![](https://irishbanglapost.com/wp-content/uploads/2020/08/srilonka-pm-1024x683.jpg)
আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ শ্রীলংকায় গত বুধবার ১৬তম বারের মত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে। এই নির্বাচনে শ্রীলংকা পিপলস ফ্রিডম এলায়েন্স (SLPFA) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার রাজাপাকসার এই দল শ্রীলংকা সংসদের মোট ২২৫টি আসনের মধ্যে ১৪৫ আসনে জয়লাভ করে বিরোধী দলকে উড়িয়ে দিয়েছে। পিপলস ফ্রিডম এলায়েনসের রাজনৈতিক মিত্রদের আরও ৫টি সদস্যের সমর্থনও তাদের সাথে আছে। এই নির্বাচনে শ্রীলংকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, গুপ্তঘাতকের দ্বারা নিহত রানাতুংগে প্রেমাদাসার সন্তান সাজিত প্রেমাদাসার নেতৃত্ত্বাধীন সামাগি জন বালাগাওয়া দল ৫৪টি পদে নির্বাচিত হয়ে প্রধান বিরোধী জোট হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়েছে। মূল বিরোধী দল রানিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড নেশনাল পার্টি মাত্র একটি পদে বিজয় অর্জন করতে পেরেছে, যদিও তারা পূর্ববর্তী নির্বাচনে ১০৬ টি পদে নির্বাচিত হয়েছিলো। শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সর্বমোট ১ কোটী ৬২ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ৭৫% ভোটার তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। এই নির্বাচন কোভিড মহামারির কারনে দুই দফা পিছানোর পর অবশেষে গত বুধবার বিশেষ ব্যাবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার রাজাপাকশা আর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশা দুই ভাই। আশা করা যায় ছোটভাই গোতাবায়া রাজাপাকশা বড়ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দ্রুত শপথ পাঠ করাবেন।রাজাপাকশা পরিবার শ্রীলংকার রাজনীতিতে বিগত দুই যুগ থেকেই প্রভাব বিস্তার করে আছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকশা ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্য্যন্ত শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ৯ মাস আগে গোতাবায়া রাজাপাকশা প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ের পর এখন তিনি তার দলকে বিপুল ভোটে সংসদে বিজয়ীর নেতৃত্ব দিলেন। �শ্রীলঙ্কা এশিয়ার প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক দেশ। ব্রিটিশ শাসনাধীন শ্রীলংকায় প্রথম ১৯৩১ সালে ডোনমোর কমিশন কর্তৃক প্রণীত সংবিধান দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার দেয়। ১৯৩১ সালের জুন মাসে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের অধীনে শিলং স্টেট কাউন্সিলের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, স্যার ডন ব্যারন জয়তিলাকা হাউসের নেতা হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে, নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করার জন্য সোলবারি কমিশন নিয়োগ করা হয়। এই সময়ে, ডি এস সেনানায়াকের নেতৃত্বে “সংবিধানবাদী” ধারায় স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। সোলবারি কমিশন প্রদত্ত খসড়া সংবিধান একই বছর গৃহীত হলে, ১৯৪৭ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সেনানায়েক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন । সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে সিলোন (বর্তমান শ্রীলংকা) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হন সলোমন বন্দরনায়েকে, তিনি সিংহলীকে দেশের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার বিল আনলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠে এবং ১৯৫৯ সালে আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। ১৯৬০ সালে সলোমন বন্দরনায়েকের স্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে, বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। শ্রিমাভো বন্দরনায়েকে সিলোন রাজ্যকে শ্রীলংকা প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেন। তিনি ৩ বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তার দীর্ঘ শাসনকালে দেশকে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানোর উদ্যোগ নেন, তার শাসনামলেই তামিল টাইগার্সের সশস্ত্র সংগ্রাম সৃষ্টি হয়ে ১৯৭৫ সালে জাফনার মেয়রকে হত্যার মাধ্যমে গভীর সংকট সৃষ্টি হয়। ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় মেয়াদের পর তিনি নির্বাচনে পরাজিত হন আর ক্ষমতায় আসেন জুনিয়াস রিচার্ড জয়বর্ধনে, যিনি ১৯৭৮ সাল পর্য্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় থাকেন, তার সময়েই প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রবর্তন হয় এবং ১৯৭৮-৮৯ তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শ্রীলংকার ইতিহাসে তার সময়কাল ছিল দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিদ্রোহে পরিপূর্ণ। তার সময়েই শ্রীলংকা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, হাজার হাজার তামিলকে হত্যা করা হয়। ভারত তামিল টাইগারদের অস্ত্র সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখে পরবর্তীতে তিনি ভারতের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করে ভারতের সেনাকে শ্রীলংকায় প্রবেশের সুযোগ করে দেন।এর পর একে একে প্রধানমন্ত্রী হন রানাতুংগে প্রেমাদাসা, ডিনগিরি বিজয়তুংগা, রানিল বিক্রমসিংহ, চন্দ্রিকা কুমারাতুংগা, শ্রিমাভো বন্দরনায়েকে তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৯৪ সালে, এর পরে স্বল্পমেয়াদী কয়েকজন দায়িত্ব নিলেও সময় ছিল খুব কঠিন, ২০০৪ সালে প্রথম এই মাহিন্দর রাজাপাকশা প্রধানমন্ত্রী হন, সেই সময় তার মেয়াদ ছিল এক বছর, এর পর আসেন ২০১৮ সালে কয়েকমাসের জন্য তারপর ফিরে আসেন এই পদে ২০১৯ সালে এবং ২০২০ সালে পুনরায় নির্বাচিত হলেন। ইতিমধ্যে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্য্যন্ত তিনি এই দেশের প্রেসিডেন্ট ও ছিলেন। ২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের কয়েক দশকের পুরনো সংঘাতের অবসান ঘটাতে নেতৃত্ব দিয়ে মাহিন্দর রাজাপাকশার ভাই, গোতাবায়া রাজাপাকশা সিংহলীদের বিপুল সমর্থন অর্জন করেন, সেই সময়ে তিনি প্রতিরক্ষা সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অনেকেই মনে করেন গোতাবায়া দেশে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন আর সেই সাথে কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণেও তাকে সফল মনে করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে কোভিড-১৯ মহামারীতে এই দেশটিতে মৃত্যুবরন করেছেন ১১জন আর আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ২৮৩৯ জন। �শ্রীলঙ্কার বিরোধী দল সরকারকে দুর্নীতি, সেন্সরশিপ এবং ভয় ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেছে। বিরোধী শিবিরের বিপুল সমালোচনা সত্ত্বেও মানুষ শাসক দলের পক্ষে গেছে। মাহিন্দা রাজাপাকসাকে মূলত এক মেয়াদ আগেই ভোটের মাধ্যমে জনগণ ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলো। পরবর্তী সরকার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও তারা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়। তারা কিছু সংবিধানিক সংস্কার করলেও শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রত্যাশা পুরনে ব্যার্থ হলে দেশের মানুষ আবার রাজাপাকশাকেই ফিরিয়ে আনে। রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসের করোনভাইরাস সঙ্কটের সফল সামাল দেওয়ার ফলে জনগণের আস্থা শক্তিশালী হয়েছে, একই সাথে গত বছর ইস্টার বোমা হামলার পরে বিগত সরকারের ব্যর্থতাও গোতাবায়ার জন্য ইতিবাচক হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর শক্তি কমিয়ে রাষ্ট্রপতির শক্তি বৃদ্ধি করার মত কোন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হলে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। শ্রীলংকার রাজনীতি দীর্ঘদিন সংঘাতে পরিপূর্ন থেকে বিগত দুই দশকে কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। এই মুহূর্তে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মাহিন্দর আর সফল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এই দুই ভাইয়ের ক্ষমতার ভাগাভাগি আর সেই সাথে ১৪৫ সদস্যের বিপুল শক্তি এই রাজনৈতিক বলয়ে শ্রীলংকাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটা দেখার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষায় থাকতে হবে।