মহামারিতে ভারতীয় ব্যর্থতা এবং কিছু ভাবনা


ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ কোভিড মহামারি আসার পর যে ভয় নিয়ত অনেকের মনে আসছিলো তা হচ্ছে যদি সংক্রমণের হার বাড়তে দেয়া হয় তাহলে একটা সময় আসবে যখন হাসপাতালে আর কোন শয্যা থাকবেনা, অক্সিজেন থাকবে না, আই সি ইউ পরিসেবা দেয়া যাবেনা যার ফলে পথে ঘাটে হাটে মানুষের মৃত্যু হবে। এই শংকা থেকেই দেশে দেশে লকডাউন, কোয়ারেনটাইন আর আইসোলেশনের মত পদ্ধতির ব্যাবহার করা হয়েছে। এই লকডাউন পদ্ধতির যে পার্শপ্রতিক্রিয়া সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক। মানবিক দেশগুলো অর্থনীতি থেকে জীবনকে মূল্য দিয়েছে বেশী। তারা ভেবেছে মানুষ বেঁচে থাকলে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব। মানুষই যদি না বাঁচল তাহলে অর্থ থেকে কি লাভ? এই মানবিক চিন্তাভাবনার ব্যাতিক্রমী দেশগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ব্রাজিল, আর তার মাশুল কড়ায় গণ্ডায় দিতে হচ্ছে ব্রাজিলের। ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটি। সেই দেশের প্রেসিডেন্ট বালসেনারোর ভিন্ন নীতির কারণে কোভিড মহামারিতে সংক্রমণের তালিকায় তাদের স্থান ৩য়। সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ কোটীর বেশী। মৃত্যুর পরিসংখ্যানে তাদের স্থান ২য়, সেখানে মারা গেছেন ৩,৮৯, ৪০৯ জন।

Over thousand test positive for Covid-19 at Kumbh Mela in 48 hours dgtl -  Anandabazar
কুম্ভ মেলা

এই মুহূর্তে সেই শংকা সত্যি হয়েছে ভারতে। ভারত একটি অত্যন্ত জনবহুল দেশ, ১৩০ কোটী মানুষের আবাস এখানে বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। এখানে অর্থনীতি আর জীবনের হিসাব নিকাশ ভিন্ন। লক ডাউন দেয়া হলে কোটী কোটী মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে মারা যাবে, রাষ্ট্রের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে লক ডাউনের সময় খাদ্য শস্য ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া অসম্ভবের সমতুল্য। তাই নরেন্দ্র মোদির সরকার ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। কিন্তু যে ভুল তিনি করেছেন সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিকে আনুকূল্য দিয়েছেন বিশেষ করে সাম্প্রতিক কুম্ভ মেলা এবং রাজ্যসভার নির্বাচন। লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমাবেশ হয়েছে। যদিও শেষ মুহূর্তে বেশ কিছু সভা সমাবেশে নরেন্দ্র মোদী যোগ দেন নি। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গিয়েছে।

May be an image of one or more people and outdoors


বর্তমানে কোভিড মহামারিতে সবচেয়ে বিপর্য্যস্ত দেশ হচ্ছে ভারত। গতকাল রোববার টানা চতুর্থ দিনের মত প্রতিদিনের সংক্রমণ রেকর্ড গড়ে চলেছে এই দেশ, ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুসারে গতকাল এক দিনে ৩,৫৪, ৫৩১ জন সংক্রমিত হয়েছেন আর মারা গিয়েছেন ২,৮০৬ জন। এই অপ্রতিরোধ্য সংখ্যায় সংক্রমণ ভারতের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাকে সম্পূর্ন বিপর্য্যস্ত করে দিয়েছে। হাসপাতালে সাধারণ শয্যা নেই, আই সি ইউ শয্যা নেই, অক্সিজেন নেই, ঔষধ নেই। অক্সিজেনের অভাবে ভেন্টিলেটরে মারা গিয়েছেন অন্ততপক্ষে একশত জন। অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ। মৃতের আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান থেকে অনেক বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং হচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ। শ্মশানে লাশ পোড়ানো হচ্ছে অবিরত তবুও মৃতের শেষ নেই। কবরস্থানে স্থান সংকুলান হচ্ছেনা। ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে ভারত।

Covid-19 patients get oxygen on the spot provided by Sikh Organization at Gurdwara in Indirapuram, Ghaziabad, Uttar Pradesh, India on April 24, 2021

