আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ আজ পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের সময় প্রাকৃতিক কারণেই বিশ্বজুড়ে বসন্তকাল বিরাজ করে। বিশ্বব্যাপী এবার ও গত বছর শ্রমিক দিবস হয়েছে করোনাকালে। ফলে বিপ্লবের তপ্ত ইতিহাস, বসন্তের হিন্দোল নয়, শ্রমজীবী মানুষের সামনে ছিল করোনার আগ্রাসনের কারণে বিপন্ন জীবন আর জীবিকার প্রসঙ্গ।
করোনার তীব্রতার কারণে লকডাউন, কারফিউ ও অন্যবিধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় প্রথম ও প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্রমিক শ্রেণি। তাদের চাকরি চলে যায়। তারা অকাতরে কর্মচ্যুত হন। বিশেষত, প্রবাসী বা অভিবাসী লক্ষ লক্ষ শ্রমশক্তি দেশে-বিদেশে, পথে-প্রান্তরে আটকে পড়েন। করোনার দুটি বছর অবর্ণনীয় কষ্ট আর সীমাহীন আর্থিক বিপদের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিয়েছেন শ্রমিক শ্রেণি।
ইউরোপ, আমেরিকায় করোনার ফলে মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের বিপদ হয়েছে বেশি। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ, ইউরোপ, আফ্রিকায় সর্বাপেক্ষা বিপদগ্রস্ত হয়েছেন কর্মী ও শ্রমিকরা। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে এই সমস্যা রয়েছে তীব্রতর। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসূত্রে অবস্থান করেন। তারা চাকরি হারিয়েছেন। ভিসা বা বিমান চলাচল সমস্যায় আটকে গিয়ে সব হারিয়েছেন।
দেশের মধ্যেও এক রাজ্য বা এক স্থান থেকে কর্মহীন হয়ে শ্রমিকরা লকডাউনের চলাচল করেছেন। করোনায় মারা গেছেন বা করোনা ছড়িয়েছেন। ভারতে মাইগ্রেট শ্রমিকদের সমস্যা ভয়ঙ্করতম আকারে দেখা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভারতে প্রবল করোনা বিস্তারের পেছনে সরকারের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও শ্রমনীতিকে দায়ী করেছে। বলেছে, ভারত সরকারের করোনার মধ্যে নির্বাচনী উৎসবে মেতেছিল। হিন্দু ধর্মের কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ করেছে। শ্রমজীবী মানুষকে আগাম না জানিয়ে গত বছর,অকস্মাৎ লকডাউন দিয়েছে। ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পায়ে হেঁটে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যের বাড়িতে যেতে বাধ্য হয়েছে। এতে পথে পথে বহুজন যেমন মারা গেছে, তেমনি তাদের মাধ্যমে গোচরে-অগোচরে করোনা ছড়িয়েছে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা লকডাউন তুলে দেওয়ার দাবিতে রাস্তায় সভা-সমাবেশ করেছেন। নিম্ন আয়ের কর্মজীবী, শ্রমজীবী, দিনমজুর শ্রেণির মানুষ করোনার কারণে সীমাহীন দুর্ভোগে পতিত হয়েছেন।
ফলে চলমান করোনা পেন্ডেমিকের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে ইতিহাসের পুনরুচ্চারণ ও স্মৃতি তর্পণের বদলে বর্তমান বিপদ উত্তরণের বিষয় সর্বাধিক মনোযোগী হতে হবে। বিপন্ন মানুষকে একদিকে যেমন মহামারির কবল থেকে তাদের জীবন বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে তেমনিভাবে তাদের আহারের সংস্থান করে জীবিকাকেও রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ, একই সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকার সমস্যা সমাধানের বিষয়টিই করোনাকালের পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মূল দাবি।
ফলে মে দিবসে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা শ্রমিক দিবস হিসেবেও পালিত হওয়ার সময় অতীতের অর্জনের দিকে তাকানোর পাশাপাশি বর্তমানোর চলমান বিপদকে দূর করার বিষয়গুলোও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এই দিনটিতে পৃথিবী জুড়ে শ্রমিকদের অবদান এবং ঐতিহাসিক শ্রমিক আন্দোলনের কথা স্মরণের সময় আজকের করোনাকালে তাদের বিপন্ন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিষয়টিও মনে রাখা জরুরি।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগোয় হে মার্কেটের ঘটনায় মে দিবসের উৎপত্তির পর শতবর্ষ পেরিয়ে দেড়শতবর্ষ হতে চলেছে। সেদিন শ্রমিকদের সমর্থনে শান্তি মিছিলটি এক পর্যায়ে দাবি আদায়ের প্রশ্নে অদম্য ও হিংস্র চেহারা নেয়, যার জেরে ৪ জন সাধারণ মানুষ ও ৭ জন পুলিশ আধিকারিক মারা যান। বিক্ষোভকারীরা শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন, কাজের সময় বৃদ্ধি, খারাপ ধরনের কাজের পরিবেশ, কম মজুরি ও শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন। এদের গ্রেফতার করা হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ডও, যারা মারা গিয়েছিলেন, তারা হে মার্কেট শহিদ হিসেবে পরিচিত।
