আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ দুই ইনিংসেই নামল একই রকম ধস। ২০-৩০ রানের মধ্যে পাঁচটি করে উইকেট হারাল দুই দলই। পার্থক্য বলতে আফগানিস্তানের ধসটা নামল ইনিংসের শেষে। আর বাংলাদেশের একেবারে শুরুতেই।
আফগানরা ২১ রানে শেষ পাঁচ উইকেট হারানোয় তাদের ইনিংস প্রত্যাশিত আকার পেল না, কিন্তু তাদের ২১৫ রান তাড়া করতে নামা বাংলাদেশের জন্যও মুহূর্তেই জয় হয়ে গেল দূরের কোনো চূড়া। ২৮ রানেই নেই পাঁচ উইকেট। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসানের পর দলকে ৪৫ রানে রেখে ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে যখন ফিরলেন মাহমুদ উল্লাহও, তখন বিশাল হারকেই মনে হচ্ছিল ভবিতব্য, কিন্তু সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই অভাবিত এক জয়কাব্য লিখলেন এমন দুজন, যাঁদের একজনের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ফিফটিই ছিল না এর আগে। সেই আফিফ হোসেনের সঙ্গে জুটি বাঁধা মেহেদী হাসান মিরাজের আগে একটি ফিফটি ছিল, তবে এ রকম পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ জেতানোর সামর্থ্য পরীক্ষিত ছিল না কিছুতেই। বড় তারকারা আউট হওয়ার পর যখন দলের রিক্ত ও নিঃস্ব হওয়ার অপেক্ষা, তখনই সেই পরীক্ষায় উতরে যেতে দাঁড়িয়ে গেল আফিফ-মিরাজ জুটি।
পরীক্ষায় উতরেই শুধু গেলেন না, সপ্তম উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ১৭৪ রানের পার্টনারশিপে অবিশ্বাস্য এক জয়ের ফুলও ফোটালেন তাঁরা। সেই ফুলে গাঁথা হল রেকর্ডের মালাও। ওয়ানডে ইতিহাসের একাধিক সর্বকালীন রেকর্ডের চূড়ায় গিয়েও বসলেন আফিফ-মিরাজ। সাত বল বাকি থাকতে বাংলাদেশকে চার উইকেটে জিতিয়ে সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে নেওয়া এমন জুটিও এত দিন ছিল শুধুই স্বপ্ন। ৫০ রানের মধ্যে ছয় উইকেট হারানো কোনো দলের সপ্তম উইকেট জুটিতে ভর দিয়ে জেতার ঘটনা এর আগে ছিল মাত্র একটিই।
তা-ও ম্যাচ জেতানো সেই অবিচ্ছিন্ন পার্টনারশিপটি ছিল মাত্র ৫৫ রানের। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ৯৪ রানের মামুলি লক্ষ্য তাড়ায়ও ৩৯ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে বসেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে ডগ ওয়াল্টার্স ও গ্যারি গিলমোরের সপ্তম উইকেট জুটি ম্যাচ বের করেছিল। ৪৭ বছর পর তাঁদের বিপুল ব্যবধানে পেছনে ফেলে রেকর্ডটি নিজেদের করে নিলেন আফিফ-মিরাজ। সেই সঙ্গে তাঁদের হয়ে গেছে রান তাড়ায় সপ্তম উইকেটে সর্বোচ্চ পার্টনারশিপের রেকর্ডও। পেছনে পড়ে গেল ২০০৫ সালে ডাম্বুলায় ভারতের বিপক্ষে মাহেলা জয়াবর্ধনে এবং উপুল চন্দনার অবিচ্ছিন্ন ১২৬ রানও। এটি সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের সেরা পার্টনারশিপও, যা ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরাও। সপ্তম উইকেটে সেরা ১৭৭ রানের পার্টনারশিপ ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও আদিল রশিদের গড়া।
লক্ষ্য আরেকটু বড় হলে সেটিও নিশ্চিতভাবেই ভেঙে যেত। অথচ একসময় এক শর কমে অল আউট হওয়ার শঙ্কা জাগানো ব্যাটিংয়ের পর জয়ের কথা ভাবারও দুঃসাহস হচ্ছিল না বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের। ম্যাচের পর সেই স্বীকারোক্তিই শোনা গেল তাঁর কথায়, ‘যদি বলি যে ৪৫ রানে ছয় উইকেট হারানোর পরও জয়ের কথা ভাবছিলাম, তাহলে মিথ্যাই বলা হবে। সত্যিই আমি ভাবিনি যে জিতব। ’ প্রথমে সেই বিপর্যয় সামলে এবং পরে পাল্টা আক্রমণে সব কাঁটা সরিয়ে জয়ের তীর দেখানো জুটির আফিফ ১১৫ বলে এক ছক্কা ও ১১ চারে সাজালেন তাঁর ৯৩ রানের হার না মানা ইনিংসটি। অন্যদিকে মিরাজের ১২০ বলে অপরাজিত ৮৩ রানের ইনিংসে চারের মার ৯টি।
দুজনের মধ্যে একজনকে ম্যাচসেরা বেছে নেওয়াও ছিল কঠিন। সেটি একটু সহজ করে দেয় মিরাজের বোলিংও। উইকেট পাননি, কিন্তু ১০ ওভারের টানা স্পেলে তিনটি মেডেনসহ মাত্র ২৮ রান দেওয়াটা তাঁর মিতব্যয়ী বোলিংয়ের সাক্ষ্যও দিচ্ছে। ইকোনমি রেটেও (২.৮০) নিজ দলের বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে এই অফস্পিনারই। মিরাজ রান আটকেছেন, সেই সঙ্গে মুস্তাফিজুর রহমান (৩/৩৫), শরীফুল ইসলাম (২/৩৮), সাকিব (২/৫০) এবং তাসকিন আহমেদরাও (২/৫৫) ফুটিয়ে তুলেছেন সম্মিলিত প্রচেষ্টার দারুণ এক ছবি। তাই আফগানদের ইনিংসেও বড় কোনো জুটি গড়ে উঠতে পারেনি। ফিফটি পার্টনারশিপ মাত্র একটি। প্রায় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা নজিবউল্লাহ জাদরান (৬৭) ছাড়া ফিফটিও নেই আর কারো ব্যাটে, কিন্তু আফগানদের এত অল্পতে বেঁধে ফেলা পারফরম্যান্সও বিসর্জনে যেতে বসেছিল। নিশ্চিত হারের বিষাদও যেন গ্রাস করতে শুরু করেছিল বাংলাদেশকে। বিশেষ করে আফগান বাঁ-হাতি ফাস্ট বোলার ফজল হক ফারুকি হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান আতঙ্কই। পাঁচ ওভারের প্রথম স্পেলেই ১৯ রানে চার উইকেট তুলে নেন তিনি। অবশ্য এত খারাপ না হলেও কাছাকাছি পরিস্থিতি থেকে এর আগেও ম্যাচ জেতার নজির আছে বাংলাদেশের। ২০১৭-এর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করা জয়টিই যেমন। ৩৩ রানে চার উইকেট হারানোর পর সাকিব ও মাহমুদ উল্লাহর ২২৪ রানের পঞ্চম উইকেট জুটি জিতিয়েছিল বাংলাদেশকে। সেই দুজন কালও জুটি বাঁধলেন, কিন্তু দুজনেই স্পিনারের বল জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলার খেসারত দিলেন। জয়ের আশাও যেন মিলিয়ে গিয়েছিল সেখানেই।
আফিফ-মিরাজ সেই ধ্বংসস্তূপেই হয়ে উঠলেন এক জোড়া ফিনিক্স পাখি!