আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ছোটো নৌকা নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীদের ঠেকানোর ‘শেষ অস্ত্র’ হিসেবে অনিয়মিত অভিবাসন বিলটিতে পার্লামেন্টের অনুমোদন পেল যুক্তরাজ্য সরকার৷ সোমবার রাতে উচ্চকক্ষের বেশিরভাগ সংশোধনী খারিজ করে বিলটি পাশ করাতে সক্ষম হয় ঋষি সুনাকের দল৷ রাজার সম্মতি পেলেই আইনে পরিণত হবে বিলটি ৷
কিন্তু যুক্তরাজ্যের ‘অনিয়মিত অভিবাসন বিল’ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ৷
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, বিলটি ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং শরণার্থী আইনের অধীনে একটি দেশের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রয়োজন এমন মানুষের জন্য করুণ পরিণতি ডেকে আনবে৷’
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, ‘‘দশকের পর দশক ধরে, আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে যুক্তরাজ্য আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আসছে৷ এটি এমন এক ঐতিহ্য, যা একটি দেশকে গৌরবান্বিত করে৷ কিন্তু এই নতুন আইনটি আশ্রয়প্রার্থী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আইনি কাঠামোকে উপেক্ষা করে শরণার্থীদের মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলবে৷’’
ছোটো নৌকায় আসা আইন বর্হিভূত
বিলটি আইনে রূপ নেয়ার পর অনিয়মিত অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশে, বিশেষ করে ছোট নৌকায় চড়ে যারা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসছেন তাদের জন্য বড় ধরনের বাধা তৈরি করবে৷
নতুন এই আইন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসাকে ‘আইন বর্হিভূত’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ফলে, যারা এই অভিবাসন রুট দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসবেন, তারা দেশটিতে আশ্রয় চাওয়ার অধিকার হারাবেন৷ কারণ, আইনটি সেই অধিকার কেড়ে নেবে৷
শুধু তাই নয়, এই আইনের আওতায় চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিজ দেশে অথবা নিরাপদ তৃতীয় দেশে কিংবা যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর আগে যে দেশ হয়ে এসেছেন, সেসবের কোনও একটি দেশে ফেরত পাঠাতে পারবে সরকার৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ৫৭টি দেশকে নিরাপদ মনে করে যুক্তরাজ্য৷ তবে কাউকে নিরাপদ তৃতীয় দেশে ফেরত পাঠাতে হলে সেই দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের চুক্তির প্রয়োজন হবে৷
ব্রেক্সিটের মধ্যে দিয়ে ইইউ ছেড়ে আসা এবং ডাবলিন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে এই সহযোগিতা প্রক্রিয়া যুক্তরাজ্যের জন্য কঠিন হয়ে গেছে৷ কারণ ইইউ বা ডাবলিন চুক্তি একজন অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থীকে প্রথম যে দেশটিতে পা রেখেছেন সেই দেশে ফেরত পাঠানোর অধিকার দেয়৷
‘অনিয়মিত পথে যুক্তরাজ্যে আসা ব্যক্তিকে আটক ও অপসারণ আইনি দায়িত্ব’
সুনাক প্রশাসন আশা করছে, বিলটি আইন আকারে কার্যকর হলেই চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা ‘ছোট নৌকা বন্ধ করার’ যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছে তা পূরণ হবে এবং অনিয়মিত পথে যারা যুক্তরাজ্যে এসেছেন তাদের আশ্রয় আবেদনে এটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে৷ আর এই বিলটি যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানকে ‘অনিয়মিতভাবে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করা ব্যক্তিকে আটক এবং অপসারণে আইনি দায়িত্ব’ দেবে৷
পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউজ অব লর্ডস বিলটিতে একাধিক সংশোধনী আনার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু ১৭ জুলাই গভীর রাতে অধিবেশনে ভোটাভুটির সময় বেশিরভাগ সংশোধনী ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে৷
আইনের পূর্বমুখী প্রয়োগ
এ বছরের ৭ মার্চের আগে যারা যুক্তরাজ্যে এসেছেন, তাদের জন্য এই নতুন আইনটি কার্যকর হবে না৷ আর ৭ মার্চ থেকে এর পর যারা এসেছেন তাদের যদি একবার অপসারণ করা হয়, তবে নাগরিকত্ব পাওয়া বা যুক্তরাজ্যে পুনঃপ্রবেশে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন৷
অভিভাবকহীন শিশুদের বয়স ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাদের যুক্তরাজ্যে থাকার সুযোগ দেয়া হবে৷ তবে ১৮ এর পরে তাদের ফেরত পাঠানোর অধিকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আওতায় থাকবে৷
ইউকে ইন চেঞ্জ ইন ইউরোপ-এর ওয়েবসাইটে দেয়া এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, তবে কোনো ব্যক্তিকে সরকার অপসারণ করতে চাইলে, সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জের জন্য সাত দিন সময় দেয়া হবে৷ তবে মানবাধিকার ইস্যুতে চ্যালেঞ্জ জানালে ওই ব্যক্তিকে যুক্তরাজ্য থেকে অপসারণের পরই দেশটির আদালত তা বিবেচনা করবে৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ?
১৯৫১ সালের রিফউজি কনভেনশন একজন ব্যক্তিকে একটি দেশে প্রবেশের পর সেই দেশে আশ্রয় চাওয়ার অধিকার দেয়, কিন্তু সেজন্য তাকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় না৷
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বিলটি নিয়ে বিতর্কের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, রিফউজি কনভেনশনের সঙ্গে এই আইনটি সঙ্গতিপূর্ণ কিনা৷
ব্র্যাভারম্যান নিজেও একজন আইনজীবী এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল৷ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বিলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা আমাদের সব আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত৷’’
কিন্তু জাতিসংঘ তার কথার সঙ্গে একমত নয়৷ আর এ কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর৷ সংস্থাটি বলছে, অনিয়মিতভাবে যিনি যুক্তরাজ্যে আসবেন তার আশ্রয় চাওয়ার অধিকার কেড়ে নেবে এই বিল৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনা
আইন আকারে জারি হতে যাওয়া যুক্তরাজ্যের এই বিলটি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনার ইলফা ইয়োহানসন৷
বিলটি উপস্থাপনের পর থেকেই তিনি যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলে আসছেন, ‘‘এটি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে আমি মনে করি৷’’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম পলিটিকোকে তিনি বলেন, ‘‘এটি খুবই খুবই ধীর গতির আশ্রয় প্রক্রিয়া৷’ তিনি আরো বলেন, ‘‘আটক করার আগে আপনার কাছে আসা ব্যক্তিদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন থাকা উচিত৷’