ওমর শাহ: পৃথিবীর ইতিহাসে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যার কোন তুলনা হয় না। ইনসাফের ব্যাপারে যিনি ছিলেন আপোষহীন। সত্য-মিথ্যার মানরেখায় যেই সাহাবিকে সদা অগ্রগামী দেখা যেত।
প্রিয় নবীজি হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাকে দিয়েছিলেন ফারুক উপাধি। মানে সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী। হজরত উমর (রা.) ছিলেন সাহাবি, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও বীর যোদ্ধা। বদর, উহুদ, খন্দক ও খায়বারের মতো ঐতিহাসিক যুদ্ধে বীরত্বের গল্প বুনেছিলেন তিনি। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হজরত উমর (রা.) ছিলেন কঠোর। অসহায়ের সেবায় ছিলেন কোমল হৃদয়। ইসলামের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সফল এই শাসক মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। অর্ধেক পৃথিবীর শাসনভার হাতে থাকার পরও নিজে থাকতেন মাটির ঘরে, খেজুর পাতার মাদুর ছিল তার সিংহাসন। মুসলিম ও অমুসলিম সবার জন্য রাষ্ট্রীয় আয়ে গড়া বায়তুল মাল থেকে ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। উমর (রা.) তার খেলাফতের সময় বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। ন্যায়বিচারক ছিলেন তিনি।
বিশ্বনবী (সা.) নিজের আদর্শ দিয়ে যেভাবে ইসলাম ধর্মকে একটি পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছেন, তেমনি তৈরি করেছেন একদল সোনার মানুষ। হজরতের পরশ পেয়ে বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ মুক্তির দিশা পেয়েছিল। যে আলোকিত মানুষের দল তিনি তৈরি করেছিলেন তাদের সবাই আমাদের জন্য আদর্শের বাতিঘর। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) ছিলেন এই সোনালি মানুষদের একজন।
প্রথম ইসলাম গ্রহণ :
ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন হজরত উমর (রা.)। ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তার ও ইসলামের সেবায় অনন্য ছিলেন তিনি। হজরত উমর (রা.) মক্কার প্রভাবশালী নেতা ও যোদ্ধা হিসেবে সমাদৃত ছিলেন।
কিন্তু বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতের শুরুতে হজরত উমর (রা.) ছিলেন ইসলামবিরোধী। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দুজন মানুষকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহর কাছে হেদায়েত প্রার্থনা করেন। সেই দোয়ায় হজরত উমর (রা.)-কে আল্লাহ গ্রহণ করেন। মহানবী আল্লাহর পথে মক্কার মানুষকে যখন ডাকছেন তখন হজরত উমর (রা.) হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে, ক্রোধে ভুল পথ বেছে নিয়েছিলেন। ইতিহাসের বর্ণনানুযায়ী বলা হয়, মহানবীকে হত্যার উদ্দেশে খোলা তরবারি হাতে বের হয়েছিলেন উমর (রা.)। পথিমধ্যে তিনি জানতে পারেন তার বোন ও বোনের স্বামী দুজনেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এ খবর পেয়ে উমর (রা.) পথ বদলে বোনের বাড়ির দিকে রওনা করেন। ঘরের সামনে পৌঁছেই তিনি পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শুনতে পান। সুরা ত্বহার অপূর্ব বাণী উমর (রা.)-এর মনে দারুণ প্রভাব ফেলে। উমর (রা.) ঘরে প্রবেশ করতেই তার বোন পাণ্ডুলিপিটি লুকিয়ে ফেলেন। কোরআন তিলাওয়াতের বিষয়ে উমর (রা.) ক্রোধের কারণে জেরা করতে থাকেন। তার বোন তাকে গোসল করে পবিত্র হয়ে আসতে বলেন। হজরত উমর (রা.) গোসল করে পবিত্র হয়ে ঘরে আসেন এবং সুরা ত্বহার আয়াতগুলো পাঠ করেন।
