বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে তুলা আমদানি করছে বাংলাদেশ

বস্ত্র শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করতে হচ্ছে। অথচ দেশেই তুলা উৎপাদন একটি বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। উপযুক্ত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে ১০ লাখ বেল তুলা উৎপাদন করা সম্ভব। যা দেশীয় স্পিনিং মিলের প্রায় ১৫ শতাংশ কাঁচা তুলার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে। ওই লক্ষ্যে দেশের তুলার চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেজন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তুলা চাষের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ৬৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেয়া ‘তুলার গবেষণা উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশে তুলার আমদানি কমবে। তাতে সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা। তুলা উন্নয়ন বোর্ড এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে তুলা উৎপাদন বাড়নোর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তুলার উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহনশীল জাতের উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি আঁশের গুণগত

মানেরও উন্নতি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনশীল এলাকায় তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য জলবায়ু অভিযোজনশীল তুলার জাত এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হবে। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। সরকারের নিজস্ব তহবিল (জিওবি) থেকে প্রকল্প ব্যয়ের পুরোটাই অর্থায়ন করা হবে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড চলতি বছর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।

সূত্র জানায়, দেশের বস্ত্র শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে তুলা একটি অর্থকরি ফসল। দেশে তুলার চাহিদা প্রায় ৬০ লাখ বেল। তার বিপরীতে বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার বেল তুলা উৎপাদন হয়। অন্যান্য দেশের তুলার গড় ফলনের তুলনায় এদেশে তুলা উৎপাদন কম। তুলাকে লাভজনক করার জন্য উচ্চফলনশীল, বিটি কটনের চাষ এবং তুলা চাষের আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োজন। বর্তমানে দেশের গার্মেন্টস কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়ের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশের কারখানায় তুলার চাহিদার ৯৭ শতাংশ আমদানি করা হয়। ভারত, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ওই তুলা আমদানি করা হয়।

সূত্র আরো জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উচ্চফলনশীল, জলবায়ু অভিযোজনশীল, স্বল্পমেয়াদি, খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল এবং মানসম্পন্ন আঁশ উৎপাদনকারী জাতের উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম সম্পাদনে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সক্ষমতা বাড়বে। কৃষকের আয় বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনেও সহায়ক হবে। সাত বিভাগের ৪২টি জেলার ১৩৪ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের আওতায় ৪ হাজার ৩০০টি অনফার্ম ট্রায়াল বা আদর্শ ট্রায়ালসহ ৫ থেকে ৭ টন হাইব্রিড তুলা বীজ উৎপাদন করা হবে। ৩০০ বৈজ্ঞানিক সহকারী, ১ হাজার ৮০০ জন সম্প্রসারণের সঙ্গে যুক্ত জনবল, ১ হাজার ২০০ আদর্শ তুলা চাষি, ১৫ হাজার তালিকাভুক্ত চাষি এবং ৩০০ কর্মকর্তারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তুলা একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে বেশ কয়েকটি ফসলের মধ্যে তুলা ফসলের গবেষণার ওপর জোর দেয়া হবে মর্মেও ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ কটন এ্যাসোসিয়েশন সংশ্লিষ্টদের মতে, গতবছর তুলা আমদানি হয়েছে ৭০ লাখ বেল। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার গার্মেন্টস কারখানায় ৪২৫টি স্পিনিং মিল ও প্রায় ৮শ’টির মতো টেঙ্টাইল কারখানায় আমদানি করা তুলা থেকে তৈরি সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশ গার্মেন্টসের জন্য ভারত থেকে আমদানিকৃত মোট তুলার ৪৬ শতাংশ আসে। পার্শ্ববর্তী দেশ বলে দূরত্ব কম হবার কারণে পরিবহন খরচ ও সময় কম লাগে। ওই কারণে তুলা থেকে ফেব্রিক উৎপাদন খরচও কমে আসে। কিন্তু তুলা চাষ করতে বেশি সময় লাগে বিধায় কৃষকরা জমিতে তুলা চাষ করতে চায় না। জমিতে চাষ করা তুলা উঠতে সময় লাগে ৬ মাস। আর ওই ছয় মাসে কৃষক দুটি শস্য তুলতে পারে। তবে প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষককে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বিগত ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে স্থানীয়ভাবে তুলার উৎপাদনের গুরুত্ব অনুভূত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহহ স্বাধীনতার পর তুলার গুরুত্ব অনুধাবন করে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। দেশে ২০১৮-১৯ মৌসুমে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৪টি অঞ্চল, ১৩টি জোন ও ১৯৫টি ইউনিটের মাধ্যমে ৪০ জেলায় ৪৪ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমিতে তুলা আবাদ করে ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৭০ বেল আঁশ তুলার উৎপাদন করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৮১ লাখ বেল তুলা আমদানি করা হয়েছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০ হাজার কোটি টাকা। ওই সেক্টরে বর্তমানে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫৫ লাখ।

অন্যদিকে তুলাবীজ থেকে ক্রুডওয়েল (অপরিশোধিত তেল) এবং রিফাইনারি মেশিনের মাধ্যমে ভোজ্য তেলও উৎপাদন করা যায়। তুলা উৎপাদন বাড়লে ভোজ্য তেলের সরবরাহও বাড়ানো সম্ভব হবে। ফলে তেল আমদানি কমানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে। তুলার খৈল গরু, মহিষ, ছাগল, মাছের খাদ্য ও জমিতে জৈব পদার্থের জন্য ব্যবহৃত হয়। তুলা গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তুলা গাছ থেকে তৈরি করা যায় পরিবেশবান্ধব পার্টিকেল বোর্ড। তুলা উৎপাদন বাড়ানোর মধ্যে দেশের স্পিনিং কারখানাগুলোর চাহিদা দেশীয় তুলা দিয়ে পূরণের পাশাপাশি বাড়তি ওসব সুবিধার কথাও বিবেচনা করছে সরকার। ওই কারণেই উন্নত জাতের

তুলা ও তুলা বীজ উন্নয়নে গবেষণা প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।

প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ মতামত দিতে গিয়ে বলেছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উচ্চফলনশীল, জলবায়ু অভিযোজনশীল, স্বল্পমেয়াদি, খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল এবং মানসম্পন্ন আঁশ উৎপাদনকারী জাতের উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম সম্পাদনে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সক্ষমতা বাড়বে। তাতে আমদানি কমানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তাছাড়া প্রকল্পটিতে কৃষকের আয় বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃজনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

SHARE THIS ARTICLE