ঈদ মুবারক

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার, সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ ঈদ মুবারক ২০২৪  ঈদ মুবারক! ঈদ মুবারক! বিশ্বের সকল মানুষের জন্য ঈদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন!  এবারের ঈদ, আমাদের সকলের জন্য আনন্দে পরিপূর্ণ হোক। বছরের আগামী দিনগুলো সুন্দর হোক, সফল হোক, সার্থক হোক এই আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা।

পূর্নাংগ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আমাদের সামনে এসেছে এই পবিত্র ঈদ। এই এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যা অর্জন করতে চাই, তা হচ্ছে “তাকওয়া”। সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া (খোদাভীতি) অর্জন করতে পারো।“তাকওয়ার” শাব্দিক অর্থ হতে পারে সহনশীলতা, ভয়, নিবৃত্তি। তাকওয়ার ব্যাখ্যা পণ্ডিতগণ বিভিন্নভাবে করেছেন, কেউ বলেছেন আল্লাহর প্রতি ভয়, কেউ বলেছেন ধার্মিকতা, কেউ বলেছেন স্রস্টা সম্পর্কে সচেতনতা। তাফসীর ইবনে কাসীরের মতে, তাকওয়ার মূল অর্থ হল “যা অপছন্দ তা এড়িয়ে চলা”। বর্ণিত হয়েছে যে, উমর ইবনে খাত্তাব উবাই ইবনে কাবকে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উবাই বললেন, “তুমি কি কখনো এমন পথে হেঁটেছ যে পথে কাঁটা আছে?” উমর বললেন, “হ্যাঁ”। উবাই জিজ্ঞেস করলেন, “তখন তুমি কি করলে?” যার উত্তরে উমর (রাঃ) বললেন, “আমি আমার হাতা এবং কাপড় গুটিয়ে নিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে কাঁটাযুক্ত বন পার হওয়ার সংগ্রাম করেছি।” উবাই বলেন, “তাকওয়া হল, জীবনের বিপজ্জনক যাত্রার মাধ্যমে নিজেকে পাপ থেকে রক্ষা করা, যাতে কেউ পাপ থেকে অক্ষত যাত্রা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে।“ এখন ভেবে দেখুন, এবারের এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যারা তাকওয়া অর্জন করেছেন এবং সেই তাকওয়াকে বিকশিত করেছেন, তিনিই সফল হয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শুধু ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ অর্থাৎ নামাজ, রোজা, হজ্ব, জাকাত এবং ইমান এই পাঁচটি অত্যাবশ্যক কাজ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে তাকওয়া বিকশিত হতে পারে কিন্তু সেই বিকাশ আমাদের জন্য সফলতা নাও দিতে পারে। অত্যাবশ্যক আরও কিছু আদেশ নিষেধ সর্বাবস্থায় পালন করাও এর অন্তর্গত যেমন, “ভালো ব্যবহার” , “সত্য ভাষণ”, “ওয়াদা সুরক্ষা”, “আমানত সুরক্ষিত রাখা”,  “গিবত না করা”, “অন্য মানুষ সম্পর্কে ধারনা পোষণ না করা”, “হক (ন্যায়) প্রতিষ্ঠা”, “ধৈর্য্য ধারণ”, “ভালো উপার্জন ও সঠিক পথে ব্যয়” ইত্যাদি গুনাবলী তাকওয়ার পূর্বশর্ত। এখন ভেবে দেখুন, যারা এই সকল গুণাগুণ বিকশিত করে পাঁচটি আচারকে সম্পুর্ন করেছেন তারাই সফল।