এরকম পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে বিভিন্ন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, চীন, এমনকি পাকিস্তান পর্য্যন্ত অক্সিজেন থেকে শুরু করে, ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি একা ভারতের পক্ষে সামাল দেয়া কঠিন। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সহায়তা অত্যাবশ্যক। তবে ভারতকে এখনই সংক্রমণের চক্র ভাঙ্গার জন্য স্বল্প মেয়াদি লক ডাউনের কথা দ্রুত ভাবা উচিৎ বলে অনেকেই মনে করছেন। 

May be an image of one or more people

বিশ্বব্যাপী মহামারি চলছে তাও আজ প্রায় ১৬ মাস হতে চলল। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত হয়েছেন প্রায় ১৫ কোটির মত মানুষ (১৪, ৭৬, ৭৭,৩১৭) আর আনুষ্ঠানিক মৃত্যুবরন করেছেন ৩১, ১৯,৭৪৩ জন। বিগত ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া টিকা কার্য্যক্রম মানুষ জাতির জন্য বয়ে এনেছিল সুসংবাদ, মানুষ আশান্বিত হয়েছিলো দ্রুতই মহামারি থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে। কিন্তু টিকা নিয়ে রাজনীতি বিশ্ব সভ্যতাকে কালিমাযুক্ত করেছে। পশ্চিমা ধনি দেশগুলো প্রাথমিক সময়ে অধিকাংশ টিকা কিনে নিয়ে তাদের দেশে কার্য্যক্রম চালিয়েছে জোরালোভাবে। আজ পর্য্যন্ত ১০০ কোটির চেয়ে বেশী টিকা মানুষকে প্রদান করা হয়ে গেছে। সফলতার মাপকাঠিতে সবার আগে পৌঁছে গেছে ইসরায়েল। তাদের দেশের অশিকাংশ উপযোগী মানুষকে টিকা প্রদান সম্পন্ন করে সংক্রমণ আর মৃত্যু প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। দেশটি এখন প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরে আসছে। 

ঘাটালে বিজেপি প্রার্থীকে মারধর,West Bengal Assembly Election 2021: Ghatal  BJP Candidate beaten by shoe while campaigning - Bengali Oneindia

সফলতার সারিতে এর পরের দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য, এই দেশটি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে টিকা কার্য্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে তাল মিলিয়ে কমছে সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হার। যুক্তরাজ্য তাদের ৬ কোটি ৬০ লক্ষ জনগোষ্ঠীর প্রাপ্তবয়স্কদের ৬২% মানুষকে ইতিমধ্যে এক ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন করেছে আর দুই ডোজ দিয়ে দিয়েছে প্রায় ২৫% প্রাপ্তবয়স্ককে। স্বল্পদিনের মধ্যে তারা তাদের সকল প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেয়া সম্পন্ন করবে বলে বাস্তব পরিকল্পনা কার্য্যক্রম চলছে। গতকাল যুক্তরাজ্যে সংক্রমিত হয়েছে ১,৭১২ জন আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১১জন, এটা বিরাট সফলতা।

এরপরের দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশাল এই দেশের জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্কদের দেয়া হচ্ছে টিকা। ইতিমধ্যে দেশটির প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এক ডোজ টিকা পেয়েছেন সর্বমোট সংখ্যা ১৩ কোটীর বেশী। আর এক তৃতীয়াংশ দুই ডোজ টিকা পেয়ে গেছেন, এই সংখ্যা ৮ কোটি ৫০ লক্ষের বেশী হবে। নূতন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল তার প্রথম ১০০ দিনে তিনি ন্যুনতন ১০ কোটী মানুষকে টিকা প্রদান করবেন। যুক্তরাষ্ট্র এই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে গিয়েছে। সফলতাও দেখা যাচ্ছে, কমে আসছে সংক্রমণ আর মৃত্যুর সংখ্যা, গতকাল যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত হয়েছেন ২০,০০০ জন আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১৮১ জন। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই এই সংখ্যা কমে আসবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, টিকা রাজনীতিতে কোন বৈশ্বিক উদ্যোগ পূর্নাংগ সফলতা পায়নি। অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলো টিকা প্রাপ্তিতে পিছিয়ে পড়েছে অনেকখানি। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (গাভী) উদ্যোগে কোভ্যাক্স প্রজেক্ট গ্রহণ করে অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোর জন্য টিকা সরবরাহের পরিকল্পনা করেছিলো। কিন্তু সেই পরিকল্পনা এখন ভেস্তে যেতে চলেছে বলেই অনেকে মনে করছেন। কেননা এই কোভ্যাক্স প্রজেক্টের অধিকাংশ টিকা আসার কথা ছিল বিশ্বের বৃহত্তম টিকা তৈরির প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে। সেরাম ইন্সটিটিউট এস্ট্রা জেনেকার টিকা তৈরি করে বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলোতে সরবরাহের কথা ছিল। বাংলাদেশ স্বকীয় উদ্যোগে ভারতের নিকট থেকে কিনেছিল ২ কোটীর মত ডোজ আর কোভ্যাক্স প্রজেক্ট থেকে আরও ২ কোটি ডোজ পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু এই মুহুর্তে ভারত সকল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় মুখ থুবড়ে পড়েছে সকল দেশের পরিকল্পনা।

