নতুন বছরে কী করতে চলেছেন কিম জং উন

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ গত বছর রেকর্ড পরিমান ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। নিজেদের পরমাণু শক্তিধর দেশ দাবি করে পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার গড়ের তোলার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন।

উত্তর কোরিয়ার কারণেই ২০১৭ সালের পর ২০২২ সালে কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ উত্তেজনার পারদ সবচেয়ে উঁচুতে ছিল।

উত্তর কোরিয়া এখন পর্যন্ত যে কয়টি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে তার একচতুর্থাংশের পরীক্ষাই হয়েছে ২০২২ সালে। গত বছর দেশটি ৬০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। যেগুলোর মধ্যে পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রও ছিল।

নতুন বছরে কিম আর কী কী করতে চলেছেন তা অনুমান করার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

কিম জং উনের অবিশ্বাস্য বিলাসবহুল জীবন - Roar বাংলা

পরমাণু অস্ত্রের উন্নয়ন:

২০২২ সালে উত্তর কোরিয়া তাদের অস্ত্র তৈরির কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার মধ্যদিয়ে তারা বছর শুরু করেছিল। যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ায় আঘাত হানতে সক্ষম। তারপর তারা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। যেগুলো জাপানে আঘাত হানতে সক্ষম।

আর বছরের শেষ দিকে এসে তারা সফলভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হোয়াসং-১৭ এর পরীক্ষা চালায়। যেটি দেশটির চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্রের মূলভূখণ্ডের যেকোনো জায়গায় আঘাত হানতে সক্ষম।

গত বছর সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়া নিজেদের পরমাণু অস্ত্র শক্তিধর দেশ বলে ঘোষণা করে। কিম বলেন, তারা এখন শুধু যুদ্ধ প্রতিহত করে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই অস্ত্র বানাচ্ছে না। বরং অন্যদের দমন করতে এবং আক্রমণ করে যুদ্ধ জয় করতে অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করছে।

নতুন বছরে কী করতে চলেছেন কিম জং উন

কিম ২০২৩ সালের জন্য তার যেসব লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন সেই তালিকায় উপরের দিকে আছে পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন ‘দ্রুত বৃদ্ধি’ করা। তিনি প্রচুর পরিমাণে ছোট আকারের এবং কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চান। যেগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে ব্যবহার করা যাবে।

যেটিকে সবচেয়ে ‘গুরুতর অগ্রগতি’ বলে সতর্ক করেছেন পরমাণু অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অঙ্কিত পান্ডে।

কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র প্রস্তুত করতে হলে আগে উত্তর কোরিয়াকে ছোট আকারের পরমাণু বোমা বানাতে হবে। যেগুলো স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। পিয়ংইয়ং এখনো এ ধরনের কোনো বোমা তাদের হাতে থাকার প্রমাণ বিশ্বকে দিতে পারেনি। তবে পুরো ২০২২ সাল জুড়েই বিশ্ব উত্তর কোরিয়ার এ ধরণের বোমার পরীক্ষা চালানোর অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু গত বছর সে অপেক্ষা ফুরায়নি। তবে কী ২০২৩ সালে উত্তর কোরিয়া এ পরীক্ষা চালাবে।

কিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আরেকটি হলো গোয়েন্দা নজরদারির জন্য মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো। এ বছর বসন্তে তেমন একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।

তাই বলা যায়, উত্তর কোরিয়া নতুন বছরেও তাদের আগের বছরের আগ্রাসী মনোভাব বজায় রাখতে চলেছে।

আলোচনার সম্ভাবনা নেই:

এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার আলোচনায় ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্রনিরস্ত্রীকরণের আলোচনা শুরু করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু ২০১৯ সালে ট্রাম্পের আমলেই সেই আলোচনা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। তারপর থেকে পুনরায় আলোচনা শুরুর কোনো আগ্রহ দেখাননি কিম।

তার পরিবর্তে উত্তর কোরিয়া বরং গত বছর চীন ও রাশিয়ার আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার মত এই দুটো দেশও যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের শত্রু মনে করে।

কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা:

২০২২ সাল জুড়ে কোরীয় উপদ্বীপে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করেছে।

উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি কখনো কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরণের ‘উসকানিমূলক’ আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

যার শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের মে মাস থেকে। যখন দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক-ইওল ক্ষমতায় এলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