কোরআনের বাণী তার মনকে শান্ত করে ও তিনি ইসলামের প্রতি অনুগত হয়ে পড়েন। কোরআনের অপূর্ব বাণী পাঠ করে তিনি ইসলাম গ্রহণ করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে ছুটে যান। যাঁকে হত্যার জন্য খোলা তরবারি হাতে বের হয়েছিলেন তার কাছেই ইসলামপ্রেমে ছুটে এলেন হজরত উমর (রা.)। মহানবীর দোয়ায় হেদায়েতপ্রাপ্ত হজরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন ৩৯ বছর বয়সে। ৬১৬ সালের এই ঘটনা ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। হজরত উমর (রা.) ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় মক্কায় মুসলমানদের প্রভাব বেড়ে যায়। ইসলামকে কটাক্ষ করার সাহস হজরত উমর (রা.)-এর সামনে কেউ দেখাতে পারেনি। মুসলমানরা প্রকাশ্যে কাবার সামনে নামাজ আদায় করতে শুরু করে। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ্যে মুসল্লিদের নিয়ে কাবা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যখন উমর মুসলিম হন তখন থেকে আমরা সমানভাবে শক্তিশালী হয়েছিলাম এবং মান-সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পেরেছিলাম।’
খলিফা ওমরের অর্ধেক পৃথিবী জয়
হজরত উমর (রা.) ছিলেন প্রথম আমিরুল মুমেমিন বা বিশ্বাসীদের নেতা। মুসলিম শাসকদের এই খেতাব তাকে দিয়েই শুরু হয়। উমরের শাসনামল নানা কারণে ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাম্রাজ্য বৃদ্ধি। ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। বীর যোদ্ধা উমর (রা.) তার খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বাড়াতে শুরু করেন। একে একে তিনি সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। তার শাসনামলে জেরুজালেমও মুসলিমদের দখলে ছিল। তিনি পূর্বের খ্রিস্টান রীতির বদলে ইহুদিদের জেরুজালেমে বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনি নাজরান আর খায়বারের ইহুদি ও খ্রিস্টান গোত্রগুলোকে সিরিয়া আর ইরাকে অবস্থান দেন। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন কঠোর। তবে দরিদ্র ও অসহায়ের কাছে তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ। আইন ও বিচার ক্ষেত্রে হজরত উমর (রা.)-এর দক্ষতা ইসলামে সাম্যতা ও ন্যায়পরায়ণতা এনেছে। তিনি ইসলামের মহান কল্যাণে দাসপ্রথা উঠিয়ে দেন। রিদ্দার যুদ্ধের হাজার হাজার বেদুইন যুদ্ধবন্দীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্ত করে দেন তিনি। এতে বেদুইন গোত্রগুলোর মাঝে হজরত উমর (রা)-এর জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। হজরত উমর (রা)-এর শাসনামলে অল্প সময়েই ইসলামী সাম্রাজ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি আদমশুমারি করে মুসলিম জনসংখ্যা গণনা করেন। ৬৩৮ সালে তিনি একই সঙ্গে মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করেন। ৬৩৩ সালে পারস্য থেকে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু। ৬৪২ সালে চূড়ান্তভাবে পারস্য বিজয় হলে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার জয়গান গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে ফার্স, এরপর দক্ষিণ-পূর্ব পারস্য, সাকাস্তান, আজারবাইজান, আরমেনিয়া এবং খোরাসান জয়ের মাধ্যমে পারস্য পুরোপুরি মুসলিমদের অধিকারে চলে আসে। সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বড় অংশ জয় করে হজরত উমর (রা.) ইসলামের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। মাত্র ১০ বছরের কিছু বেশি সময় শাসনকালে অর্ধজাহানের শাসক হয়ে ওঠেন হজরত উমর (রা.)।
খেজুর পাতার ছাউনিতে রাজদরবার, ছিল একটিমাত্র জামা
সম্রাট বা বাদশাহ মানেই হীরা-মণি-মুক্তার জৌলুস, বিলাসী জীবন আর জাঁকজমক রাজপ্রাসাদ। সেসব কিছুই ছিল না হজরত উমর (রা.)-এর। মহানবীর বিশ্বস্ত সাহাবি ও ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) মুসলিম সাম্রাজ্য এতটাই বাড়িয়েছিলেন যে, অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা হয়ে ওঠেন তিনি। বীর যোদ্ধা ও কঠোর, ন্যায়পরায়ণ শাসক বলে তার নামেই থরথর কাঁপতেন ছোট-বড় সাম্রাজ্যের শাসকরা। এত প্রতাপশালী শাসক হয়েও ভোগ-বিলাসে মাতেননি হজরত উমর (রা.)। বরং দরিদ্র ও অসহায়ের জন্য মন কাঁদত তার। তার রাজপ্রাসাদ ছিল একটি কুঁড়েঘর। সেই ঘরের ছাউনি ছিল খেজুর পাতার। তার সিংহাসন বলতে ছিল খেজুর পাতার মাদুর। এখানে বসেই অর্ধেক পৃথিবী শাসন করতেন হজরত উমর (রা.)। রাজপ্রাসাদে যেখানে থাকার কথা স্বর্ণ-মুক্তার ঝাড়বাতি, সেখানে ছিল জয়তুন তেলের কুপিবাতি। যে ঘরে থাকতেন তা ছিল আরও সাধারণ। অর্ধজাহানের বাদশাহ হয়ে তার পরার মতো ছিল একটিমাত্র জামা। সেই জামাও কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। জামাটি ধুয়ে দিলে শুকানোর আগ পর্যন্ত খালি গায়েই অপেক্ষা করতে হতো। তার সাম্রাজ্যের মানুষজন কেমন আছে, খেয়েছে কিনা, অসহায়দের কথা ভেবেই অস্থির হতেন। তার সাধারণ জীবন অনুকরণীয়।
