে বিয়ে দিতে হয়। মা-বাবার সেবা যত্নের জন্য পরিবারে থাকবে ছেলে। ভরণপোষণের দায়িত্ব ইসলাম নারীর ওপরে দেয়নি। তাই কন্যার, স্ত্রীর, বৃদ্ধা মা-বাবার ভরণপোষণের জন্যে বাহিরে থাকবে, এমনকি বছরের পর বছর প্রবাসেও থাকতে পারে ছেলে। এমতাবস্থায় সময় অসময় তার মা-বাবার সুবিধা অসুবিধা কে দেখবে? সুতরাং যেহেতু স্বামীর কাজে সহযোগিতা করা স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই স্বামী যেখানে অনুপস্থিত সেখানে স্বামীর দায়িত্ব কাজ মা-বাবার সেবা-যত্ন করা, সেটা স্ত্রীকেই পালন করতে হবে। একজন সন্তানের দায়িত্ব তার পরিবারের পাশাপাশি তার মা-বাবার দেখাশোনা করা। হাদিসে এসেছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত’। তাই একজন নেককার, সৎ, আর্দশবান গুণবতী স্ত্রী কখনোই নিজের স্বামীকে তার জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার চিন্তাও করতে পারে না।
স্বামীর মা-বাবার খেদমত করা পরোক্ষভাবে স্ত্রীর নৈতিক দায়িত্ব। যদিও স্বামীর মাতা-পিতা স্ত্রীর জন্মদাতা মাতা পিতা নন, কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি স্বামীর মাতা-পিতা। যেহেতু স্ত্রী মুহছেনা (সৎকর্মশীলা), সেহেতু খেয়াল রাখতে হবে যেনো কোনো জামেলা না হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘সৎকর্মপরায়না নারীরা বিনয়ী হয়। আল্লাহ তাদেরকে অহিফাজত করতে আদেশ দিয়েছেন স্বামীদের অনুপস্থিতিতে তা হিফাযত করা। (সূরা নিসা-৩৪)।
স্বামীর আনুগত্য করা, তাকে সন্তুষ্ট রাখা, আহ্বানে সাড়া দেয়া, শালীনতা বজায়, পর্দায় থাকা, স্বামীর মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয়দের সেবা করা খোঁজ নেয়া, সদাচরণ করা, অনুমতি ছাড়া কোথাও না যাওয়া ও অর্থ ব্যয় না করা, গোপনীয়তা রক্ষা করা, উপহার ও আনন্দ দেয়া ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণী, ‘সবোর্ত্তম স্ত্রী সে যার প্রতি তাকালেই স্বামীর হৃদয়-মন আনন্দে নেচে উঠে।’ (ইবনে আবু হাতেম)।
আরো বলেন, ‘কোনো স্ত্রীলোক যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রমজানের রোযা রাখে, সতীত্ব অক্ষুণ্ন রাখে এবং স্বামীর আনুগত্য করে চলে, তবে তাকে বলা হবে, জান্নাতের যে দরজাগ দিয়ে তুমি যেতে চাও, সে দরজা দিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করো’। (ইমাম আহমদ)। হাদিসে রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যদি আমি কারো প্রতি অপরকে সিজদা করার আদেশ দিতাম, তবে স্ত্রীদের তাদের স্বামীকে সেজদা করার হুকুম করতাম। কেননা, স্ত্রীর ওপর স্বামীর হক অপরিসীম।’ (তিরমিযি, ৪/৩২৩)। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘দুনিয়ার সর্বোত্তম সম্পদ হলো নেককার স্ত্রী।’
মুহছেনা (সৎকর্মশীল স্ত্রী) হলো এমন, যে বলবে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে আমরা ইহকালে কিছুটা কষ্ট করবো। তাহলে পরকালে জান্নাত পাবো। নবীজী (সাঃ) বলেছেন, ‘মাতা-পিতা তোমার জান্নাত, মাতা-পিতা তোমার জাহান্নাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতা-মাতার অসুন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ (তিরমিযি)। তাই নিজের মা-বাবাকে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে অসন্তুষ্ট করে স্বামী-স্ত্রী সুখে থাকবেন? কিন্তু আখিরাতে জাহান্নাম হবে এমন সন্তানের বাসস্থান। যে মা আপনাকে দশমাস গর্ভে ধারণ করলো, আড়াই বছর দুধপান করালো, নিজে না খেয়ে আপনাকে খাওয়ালো, প্রস্রাব-পায়খানা সাফ করলো, হাঁটা-চলা, কথা বলা শেখালো, অসুস্থ হলে রাতভর জেগে রইলো, নিজের প্রাণের বদলে সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চাইলো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার প্রতি ইহসান করার আদেশ দিয়েছি। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করে কষ্টের সাথে, তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস’। [সূরা আহকাফ : ১৫]।
বাবা লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করলো, আপনার চাহিদা পূরণ করলো, উপযুক্ত বয়স পর্যন্ত দেখভালো করলো, আর স্ত্রী পেয়েছেন বলে, মা বাবাকে ভিন্ন ভাববেন? তাদের মনে আঘাত দিবেন? আলাদা থাকার চিন্তা করবেন? স্ত্রীর পরামর্শে তার অধিক সুখের জন্যে স্ত্রীর কারণে, স্বামী যদি মা-বাবার খেদমত না করে, অবাধ্য হয়, দূরাচরণ করে, মনে আঘাত দেয়, তাহলে স্ত্রীকেও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