পাঠকবৃন্দ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এসব আমাদের জীবনের নিত্য অনুষংগ। এই মুহুর্তে ঈদের আনন্দের অনুভূতিগুলো ছাপিয়ে বেদনার রঙ আমাদের আকাশে অনেক শক্তিশালী। আমরা জানি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম জনগোষ্ঠী আজ নির্য্যাতন আর নিপীড়নের শিকার। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের গাজায় যে ভয়াবহ মানবতার হনন চলছে, তা আমাদের জন্য বিষাদের। আমরা এই সময়ে কি করতে পারি? অনেকেই মনে করেন, “প্রার্থনাই একমাত্র অবলম্বন”, কেউ প্রার্থনার সাথে “অর্থ সাহায্যকে” প্রাধান্য দিয়েছেন। আমি এই ব্যাপার নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছি, আমি মনে করি মুসলিম হিসাবে প্রথমে যে কাজটি আমাদের প্রয়োজন সেটা হচ্ছে “অনুভব”, “অনুভূতি”। আমাদের মধ্যে “সহানুভূতি” সৃষ্টি করাটাই প্রধান কাজ। দ্বিতীয়তঃ আমাদের প্রয়োজন বৃহত্তর ঐক্য এবং দুরদর্শী নেতৃত্ব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিশ্ব মুসলিম শতধা ভাগে বিভক্ত এবং আমাদের মধ্যে দূরদর্শীতা নেই আর নেতৃত্বও নেই।  এমতাবস্থায় এই দুর্যোগ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করিনা। তবুও মন্দের ভালো, অসহায়ের সর্বশেষ সম্বল, প্রতিটি মসজিদে এবং ঘরে ঘরে প্রার্থনা অব্যাহত আছে আর অর্থ সাহায্যও চলছে। আজকের এই ঈদের দিনে আমাদের মনে তাদের প্রতি সহানুভূতি রেখেই এই ঈদ আমাদের পালন করতে হবে।

আমাদের শৈশবে এই ঈদের দিনে আমরা যাকেই পেতাম তাকেই ঈদ মুবারক বলে জড়িয়ে ধরে কুলাকুলি করতাম। বাংলাদেশ নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলিম, তাই সারা দেশটা যে, ঐদিনে অন্য রঙ ধারন করতো তাতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। ভোরে উঠে গোসল সেরে ফজরের নামাজ পড়ে ঈদের নতুন জামা কাপড় পরে নাস্তা খেতে হতো, সেই নাস্তায় ঘরে বানানো পরোটা আর সেমাই ছিল মূল আকর্ষন। তারপর সবাই মিলে ঈদের নামাজে যাওয়া হতো ঈদগাহে। নামাজ পড়ে আমরা যেতাম কবর জিয়ারতে তারপর বাসায় ফিরেই দেখা যেতো আত্নীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব সবাই আসছেন, চলছে খাওয়া দাওয়া। এরপর আমরাও দলে দলে ঘরে ঘরে যেতাম আর বিভিন্ন ধরনের খাওয়া দাওয়া আর কুশল বিনিময় হতো।  

ঈদের আগেই নতুন কাপড়ের যোগাড় যন্ত্র শুরু হয়ে যেত। একটা সময় ছিল যখন থানের কাপড় কিনে আনা হতো, আর আমাদের আম্মা নিজেই কাঁচি দিয়ে কেটে আমাদের জন্য পায়জামা সেলাই করতেন। আমরা ভাই বোনরা আম্মার পাশে ঘুরা ফিরা করতাম কখনোবা সেলাই মেশিনের হ্যান্ডেল চালাতে সাহায্য করতাম। এটা ছিল মধ্যবিত্তের ঈদ, প্রাথমিক জীবনে আমাদের আব্বা সরকারি চাকুরীজীবী ছিলেন বিধায় আমরা ঘুরেছি বিভিন্ন জেলায়, সব স্থানেই আমরা ঈদ করেছি সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মেলায়। তাই নিম্নবিত্তের ঈদ অনুধাবনের সুযোগ আমাদের ছিলোনা। ১৯৬৬ কিংবা ৬৭ সালের কথা, সেই বছর আমরা ঈদ করেছিলাম দুইবার তাই সেই ঈদ আমাদের জন্য এখনো স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সেই সময়ে পুর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন মোনেম খান। সেইবার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এই দেশের আকাশে কোথাও ঈদের চাঁদ দেখতে পেলোনা, আমরাও দেখিনি কিন্তু সরকারী হেলাল কমিটি প্লেনে করে আকাশে চাঁদের দেখা পেয়ে গেলো। জনগণ সরকারের ভাষ্য বিশ্বাস করতে পারলোনা আর সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটুট রইলো। আমরা তখন ময়মনসিংহ শহরে, মোনেম খানের জেলা, আর আব্বার সরকারী দায়িত্ব পড়লো গভর্নরের সঙ্গে, তাই আব্বা ঈদের জামাত পড়তে গভর্নরের সঙ্গী হলেন, আমাদের ও সঙ্গে নিলেন। যতটুকু মনে পড়ে ঈদগাহে মূলত সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ছিলেন। জনগণ ছিলেন কি না আমি এখন মনে করতে পারছিনা। গভর্নরের সাথে ঈদের নামাজ শেষে বাসায় এসে কাপড় চোপড় খুলে রেখে দিলাম আগামী দিন জনগণের ঈদ করার জন্য। তাই আমাদের আসল ঈদ হলো পরের দিন, আবার ঈদের নামাজ হলো, সঠিক ঈদ উদযাপিত হলো। জনবিচ্ছিন্ন সরকার থাকলে এটাই হয়, সরকার জনগণের মন দেখতে চায়না, তারা তাদের মন দেখে, এটাই স্বৈরাচারের প্রবৃত্তি।