COVAX Says India's Serum Institute Bound To Supply Virus Vaccines

চীন এবং রাশিয়া তাদের দেশের নিজস্ব পদ্ধতি ব্যাবহার করে তাদের নিজস্ব দেশকে টিকা দেবার পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে। চীনের টিকা মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে কার্য্যক্রম পরিচালনা করছে। রাশিয়া ও ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশে টিকা প্রদান শুরু করেছে।

ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার ঐন্দ্রজালিক চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বপ্নের রাজত্বে বাস করে ভেবেছিলেন দ্বিতীয় তরঙ্গ তাদের দেশে পৌছুতে পারবেনা। একটি ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা নিয়ে এ ধরনের চিন্তাভাবনা যে কি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে সেটা এখন ভারতবাসী ভোগ করছেন, বিশ্ববাসীও এর পরিণতি ভোগ করবেন।

বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উতপাদক, সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া, কোভাক্স প্রকল্পের অধীনে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলিতে যে পরিমাণ টিকা সরবরাহ করার কথা ছিল তা এখন ভারতের প্রয়োজনের জন্য রেখে দেয়া হচ্ছে আর তাও নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা তৈরির উয়াপাদান প্রাপ্তি সাপেক্ষে। সংকটের ফলস্বরূপ, এই মাসে ভারত মাত্র ১২ লক্ষ ডোজ টিকা সরবরাহ করেছে যেখানে গত তিন মাসে তারা সরবরাহ করেছিলো ৬ কোটী ৪০ লক্ষ ডোজ।

ভারতের জন্য আশার কথা যে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছেন যে, “চীন ভারতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সহায়তা দিতে রাজি আছে”, যদিও তিনি সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করেন নি। যুক্তরাজ্য সরকার ৪৯৫ টি অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর, ১২০ টি নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর এবং ২০ টি ম্যানুয়াল ভেন্টিলেটর উড়োজাহাজে করে দ্রুত নয়াদিল্লী পাঠাচ্ছে, জার্মানিও অক্সিজেন জেনারেটর এবং অন্যান্য সহায়তা পাঠাচ্ছে।

ভারতকে যা করা উচিৎ তা হচ্ছে একটি স্বল্পমেয়াদী লক ডাউন দিয়ে আপাততঃ সংক্রমণের চাকাকে ঘুরিয়ে দেয়া একই সাথে তাদের টিকা কার্য্যক্রমকে ত্বরান্বিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে টিকা তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে দ্রুত টিকা তৈরী করে নিজেদের দেয়া এবং একই সাথে বিশ্বে সরবরাহ চালু রাখা এই মুহূর্তে অত্যাবশ্যক।

India coronavirus lockdown: What stays open and what stays shut - BBC News


ভারতের এই বিপর্যয় থেকে সকল দেশের শিক্ষা গ্রহণ আবশ্যক। সংক্রমণের এই ঢেউ ভারতের পাশাপাশি দেশকে আক্রান্ত করার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল; তাই বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল এবং চিনকে আগেভাগে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ হবে। যদিও বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তিন সপ্তাহের আংশিক সফল লকডাউন দিয়ে কিছুটা বিপর্য্যয় ঠেকিয়েছেন আর কাল ভারতের সাথে সকল সীমানা বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে আমরা সবাই অবগত যে বাংলাদেশের ঘোষণার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। তবুও আমরা আশায় ঘর বাধি। স্রষ্টা আমাদের এই বিপদ থেকে সুরক্ষা দিন। 

16 Prayer Quotes — Quotes About Prayer
SHARE THIS ARTICLE