হজরত উমর (রা.)-এর সাধারণ জীবনের একটি চিত্র পাওয়া যায় এই ঘটনার বর্ণনা থেকে। এক দিন তার বেগম বললেন, বহুদিন থেকে জয়তুন তেল দিয়ে শুকনো রুটি খেয়ে কেমন অরুচি ধরে গেছে। যদি একটু মধুর ব্যবস্থা করতে পারতেন…। বায়তুল মাল থেকে যে ভাতা আসে, তা থেকে একটি দিরহামও বাঁচে না সংসারে। হজরত উমর (রা.)কে চিন্তিত দেখে বেগম একটি উপায় বের করলেন। বললেন, বায়তুল মাল থেকে কয়েকটা দিরহাম ধার নিলেই তো সমস্যা মিটে যায়। তিনি বায়তুল মালের পরিচালকের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু তার পুত্র বললেন, আব্বাজান! আপনি কি আগামীকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন বলে আশা করেন? ‘আগামীকাল কেন, এই মুহূর্তের পর মুহূর্তেই আমার জীবনের দশা কি হবে আমি জানি না। জীবন আল্লাহর হাতে, আমার জীবনের কোনো মুহূর্তের মালিকই তো আমি নই। তাহলে আমি কেমন করে ঋণ করে তা পরিশোধ করার দায়িত্ব নিতে পারি!’ হজরত উমর (রা.) ও তার স্ত্রীর আর মধু খাওয়া হলো না।
যেভাবে পাল্টে গেল অর্ধেক দুনিয়া
হজরত উমর (রা.) বসরা শহর প্রতিষ্ঠা করার পর পানীয় জল ও সেচের জন্য খাল খননের ব্যবস্থা করেন। প্রথম টাইগ্রিস নদী থেকে বসরা পর্যন্ত খাল খনন করেন। তিনি পতিত জমি চাষাবাদের জন্য নীতি গ্রহণ করেন। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাল খননের ফলে ব্যাপক অঞ্চলে কৃষিখেত গড়ে ওঠে।
এ ছাড়া হজরত উমর (রা.) বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার করেন। তিনি জেলা হিসেবে সাম্রাজ্য ভাগ করেন। সচিব বা প্রশাসক নিয়োগ দেন। বিচার ছিল সহজলভ্য ও ন্যায়বিচার পাওয়া যেত। উমর (রা.) সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় বিভাগ হিসেবে গঠন করেন। তার শাসনামলে হিজরি বর্ষপঞ্জি প্রণীত হয়।
বায়তুল মাল গঠন
হজরত উমর (রা.)-এর শাসন ব্যবস্থায় সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল বায়তুল মাল গঠন। বায়তুল মাল ছিল জনগণের সম্পদ। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেক ব্যক্তি বায়তুল মাল থেকে ভাতা পেতেন। হোক তিনি সাম্রাজ্যের শাসক অথবা সাধারণ কৃষক। ৬৪১ সালে হজরত উমর (রা.) রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে বায়তুল মাল গঠন করেন। রাষ্ট্রের আয় বায়তুল মালে জমা হতো। সেখান থেকে সবাইকে ভাতা সুষম বণ্টন করে দেওয়া হতো। রাষ্ট্রের আয়ের একটি অংশ আসত জাকাতের মাধ্যমে। ধনীদের কাছ থকে জাকাত আদায় করে বায়তুল মালে জমা করা হতো। দরিদ্র ও অসহায়দের এখান থেকে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এখান থেকে ব্যয় করা হতো। সম্পদ বণ্টনেও হজরত উমর (রা.) দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার সাম্রাজ্যে মুসলিম ও অমুসলিমে কোনো পার্থক্য ছিল না। বায়তুল মাল থেকে অমুসলিমরাও একই ধরনের সুবিধা লাভ করতেন। নতুন দেশ জয়ের পর সেখানে শিক্ষা বিস্তারে হজরত উমর (রা.) শিক্ষক নিয়োগ দিতেন এবং তাদের বেতন বায়তুল মাল থেকে পৌঁছে দিতেন। অসহায় ক্ষুধার্থের জন্য খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করা হতো এই বায়তুল মাল থেকেই। বায়তুল মাল ধারণাটি এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে যে, পরবর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতেও বায়তুল মালের ধারণাটি দেখা যায়।
নীল নদের কাছে খলিফা উমর (রা.)-এর চিঠি