শ্বশুর বাড়ির সম্পর্ক নতুন কিছু নয়, মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এই সম্পর্ক চলে এসেছে। জীবনের সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে শরীয়তকে অনুসরণ করা উচিত। অন্যথায় সংসারে খিটমিট লেগে থাকবে আর বিচার দিবসেও আল্লাহর প্রশ্ন থেকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।
সন্তানের জন্যে নির্দেশনা এসেছে, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, তাদের একজন বা উভয়ই বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে তাদেরকে উফ বলনা, তাদেরকে ধমক দিওনা, তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো। তাদের প্রতি রহমতের ডানা প্রসারিত করো। আর বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছিলেন’। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)।
পারিবারিক শান্তি অনেক বড় শান্তি। ছোটখাটো কিছু সমস্যা সব দম্পতির মধ্যেই থাকে। সেটা বড় আকার ধারণ করলেই শুরু হয় অশান্তি। বউয়ের সাথে পরিবারের সম্পর্ক ভালো না হলে, সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় ছেলে। সবার কাছেই ছেলেটা বেশি খারাপ হয়ে ওঠে। বৌ বুঝতে চায় স্বামী কী এখনো মায়ের অাঁচল তলে আছে নাকি? মাও বুঝতে চায় ছেলে বউয়ের আপন হয়ে গেলো। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়টা ছেলের ওপর পড়ে। অনেক সময় ছেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কোনো কূলই রক্ষা করতে পারেন না।
একজন নারীকে তার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকদের প্রতি ধৈর্য ও নমনীয়তা দেখাতে হবে, ঠিক যেমনটা সে নিজে আশা করে তাদের কাছে।
পুত্রবধূকে কৌশলী হতে হবে। একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে : এক নববধূর শাশুড়ি তাকে খুব জালাতন করতো, সে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জবাব দিলে আরো বেশি ক্ষেপে যেতো। পুত্রবধূ একটি কৌশল অবলম্বন করলো। সে শাশুড়ির গালমন্দের জবাব দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলো, তার আরো বেশি আদর যত্ন নিতে শুরু করলো। অপমানজনক কিছু বললে পুত্রবধূ এড়িয়ে যেতো। শাশুড়ি তাজ্জব হয়ে গেলো, হঠাৎ এ ব্যবহারে। এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পরে, শাশুড়ির বোধদয় হলো। সে ভাবলো, যারে এতো অপমান করি, সে আমারে বেশি যত্ন নেয়। নাহ! আর পুত্রবধূর সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। এভাবে শাশুড়ি-নিজ বউয়ের সদ্ব্যবহারের কাছে পরাজিত হলো। এ কৌশলটি মেয়ে তার বাবার কাছ থেকে নিয়েছিলো।
কেউ নারী নাকি পুরুষ, তার চেয়ে বড় কথা সে সৎ, আর্দশবান, ভালো কাজের প্রতি উৎসাহী ও জ্ঞানবান কি না। নারীর জীবন সুন্দর ও সার্থক করতে হলে তাকে যেমন সততা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে জীবন পরিচালনা করতে হয়, পুরুষকেও তেমনি। স্বামীর সংসারকে আগলে রেখে ওই পরিবারের মধ্যে শান্তিসুখ বাড়াতে নারীর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপন করে নেয়ার ব্যর্থতাই অনেক সমস্যার উদ্রেক ঘটায়।
অনেকই মনে করেন, একটি পরিবারকে সুন্দর রাখতে পুরুষের চাইতে নারীর ভূমিকাই মুখ্য। এমনকি বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে, রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘একজন স্ত্রী তার স্বামীর পরিজনবর্গের এবং তত্ত্বাবধানকারীণী।’ যেই স্ত্রী স্বামীকে মানসিক দিক দিয়ে প্রফুল্ল রাখতে পারে না। যে স্বামীর পরিবারের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিজের অঙ্গ সংস্থান ভেবে তার সুস্থতার জন্যে সার্বিক কাজ পরিচালনা করতে আন্তরিক থাকে না, তাহলে পরিবার চলার আশা রাখা যায় না।
আমাদের সমাজে অনেক পুত্রবধূ নিজের সুখ নিশ্চিত করতে যেয়ে শাশুড়িকে অভিশাপ ভেবে থাকে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। পুত্রবধূ শাশুড়িকে মায়ের আসনে আসীন করলে তার শাশুড়িও তাকে মেয়ের জায়গায় স্থান দিতে বাধ্য থাকবেন।