নতুন বছরে কী করতে চলেছেন কিম জং উন

তিনি বিশ্বাস করেন, উত্তরকে থামানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সামরিক শক্তি বাড়ানোর মাধ্যমে তাদের জবাব দেওয়া।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে কোরীয় উপদ্বীপে পুনরায় বড় ধরণের সামরিক মহড়া শুরু করেন। যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এবং আরো বেশি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে জবাব দেয় উত্তর কোরিয়া।

সারা বছর ধরেই দুই প্রতিবেশী সীমান্তে যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে এবং সমুদ্রে গোলা ছুঁড়ে যুদ্ধ প্রস্তুতির জানান দিয়েছে।

এরমধ্যে গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়ার পাঁচটি ড্রোন দক্ষিণ কোরিয়ার আকাশ সীমায় প্রবেশ করলে পরিস্থিতি চরমে ওঠে।

দক্ষিণ কোরিয়া সেগুলোর কোনোটিকে ভূপাতিত করতে পারেনি। উল্টো সেগুলোকে তাড়া করতে গিয়ে তাদের একটি যুদ্ধবিমান আকাশে উড়ার পরপরই বিধ্বস্ত হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ মানুষের চোখে যা দেশটির সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা বলে চিহ্নিত হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট যেকোনো ধরণের উসকানিমূলক আচরণের জন্য উত্তরকে শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন।

এ বিষয়ে ‘কোরিয়া রিস্ক গ্রুপ’ এর প্রধান নির্বাহী চাদ ও’ক্যারোল মনে করেন, এর ফলে ২০২৩ ‍সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে সরাসরি সংঘাত শুরু হয়ে যেতে পারে। যার পরিণাম হবে অনেক মৃত্যু।

তিনি বলেন, ‘‘একটিমাত্র ভুল বা ভুল বোঝাবুঝি এবং পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।

উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরে কী ঘটতে পারে:

কোভিড-১৯ মহামারীকে আটকাতে প্রায় তিন বছর ধরে সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে রেখেছে উত্তর কোরিয়া। এমনকি ব্যবসা বাণিজ্যও বন্ধ রয়েছে। যা নানা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে আগে থেকেই বিধ্বস্ত দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো নাজুক করে ফেলেছে।

নানা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিশ্বাস, দেশটিতে খাবার ও ওষুধের তীব্র সংকট রয়েছে।

গতবছর এক ভাষণে স্বয়ং কিমও স্বীকার করেছেন, তার দেশ ‘খাদ্য সংকটে পড়েছে’। তার এ ধরণের স্বীকারোক্তি খুবই বিরল।

নতুন বছরে কী করতে চলেছেন কিম জং উন

গত বছর মে মাসে উত্তর কোরিয়া সরকার প্রথমবারের মত সেখানে করোনা ভাইরাস মহামারীর বিস্তার ঘটার কথা স্বীকার করে। যদিও দুই-তিন মাসের মধ্যেই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনার দাবিও করে তারা।

তাহলে কী ২০২৩ সালে নিজেদের সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দেবে উত্তর কোরিয়া। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে তাদের সীমান্ত খুলে দেওয়া হলে জনগণ কাজে যাওয়ার এবং পণ্য সরবরাহ পুনরায় চালু হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

চীন সরকারও তাদের কোভিড বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। যা উত্তর কোরিয়ার মানুষদের মনে আশা জাগাচ্ছে।

২০২২ সালে আরো একটি কাজ করেছেন কিম। প্রথমবারের মত তিনি তার কোনো সন্তানকে জনসম্মুখে এনেছেন এবং সে হলো তার মেয়ে। যার নাম খুব সম্ভবত কিম চু-এ। এরমধ্য দিয়ে কিমের পর কে উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্ব দেবেন সেটাই হয়তো দেখানো হয়েছে।

গত বছর মোট তিনটি সামরিক অনুষ্ঠানে কিমের মেয়ের উপস্থিত থাকার ছবি প্রকাশ পায়। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠানের বেশ কিছু ছবিও প্রকাশ পেয়েছে। যার মধ্য দিয়ে এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হচ্ছে যে তাকেই নেতৃত্বের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।

তবে সব কথার শেষ কথা হলো, উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে আগে থেকে কিছু অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। কিম কখন কী করবেন তা শুধুমাত্র তিনিই জানেন।

SHARE THIS ARTICLE