মিসরে তখন চলছিল প্রবল খরা। পানিশূন্য নীল নদ দেখে সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রা.) সেখানকার অধিবাসীদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন নীল নদের এমন অবস্থা কেন? তারা উত্তরে বলেছিল, হে আমির! নীল নদে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়ম অনুসারে পানি প্রবাহিত হয় এবং বাকি সময় পানিশূন্য থাকে, তবে নদীকে যুবতী কন্যা উৎসর্গ করলে নদী আবার পানিতে ভরে উঠবে। নীল নদ এখন পানিশূন্য, কিন্তু এই মাসের ১৮ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমরা কোনো এক কুমারী সুন্দরী যুবতীকে নির্বাচন করব। অতঃপর তার পিতা-মাতাকে রাজি করিয়ে তাকে সুন্দরতম অলঙ্কারাদি ও উত্তম পোশাক পরিধান করিয়ে নীল নদে নিক্ষেপ করব। এর ফলে দেবতার আশীর্বাদে নীল নদ আবার পানিতে ভরে উঠবে। আমর ইবনুল আস (রা.) তাদের কথা শুনে বললেন, ইসলামে এই কাজের কোনো অনুমোদন নেই। এরপর তিন মাস পানির অপেক্ষায় কাটল। কিন্তু নীল নদে পানি বৃদ্ধি পেল না। নীল নদের এই অবস্থা দেখে আমর খলিফা উমর (রা.)কে সব কিছু জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সব ঘটনা লিখে তিনি খলিফাকে চিঠি পাঠালেন।
আমরের চিঠিটি পেয়ে খলিফা উমর (রা.) নীল নদকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি লিখে আমরের কাছে প্রেরণ এবং চিঠিটি তিনি নীল নদের কাছে পৌঁছে দিতে নির্দেশ দিলেন।
নীল নদের প্রতি লেখা উমর (রা.)-এর চিঠিটি তার নির্দেশ মোতাবেক আমর ইবনুল আস নীল নদের তীরে গিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করেন। পরদিন শনিবার সকালে মিসরবাসী অতি আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করল, মহান আল্লাহ এক রাতে নীল নদের পানিকে ১৬ গজ উচ্চতায় প্রবাহিত করে দিয়েছেন। তারপর নীল নদ চকচকে ঝকঝকে পানিতে ভরে উঠেছিল এবং আজ পর্যন্ত এক মিনিটের জন্যও নীল নদের পানি আর শুকিয়ে যায়নি।
উমর (রা.)-এর মোমবাতি
মোমের আলোয় কাজ করছিলেন খলিফা উমর (রা.)। এমন সময় সেখানে আসলেন তার দুই আত্মীয়। খলিফা তাড়াতাড়ি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন। অন্য আরেকটি মোমবাতি ধরিয়ে অতিথিদের বসতে দিয়ে তাদের খোঁজখবর নিলেন।
কৌতূহল চাপতে না পেরে একজন জানতে চাইলেন, আমাদের দেখে কেন আপনি আগের মোমবাতি নেভালেন আর নতুন একটি জ্বালালেন? খলিফা জবাব দিলেন, আগের মোমবাতি ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি থেকে কেনা। তোমরা যেহেতু আমার আত্মীয়, তাই তোমাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অনেক আলাপ হবে। আমার নিজের কাজে জনগণের আমানত থেকে আমি কিছু খরচ করতে পারি না। তাহলে আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তাই নিজের টাকায় কেনা মোমবাতিটি তোমাদের দেখে জ্বালালাম।
সব জুলুমের অবসান
পৃথিবীর শাসকদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হজরত ওমর (রা.) যে উপায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন তা ছিল এক কথায় অসাধারণ। তার শাসনাঞ্চলে অপরাধ ছিল না বললেই চলে। দরিদ্রতার হার নেমেছিল শূন্যের কোঠায়। মানুষের নৈতিকতা, সততা ছিল অনন্য। সে শাসনের সোনালি দিনের কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। ওমর (রা.)-এর শাসনকাল পর্যালোচনা করে বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন। মাত্র দশ বছরের শাসনে হজরত ওমর (রা.) কী না করেছেন। হজরত ওমর (রা.)-এর মতো একজন শাসকের বড় প্রয়োজন আজকের পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। হে আল্লাহ, পৃথিবীতে আরেকজন ওমর পাঠান। যিনি অন্যায়-জুলুম-অবিচারমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলবেন। যার সততা ও ন্যায়ের কারিশমা দেখে বালা-মুসিবত, আজাব-গজব, মহামারী করোনা দূর হয়ে যাবে। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে শান্তি-শৃঙ্খলা-সুস্থতা বিরাজ করবে।