চেতনার ফাঁদে‌ বিজ‌য়ের উনপঞ্চাশ বছর

এস এ রবঃ গত ১৬ই ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দিন। বাঙালী জাতির জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিন। এই দিনে পৃথিবীর বুকে ফুটে উঠেছিল নূতন মানচিত্র। এই দিন‌টি‌কে ঘিরে র‌য়ে‌ছে এক‌টি লড়াকু জা‌তির হা‌সি এবং কান্নার গল্প। স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ সংগ্রামদীপ্ত কণ্টকাকীর্ণ র‌ক্তের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার উনপঞ্চাশ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য, চেতনা এবং এর দখল নিয়ে দেশে চল‌ছে নানা বিতর্ক। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে প্রবাসী সরকারের ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল এর লক্ষ্য হচ্ছে ৩টি। ঘোষণাপত্রে উ‌ল্লেখ ছি‌লো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার বা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাই হবে মু‌ক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও এই লক্ষ্য গুলোর ধারে কাছেও কি মানুষ পৌছাতে পেরেছে গত উনপঞ্চাশ বছরে? দে‌শের মানু‌ষের জান-মাল-ইজ্জতের কি মু‌ক্তি মিলে‌ছে স্বাধীনতা পরবর্তী এই দীর্ঘ বছরগু‌লো‌তে? এই প্রশ্ন আজ সকলের সামনে।

গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন সরকার মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে প্রকৃত অ‌র্থে গণতন্ত্রের পরিবর্তে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে দে‌শে। সামাজিক ন্যায় বিচারের পরিবর্তে বিচার ব্যবস্থাকে করা হয়েছে দলীয় করণ। সাম্যের পরিবর্তে জা‌তির ম‌ধ্যে বৈষম্যের উঁচু পাহাড় তৈরী করা হ‌চ্ছে দিনে দিনে। সরকা‌রের বা‌হিনী দ্বারা গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরতার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জা‌তি‌কে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি চাওয়া ছিল বৈষম্যের অবসান। বাঙালি জাতি যারা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করতেন, তাদের সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করা হতো। তারা বিভিন্নভাবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হতেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছি‌লো – পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ চিরত‌রে নির্বাস‌নে পা‌ঠি‌য়ে দি‌য়ে জনগণের নিজেদের শাসন করার অধিকার প্রতিষ্টা করা। বাংলাদেশ হবে জনগণের দেশ এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত দেশ অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে দেশ। কিন্তু সেই দেশ আজ নৈশ ভো‌টের এম‌পি‌দের দখ‌লে।

মহান স্বাধীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণে আজকের বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিলো – বাংলাদেশ হবে সব ধরনের বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার ও শোষণ থেকে মুক্ত; অসাম্প্রদায়িক এবং সামাজিক ন্যায়বিচার হবে দেশের ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিলো – গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা। এতে বলা হয়েছে – প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্ব কার্যকর হবে। কিন্তু, বারে বারে নির্বাচনে নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসন দিয়ে ভোট ডাকাতি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে ফ্যাসিস্ট সরকার। বাংলাদেশ‌কে গণপ্রজাতন্ত্র বলা হলেও, শাসনকার্যে জনগণের অংশগ্রহণ একদমই নেই। গণতন্ত্র আজ বিপন্ন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যবসা করছে সরকার। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উন্নয়‌নের ট্যাগ লা‌গি‌য়ে জনগ‌ণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া দেশ শাসন কর‌ছে ক্ষমতাসীনরা। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন, ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র এখন আর গোপন নেই। এমনকি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পরিণত হয়েছে দলীয় কর্মীতে। সব জায়গায় নিজ দলের কর্মীদের নিয়োগ দিয়ে পুরো রাষ্ট্রকে অঙ্গ সংগঠনে পরিণত করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত র‌য়ে‌ছে সরকার। সব জায়গায় ব্যাপক বৈষম্য এবং দলীয়করণের ব্যাপক প্রভাবে নেতা-কর্মীরা বাদে সাধারণ মানুষের পক্ষে চাকরী ও ব্যবসা-বাণিজ্য করা বলতে গেলে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পুলিশ, র‍্যাব বাহিনীকে পরিণত করা হয়েছে লাঠিয়াল বাহিনীতে। সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত করে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। ফলে নানান সুযোগ সুবিধা পেয়ে তারাও এখন ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য করেন না।

আজ মহান বিজয় দিবস, বাঙালি জাতির বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন | 985990 |  কালের কণ্ঠ | kalerkantho

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যান অনেক মানুষ। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়ে আসছে বিজয় দিবস উৎসবে। প্রবাসী বাংলাদেশীরাও দিনটি পালন করছেন বিপুল আনন্দ-উৎসব এবং একই সঙ্গে বেদনা নিয়ে। দেশের স্বাধীনতার জন্য যে অকুতোভয় বীর সন্তানেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, কৃতজ্ঞ জাতি গভীর বেদনা ও পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে তাদেরকে। সেটাই তো হবার কথা? কিন্তু এসব চেতনা ও শ্রদ্ধাবোধের আড়ালে দিন দিন প্রতারণার ফাঁদে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যারফ‌লে গণত‌ন্ত্রের প‌রিব‌র্তে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যাবস্হার শিকড় প্রতি‌নিয়ত মজবুত হ‌চ্ছে বাংলা‌দে‌শে।

(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়)

SHARE THIS ARTICLE