তৌফিক মারুফঃ
► বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি ঝুঁকিতে থাকা পঞ্চাশোর্ধ্বদের আগে টিকা দিতে হবে
► শুধু হাসপাতাল নয়, হোম সার্ভিস ও ভ্রাম্যমাণ টিকা কেন্দ্রের প্রস্তাব; নিবন্ধনে দরকার সহজ পদ্ধতি
► নতুন টিকাগুলো এলে কে কোনটা পাবে বা কিভাবে বাছাই হবে, তা-ও এখনই ঠিক করার পরামর্শ
এখন পর্যন্ত করোনায় যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের ওপর। ফলে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষকে সুরক্ষা দিতে টিকায় অগ্রাধিকার রাখা জরুরি। শুরুতে সেভাবে পরিকল্পনাও করা হয়েছিল; কিন্তু হঠাৎ বয়ঃসীমা ৪০ বছরে নামিয়ে দেওয়ায় টিকাগ্রহীতার সংখ্যা বেড়ে যায়। এতে কমে যায় অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর টিকা পাওয়ার হার। এ জন্য সামনে যে টিকাই দেশে আসবে, এর প্রথম ডোজ বা সিংগেল ডোজ যেটাই হোক, তাতে ৫৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা সাজানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
একই সঙ্গে নির্দিষ্ট টিকাকেন্দ্র ছাড়াও বয়স্ক মানুষদের জন্য প্রয়োজনে হোম সার্ভিস বা ভ্রাম্যমাণ টিকাকেন্দ্র চালুরও পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, সামনে যেহেতু বিভিন্ন ধরনের টিকা দেশে আসছে, তাই বর্তমানে দেশে চলমান অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাভিত্তিক পরিকল্পনার সঙ্গে অন্য টিকার প্রয়োজনমতো ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা এখন থেকেই তৈরি করে রাখা দরকার। তা না হলে ভিন্ন ভিন্ন ডোজ বা শিডিউলের টিকা এসে গেলে তখন ব্যবস্থাপনাগত বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দেশে এ পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ৫.৫ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছেন। অন্যদিকে চলমান পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪০ বছরের ওপরে এবং ফ্রন্টলাইনারদের মধ্যে টিকা নিয়েছেন প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ। এ ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ নেওয়া মানুষদের মধ্যে ৬২ শতাংশ পুরুষ ও ৩৮ শতাংশ নারী। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়াদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ পুরুষ ও ৩৩ শতাংশ নারী রয়েছেন। তবে বয়স্ক মানুষের মধ্যে ঠিক কত শতাংশ টিকা পেয়েছেন, তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন প্রেক্ষাপটে আমাদের বিদ্যমান টিকা ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি। নয়তো সামনে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে এখন যেহেতু কয়েক ধরনের টিকা দেশে আসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তাই ওই টিকার কোনটির কী ধরনের ডোজ-শিডিউল, তা বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে, নীতিমালা ঠিক করতে হবে। এত দিন একটিই টিকা ছিল বলে কারো পছন্দ-অপছন্দের কোনো সুযোগ ছিল না; কিন্তু সামনে সুযোগ আসছে তাই কে কোন টিকা পাবে, সেটি কিভাবে ঠিক হবে সেটাও মানুষকে আগেই জানিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। যদি বেশির ভাগ মানুষ কোনো একটি বিশেষ টিকার ওপর বেশি আগ্রহী হয় তখন ওই টিকার জোগান কিভাবে হবে, সেটাও ভাবনার বিষয় আছে। বিষয়গুলো যদি খুব হালকাভাবে নেওয়া হয়, তবে ভুল হবে।’
এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘বয়সের বিষয়টিতে সরকারের আরো পরিকল্পিত পদক্ষেপ আশা করছিলাম। সব দেশেই যে বয়সের মানুষের মৃত্যু বেশি হচ্ছে তাঁদের আগে সুরক্ষার জন্য টিকা ও বয়সের কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে হঠাৎ করেই টিকার বয়স ৪০ বছরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ বয়স্ক মানুষই সবেচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন। প্রথমত, তাঁদের বাঁচানোর টার্গেট করে টিকা দিতে হবে। তবেই দেখা যাবে দেশে করোনায় মৃত্যুর লাগাম টানা গেছে, যেটা যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অন্য দেশে দেখা যাচ্ছে। তাই বলব, দেশে যখনই আবার প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হবে তখন ৫৫ বছরের ওপরের মানুষদের জন্য সংরক্ষিত ব্যবস্থা করা হোক। যাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য বিষয়টি সহজ করা হোক। প্রয়োজনে মোবাইল ফোনের নিবন্ধনের জন্য যেভাবে পথেঘাটে, দোকানে দোকানে আঙুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে সেই বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।’
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, টিকা সংরক্ষণ ও পরিবহনে হয়তো খুব একটা সমস্যা হবে না। বরং বেশি সমস্যা বা বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে কেন্দ্রগুলোতে। একই কেন্দ্র বা বুথে সব ধরনের টিকা থাকবে নাকি ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্র বা বুথ থাকবে, তা-ও আগেভাগে ঠিক করে মানুষকে ব্যাপকভাবে জানিয়ে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে টিকা এলে সেটার ব্যবস্থাপনা কী হবে, তা-ও এখনই মানুষকে জানালে উপকার হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমিউনিটি লেভেলে যখন টিকা দেওয়া শুরু হবে তখন বয়স্কদের জন্য ভ্রাম্যমাণ টিকাকেন্দ্র চালু করলে সেটি খুবই উপকার হবে। এখনো শুধু হাসপাতালেই টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের অপেক্ষাকৃত ছোটদের উচিত বয়স্ক সদস্যদের টিকা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা।’
ড. মুশতাক বলেন, ‘টিকায় পছন্দ-অপছন্দের বিভাজন করলে ঝামেলা বাড়বে। বরং দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে যে কেন্দ্র বা বুথে যে টিকা থাকবে সেখানে ওই কেন্দ্র বা বুথের নিবন্ধনকারীরা সেই টিকা পাবেন, এভাবেই চালালে ভালো হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সবাই যাতে টিকা পায়, সেটা নিশ্চিত করা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকা) ডা. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাসংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটি এসব বিষয়ে কাজ করছে। সেখান থেকে যেভাবে পরিকল্পনা করা হবে, সেভাবেই আমরা কাজ করব। এখনো কোন টিকা কবে আসবে, সেটা ঠিক হয়নি। তবে কোনো পরিকল্পনাই স্থায়ী বা চূড়ান্ত নয়, পরিবর্তনশীল। যখন যা প্রয়োজন, সেটাই করা হবে। আমাদের সে অনুযায়ী প্রস্তুতি রয়েছে।’
এদিকে এখন পর্যন্ত কোন বয়সের কতজন টিকা পেয়েছেন, সেই হিসাব তৈরি করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা এ নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ‘কোভিশিল্ড’ দেশের মানুষকে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আরো ছয়টি টিকা আনার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে রাশিয়ার টিকা ‘স্পুৎনিক-ভি’ জরুরি আমদানি ও ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। আর চীনের সিনোফার্ম (বেইজিং) ও সিনোভ্যাক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার, মডার্না ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা আমদানি ও ব্যবহারের বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নীতিগত সম্মতি দেওয়া হয়েছে।