এই ঘটনা শ্রমিক আন্দোলনে ব্যাপক শক্তি জুগিয়েছিল বলেই মনে করা হয়ে থাকে। যার প্রভাব ছিল বিশ্বব্যাপী ও সুদূরপ্রসারী। যেমন, আমেরিকা ১৮৯৪ সাল থেকে শ্রমিক দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে, তারা প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। কানাডাও দ্রুত সে পথে হাঁটে। ১৮৮৯ সালে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়ে সোশালিস্ট ও লেবার পার্টি মিলে ১ মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দীর্ঘ কয়েক বছরের বিক্ষোভ ও অভ্যুত্থানের পর ১৯১৬ সালে আমেরিকা ৮ ঘন্টা কাজের দাবি মেনে নেয়। ১৯০৪ সালে আমস্টারডামে আন্তর্জাতিক সোশালিস্ট কংগ্রেস থেকে সব দেশের সমস্ত সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে মে মাসের প্রথম দিনটিতে বড় সংস্থায় ৮ ঘন্টা কাজের দাবি, প্রোলেতারিয়েতের শ্রেণি চাহিদা এবং বিশ্বশান্তির দাবিতে প্রখর সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয় এবং বলা হয়, সব দেশের সমস্ত প্রোলেতারিয় সংগঠন ১ মে শ্রমিকদের ক্ষতি না-করে কাজ করা থেকে বিরত থাকে।
১৯১৭ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের পরে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইস্টার্ন ব্লক এই উদযাপনকে সাদরে গ্রহণ করা হয় – এই দেশগুলিতে ১ মে হয়ে ওঠে জাতীয় ছুটির দিন। এই উদযাপনের অন্যতম অঙ্গ ছিল কুচকাওয়াজ, মস্কোর রেড স্কোয়ারে এই দিনের কুচকাওয়াজে উপস্থিত থাকতেন শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতারা, প্রদর্শিত হত সোভিয়েত মিলিটারি শক্তি।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালের ১ মে। হিন্দুস্তান শ্রমিক-কিষাণ পার্টি এবং কমরেড সিঙ্গারাভেলার (সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার) উদযাপনের আয়োজক ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের ত্রিপলিকেন সৈকত এবং মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিপরীতে অবস্থিত সৈকতের দুটি সমাবেশে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির আত্মসম্মান আন্দোলন এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণির আন্দোলনের যোদ্ধা এই নেতা একটি প্রস্তাব পাশ করেন, যে প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারকে শ্রমিক দিবসের দিনটিকে সকলের জন্য ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। তারপর মে দিবস ক্রমশ সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
মে দিবসের উৎপত্তির পর শতাধিক বছরের সুদীর্ঘ সময়কালে শ্রমিক সমাজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণটি অধরাই রয়ে গেছে। শ্রমজীবীর স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে কিংবা পূরণে ব্যর্থতা দেখিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতন ঘটেছে। বিশ্বায়ন ও বাজার পুঁজির একচ্ছত্রবাদী দাপটে শ্রমিক পরিণত হয়েছে আধুনিক দাসে। কর্পোরেটদের হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে যাবতীয় সম্পদ ও মুনাফা। সেইসব কর্পোরেটদের গোত্রীয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বেলেল্লাপনা, বিকৃতি ও বেসামাল কাজ-কারবারের কারণে শুধু শ্রমজীবী শ্রেণিই নয়, মানবিক মূল্যবোধ, নারী অধিকার ও শোভনীয় সকল কিছুরই মৃত্যুঘণ্টা বাজছে।
এহেন অশনি সঙ্কেতের ধ্বনিপুঞ্জ যখন বিশ্বময় চরম অবনতিশীল পরিস্থিতির বার্তা বহন করছে, তখনই হানা দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনা। যার আঘাতে বিশ্বময় শুরু হয়েছে মারণযজ্ঞ। আর এতে সবার আগে আক্রান্ত হয়েছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকা। করোনার ফলে ঘোরতম সঙ্কুল জীবন ও অনিশ্চিত জীবিকার মধ্য দিয়ে চলছে গরিব, দুখি, শ্রমিক শ্রেণির প্রাত্যহিক-দৈনন্দিন দিনকাল।
এবারের মে দিবসে নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতার নামে শ্রমিক বন্দনা ও স্তুতিবাদের মুখস্ত ও লোক দেখানো উচ্চারণের বদলে করোনার ঘোরতর আঘাতে শ্রমিক শ্রেণির বিপদাক্রান্ত জীবন ও জীবিকার কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাই সমীচীন। এতেই শ্রমের প্রকৃত মূল্য এবং শ্রমিকের যথার্থ মর্যাদা সুনিশ্চিত হবে এবং বৈশ্বিক মহামারির প্রবল প্রকোপ থেকে শ্রমজীবী শ্রেণি বাঁচার পথ খুঁজে পাবে।