শিক্ষিত মূর্খ বা কম বুদ্ধিমতি স্ত্রী মায়ের তুল্য শাশুড়ি ও পিতৃতুল্য শ্বশুরের সাথে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক মাধুর্যপূর্ণ আচরণ প্রকাশ করে না। স্বামীর ছোট বোনকে নিজের বোন ভাবতে পারে না। সুন্দর ব্যবহার ও ভালোভাবে কথা বলতে পারে না। সে শুধু অশান্তির নরকই পয়দা করতে পারে।
নবীজী (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘তুমি দ্বীনদার নারী বিবাহ করো, অন্যথায় তুমি লাঞ্ছিত হবে’। [আবু দাউদ : ২০৪৭]।
একজন স্বামী তখনই নিজের স্ত্রীকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে, যখনই ওই স্ত্রী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় সচেষ্ট থাকে। ধন-সম্পদ, শিক্ষা, বংশ, রূপ-সৌন্দর্যের অহঙ্কার না করে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে বিনয়ী, উত্তম ব্যবহার, ভারসাম্যমূলক আচরণে গুরুত্বারোপ করা।
ইসলাম ভরণপোষণের দায়িত্ব পুরুষকে দিয়েছে নারীকে নয়, সংসার জীবনে নারী নির্ভরশীল স্বামী ও পুত্রের ওপর। পুত্রের মাধ্যমে সংসারের বৈষয়িক দিকটি রক্ষিত হয় বলেই মায়েরা পুত্রের উপর নির্ভর করে। শাশুড়িও মেয়ে জামাইকে স্বাভাবিকভাবেই আদর করে। তাই মেয়ের মায়ের উচিত হবে, আপন মেয়ে স্বামী বা তার পরিবার সম্পর্কে অসংলগ্ন আচরণ করলে তা সংশোধন করে দেয়া।
শাশুড়ি বৌমাকে মা রূপে বুকে তুলে নিবে। বৌমাও অজ্ঞতা-অনভিজ্ঞতা ও অপরিপক্কতার কারণে অসংঙ্গতি কিছু বলে বা করে বসবে না।
কেননা মায়ের মনে আঘাত দিলে প্রসববেদনা থেকে শুরু করে ছেলেকে প্রতিপালনের সব কষ্ট একসাথে তার মনে পড়ে যাবে।
পুত্র ও পুত্রবধূকে এমন আচরণ করতে হবে, যাতে মা বুঝে তার ছেলে তারই আছে ও থাকবে এবং বৌমাও তার যত্ন নেবে-সম্মান করবে।
স্ত্রীকে স্বামী, স্বামীর বাড়ি, স্বামীর আত্মীয়স্বজনদের নিজের ভাবতে হবে। স্বামীর বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করতে হবে। তাহলে সেবা করা যাবে এবং নিজেকে তখন দাসী মনে হবে না। বৌ যদি আপন হতে পারে, তবে অবশ্যই শাশুড়ি আদর করবে।
চলার পথে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই অনেক কষ্ট হলেও পাশে থেকে কষ্টের সান্তনা হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একে অন্যের কষ্ট দূর করতে না পারলে, অনুভব করতে পারা এবং কিছুটা লাঘব করায় সচেষ্ট থাকতে হবে। একজন পিছিয়ে পড়লে আরেকজন টেনে নিতে হবে। দুজনকেই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পরস্পরের অধিকার নষ্ট না হয়। মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি জুলুম, তদ্রূপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি জুলুম।
তাই পারস্পরিক আচরণ এমন হতে হবে যেনো, দাম্পত্যজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন আরেকজনকে উত্তম স্বামী বা স্ত্রী মনে করে।
নবীজী (সাঃ) বলেছেন, ‘যে স্ত্রী তার স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’। তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেসব লোকই উত্তম, যারা উত্তম তাদের স্ত্রীদের কাছে’।
দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্যে শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন। এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। শ্বশুর বাড়ির কোনো দোষ-ত্রুটি মা-বাবার কাছে না বলা বা শ্বশুরালয়ের কারো গীবত বাপের বাড়িতে না করা উচিত। এ থেকেই ক্রমান্বয়ে উভয় পক্ষের মন খারাপ হয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে সামনে ও পেছনে লোকের নিন্দা করে। [সূরা হুমাযা, ১০৪:১]ঃ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের ত্রুটি গোপন রাখবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)।
ছেলে-মেয়ে যেই হোক যতোদিন শ্বশুর-শাশুড়ি জীবিত থাকবে, তাদের সাথে কথা-বার্তা ও উঠা-বসায় আদব-সম্মান, সেবা-যত্নের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। ইসলাম কোথায়ও নৈতিকতাবিরোধী নয়, বরং ইসলামই মানুষকে নীতি-নৈতিকতা শিখায়।
আল্লাহ আমাদেরকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের মানসিকতা ও আখিরাতে জবাবদিহিতার ভয় করে, দুনিয়ার সকল জীবনযাপন করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : প্রভাষক, বদরপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।