আরেকটি স্মরণীয় ঈদের কথা বলি, সেটা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছর।  ১৯৭১ সাল, ঈদুল ফিতর ছিল নভেম্বর মাসে। মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো, আমরা তখন রাঙামাটিতে। সারাটি রমজান মাস জুড়ে মসজিদে আমরা দুয়ায়ে ইউনুস খতম পড়লাম, এক লক্ষ বিশ হাজার বার। বিপদ থেকে রক্ষার দোয়া। “লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইনি কুনতু মিনাযযোয়ালিমিন” অর্থাৎ ‘তুমি ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই; তুমি পুতঃপবিত্র, নিশ্চয় আমি জালিমদের দলভুক্ত।“ সেবারও আমরা ঈদ করলাম, সরকারি দায়িত্ব পালনের ঈদ। মনে বেদনা নিয়ে, সেই সময় আমরা দোজখের আগুনে জ্বলছিলাম। কার জীবন কখন চলে যায় কেউ জানতোনা।  দেশে যারা ছিল তাদের জীবন ছিল কন্টকাকীর্ন, কখন যে, পাকিস্তানীরা কাকে ধরে নিয়ে যায় তাঁর কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। আমাদের আব্বার উপর সরকারী খড়গ ঝুলেছিলো। একদিন শুনলাম সামরিক বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন আব্বাকে শাসিয়ে গিয়েছে, পাহাড়ে অপারেশনে যাচ্ছে, ফিরে এসে আব্বাকে দেখে নেবে। পাহাড় থেকে সেই ক্যাপ্টেন আর জীবিত ফিরে না আসায় সেই যাত্রায় আব্বা বেঁচে গিয়েছিলেন। এধরনের ভয়-ভীতির মধ্যে সেবারের ঈদ আমাদের জন্য স্মরণীয় হয়েছিলো।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আব্বা স্বেচ্ছায় সময়ের পূর্বে অবসরের দরখাস্ত করে সিলেট চলে আসলে, আমাদের নূতন জীবন শুরু হয়। এই সময় আমরা সকল শ্রেণীর ঈদ দেখতে পাই। ১৯৭৪ সালে আমরা তীব্র খাদ্যাভাবের মধ্যে ঈদ পালন করেছিলাম। সারা দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিলো। ঈদুল ফিতর ছিল অক্টোবর মাসে, সেই বছর ঈদে আমাদের নতুন জামা কাপড় হয় নি। ঈদের দিন খাবার নিয়ে আমরা এতিম খানায় বিতরণ করেছিলাম। খাদ্যের অভাবে কিভাবে জনগণ কচু শাক খেয়ে বেচেছিল সেই দৃশ্য এখনো আমাদের মানসপটে বিদ্যমান। পরিবর্তিত সময়ের আলোকে প্রতি বছরই ঈদ আমাদের কাছে এসেছে নতুন আঙ্গিকে, নতুন প্রেরণার সংবাদ নিয়ে।

আমাদের আব্বা আইনিজীবির জীবন শুরু করলে ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন হতে থাকে। আব্বা সামাজিক এবং ধর্মীয় কাজে নিজেকে জড়িত করার কারণে আমাদের ঈদের উৎসব ব্যাস্ততায় পরিপূর্ন হয়ে উঠে। আত্নীয় স্বজনের আধিক্য আর সেই সাথে সামাজিক আর ধর্মীয় সংগঠনের কর্মী আর বন্ধু বান্ধবদের ঘনঘটায় আমাদের ঈদের উৎসবে নান্দনিকতা আসে। এই সময়ে আমাদের ঈদ ছিল অতিথি সেবা। ঈদের জামাতের পর বাসায় আসতে যেমন সময় লাগতো, ঠিক তেমনি বাসায় আসার পড় আব্বার অতিথিদের সেবা করতেই আমাদের দিন চলে যেত। এই সময়ে আমরা আব্বার ড্রাইভার ও ছিলাম। এই সময় আমরা নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের ঈদ যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি দ্বান্দিক ঈদ। ঐ সময় আমরা ঈদ নিয়ে বিতর্ক দেখেছি, চাঁদ দেখা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখেছি। এই বিবর্তন আমাদের সমাজে চলমান ছিল আজো তা অব্যাহত আছে।

এক সময়ে চাকুরীর সুবাদে আমরা সৌদি আরব নিবাসী হয়ে গেলাম। সৌদি আরবে রমজান আর ঈদের সংস্কৃতি পুরোটাই ভিন্ন। পুরো রমজান মাসে মানুষ সারা রাত জেগে থাকে, বাজার হাঁট সারা রাত খোলা থাকে। মানুষ সেহরি খেয়ে ঘুমোতে যায়, অফিস আদালত শুরু হয় রাতে। ঈদের আগের কয়েকদিন বাজার হাঁট জম জমাট। ঈদের জামাত হয় ঈদগাহে, নামাজের পর কুলাকুলি, বুকে বুক মিলিয়ে নয়, গালে গাল মিলিয়ে। আমাদের মত ঈদ মুবারক বলে নয়, ওরা বলে তাক্কাব্বালুল্লাহু মিনা ওয়া মিনকুম! (আল্লাহ তোমাদের ও আমাদের কবুল করুন) আর বলবে, “কুল্লু আম আনতুম বিখায়ের”, সকল বছর ধরে আপনারা ভালো থাকুন। তাদের খাওয়া দাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। সেই আলোচনায় এখন নাই বা গেলাম।

পাঠকবৃন্দ, আমাদের নবী মোহাম্মদ (সাঃ আঃ) হিজরতের পর দেখলেন মদীনাবাসীরা শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মিহিরজান নামে দু’টি উৎসব পালন করছে। উৎসব দু’টি প্রথমে ৬ দিন ব্যাপী এবং পরবর্তীতে ৩০ দিন ব্যাপী পালন করা হতো। নওরোজ ছিল নববর্ষ বরণের উৎসব। মিহিরজান ছিল পারসিকদের অনুকরণে আনন্দ উৎসব। জাহেলী ভাবধারা, স্বভাব, প্রকৃতি ও ঐতিহ্যানুযায়ী এ দু’টি উৎসব উদযাপিত হতো। অশালীন আনন্দ-উল্লাস, কুরুচিপূর্ণ রঙ-তামাসা ও হৈ-হুল্লোড় হতো এসব অনুষ্ঠানে। সমাজের বিত্তশালীরা নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে এ উৎসব পালন করতো। নারী-পুরুষের অবাধ মিলনকেন্দ্র ছিল এসব উৎসব। রাসূলুল্লাহ এসব আনুষ্ঠানিকতা দেখে দারুণভাবে ব্যথিত হন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মদীনাবাসীদেরকে এসব অশালীন অন্তঃসারশূন্য ও লক্ষ্যহীন উৎসব পালন করা থেকে বিরত থাকার আহবান জানান। এর পরিবর্তে তিনি স্বমহিমা ও নির্মল আনন্দে ভাস্বর পবিত্র স্পর্শমণ্ডিত বহুবিধ কল্যাণধর্মী ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামে দু’টি উৎসব পালনের জন্য নির্ধারণ করে দেন। সেদিন থেকে ইসলাম পরিপন্থী নওরোজ ও মিহিরজান উৎসব চিরতরে বন্ধ করা হয় এবং তদস্থলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উৎসবের প্রচলন করা হয়।

এ সম্পর্কে হাদীস শরীফের ভাষ্য হলো, “আনাস (রাঃ আঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবী করীম (সাঃ আঃ) যখন মদীনায় উপস্থিত হলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন মদীনাবাসীরা দু’টি জাতীয় উৎসব পালন করছে। আর এ উপলক্ষে তারা খেল-তামাসার আনন্দ-অনুষ্ঠান করছে। নবী করীম সাঃ আঃ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এই যে দু’টি দিন উৎসব পালন কর, এর মৌলিকত্ব ও তাৎপর্য কি? তারা প্রতি উত্তরে তারা বললো, আমরা এ উৎসব এমনি হাসি-খেলা ও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেই উদযাপন করে আসছি, এখন পর্যন্ত তাই চলে আসছে। এ কথা শুনে নবী করীম সাঃ আঃ বললেন, আল্লাহ তা‘লা তোমাদের এ দু’টি উৎসব দিনের পরিবর্তে তদপেক্ষা অধিক উত্তম দু’টি দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দান করেছেন। অতএব পূর্বের উৎসব বন্ধ করে এ দু’টি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করতে শুরু কর।” (আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)

নওরোজ-মিহিরজান আর আমাদের দুই ঈদের মধ্যে মূল যে পার্থক্য তা হলো- ওদের অনুষ্ঠান দু’টি ছিল অশ্লীলতায় ভরপুর আর ধনিক শ্রেণির জন্য পালনীয়। অপর দিকে আমাদের ঈদ হলো অশ্লীলতামুক্ত এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান মুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, পৃথিবীর আর কোন ধর্মে কিংবা জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকে এমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবে অপেক্ষাকৃত ধনিক ও বণিক শ্রেণির মানুষের মনোরঞ্জনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আর এই সব সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিত্তশালীরা আরও বিত্তবান হয়।  গরীবেরা হয় আরও গরীব। গরীবেরা ধনীদের মনোরঞ্জন আর পুঁজি বৃদ্ধির অনুষঙ্গ হয় মাত্র।

অথচ ঈদ উৎসব গরীবদের সাথে নিয়ে পালন করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বেই তাদের পাওনা তথা ফিতরা আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর ঈদুল আযহায় তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেয়া হয় ধনীদের পক্ষ থেকে। বলা যায়- ঝর্ণা যেমন পাহাড়ের উচ্চতা থেকে নেমে অপেক্ষাকৃত নীচু ও সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে; ঠিক তেমনি ঈদের মাধ্যমে বিত্তবানদের নিকট থেকে অর্থসম্পদ গরীব মিসকিনদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রশমিত হয় ও ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হয়। যার প্রদর্শন আমরা দেখেছি খোলাফায়ে রাশেদার ৩২ বছরের শাসনামলে। সেখানে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, যাকাত নেয়ার মত উপযুক্ত কোন গরীব মিসকীনকে খুঁজে পাওয়া যেত না। এ হলো ইসলামী সংস্কৃতির সোনালী ইতিহাস। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, রাসুল সাঃ আঃ এর সেই অশ্লীলতামুক্ত ও ধনী-দরিদ্রের সেতুবন্ধনের ঈদ কি আমাদের সমাজে আছে?

ইসলাম স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে কখনো বাতিল করেনি। যা শুভ, কল্যাণ ও মঙ্গলময়, ইসলাম সেসবকে আদর ও সোহাগ ভরে ধারণ করেছে। ইসলাম শুধু দেখেছে, বিষয়টি আল্লাহর একত্বের সাথে সাংঘর্ষিক কি না এবং ধর্মে নতুন কোন প্রথা প্রচলন করা হচ্ছে কি না। এসব না থাকলে এবং বিজাতীয় অশ্লিল, নোংরা ও কুৎসিত বিষয় না থাকলে ইসলাম মানুষের স্বচ্ছ, সুন্দর এবং স্বাভাবিক প্রবণতার পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম, স্বাভাবিক ধর্ম। সে কারণে বাঙালির উৎসব প্রবণতার পক্ষে ইসলাম বাধা সৃষ্টি করেনি। আবহমান কাল ধরে বাঙালিরা উৎসবপ্রবণ, প্রাণবন্ত। উচ্ছল এবং উজ্জ্বল আনন্দ তাদের জীবনের উৎস। সুখ ও শান্তি তাদের নিত্যসঙ্গী। সে কারণেই আমাদের কাছে ঈদ এতো আনন্দের এবং এতো উৎসবের। তাই বলে অশ্লীল আর নিষিদ্ধ পথে তো পা বাড়ানো যায় না। কেননা, প্রত্যেকটি জাতি-গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা আচার অনুষ্ঠান সে জাতির পরিচায়ক। এটা বলাই যেতে পারে দূর্গাপূজা দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় কে চেনা যায়, বড়দিন দিয়ে খৃস্টানদের চেনা যায়, মাঘিপূর্ণিমার মাধ্যমে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে চেনা যায়। এমনিভাবে ঈদ দিয়ে মুসলিমদের চেনা যায়। সুতরাং ঈদ উৎসব পালনে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার।

SHARE THIS ARTICLE