ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার: করোনাভাইরাস (COVID-19) সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে অনেকেই শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহি হয়েছেন। দেহের প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে যথাসম্ভব শক্তিশালী রাখা আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন, বিশেষ করে কোভিড মহামারীর সময়ে।
একটি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যে রকম বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশরক্ষায় একত্রে কাজ করে থাকে ঠিক একইভাবে মানুষের শরীরে ইমিউন সিস্টেম একটি জটিল নেটওয়ার্ক, যা যে কোন ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একসাথে কাজ করে, এক্ষেত্রে ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য শত্রুর বিরুদ্ধে।
যেহেতু এটি একক ইউনিট নয়, শরীরের বিভিন্ন অংগ এই প্রতিরোধ ব্যাবস্থার সাথে জড়িত তাই একটি অংগকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে পুরো প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে আমরা শক্তিশালী করতে পারিনা। তবে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন অঙ্গকে শক্তিশালী করা সম্ভব। তাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করে আমাদের দেহের সৈন্য বাহিনীকে কর্মক্ষম এবং প্রস্তুত রাখা আমাদের দায়িত্ব।
যদিও কোভিড চিকিৎসায় ভাইরাস নাশক সম্পুর্ন সফল সুনির্দিষ্ট কোন ঔষধ আজো আবিষ্কৃত হয়নি কিংবা কোভিড নামক ভাইরাস থেকে নিজেদের প্রতিরোধ করার মত সুনির্দিষ্ট কিছু পথ্য এখনো পাওয়া যায়নি তবুও সার্বিক প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাকে যতটা সম্ভব শক্তিশালী করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। এই পদক্ষেপগুলো ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করবে এটা অবধারিত কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে আমাদেরকে সুনিশ্চিতভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে তা আমরা হলপ করে বলতে পারিনা। তবে শক্তিশালী একটা ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারবে এটা সুনিশ্চিত।
প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এই কাজ করা যেতে পারে?
১।নিয়মিত ব্যায়াম– প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম করা হলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকে।
২।স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য – যেমন প্রচুর শাক, সবজী ও ফলমূল আমাদের প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য সবচেয়ে ভাল।
৩।স্বাস্থ্যকর ওজন– বেজাল মেটাবলিক ইনডেক্স (বি এম আই) ২৫ কিংবা তার কম রাখা উত্তম আর এই ওজন ধারণ করার জন্য সর্বোত্তম উপায় হ’ল ব্যায়াম এবং একটি স্বাস্থ্যকর, সুষম খাদ্য।
৪।উন্নত মানের ঘুম– নির্ধারিত সময়ে প্রতিদিন ঘুমানো শরীরের জন্য উত্তম এবং ভাল ঘুমের চর্চা করা উত্তম ।
৫।দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ হ্রাস করার জন্য হাসি খুশী, প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ, বাগান করা ইত্যাদি অন্যতম।
৬।ধূমপান ত্যাগ- ধূমপান প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য মারাত্নক অন্তরায় তাই ধূমপান পরিত্যাগ অপরিহার্য্য।
৭।মদ্যপান ত্যাগ – মদ্যপান শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে তাই মদ্য পরিহার অত্যাবশ্যক।
৮।সংক্রমণ প্রতিরোধের পদক্ষেপ– ঘন ঘন হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্য্যকর।
ইমিউন সিস্টেমকে সহায়তায় কার্য্যকরী উপাদান সমূহঃ
১। ভিটামিন সি; ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ রোধ করে ভিটামিন সি সর্দি-কাশির সময়কাল হ্রাস করে এবং প্রাকৃতিক অ্যান্টিহিস্টামিন এবং এন্টি-ইনফ্লেমেটরি হিসাবে কাজ করতে পারে।
২। ভিটামিন ডি; একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা-শক্তিশালী পুষ্টি যা সর্দি এবং ফ্লুর ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে; এটি নিয়মিতভাবে নেওয়া উচিত।
৩। ভিটামিন এ; স্বল্পমেয়াদের জন্য ভিটামিন এ ব্যবহার করা উত্তম, শরীরের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, বিশেষতঃ শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণ রোধে ভিটামিন এ কার্য্যকর।
৪। জিংক; সংক্রমণ শুরু হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে নেওয়া হলে সংক্রমণ এবং সর্দির সময়কাল হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে।
৫। সেলেনিয়াম; ইমিউন ফাংশনের জন্য একটি মূল পুষ্টি এবং এটি ব্রাজিল বাদামের মতো খাবার থেকে সহজেই পাওয়া যায়। এছাড়াও সেলেনিয়াম একটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করে।
৬। কাঁচা মধু; নাক এবং মুখের মতো শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির ক্ষতিকারক ব্যথা এবং প্রদাহ দূর করতে কাচা মধু ভালো। মধুতে এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং কিছু এন্টিমাইক্রোবায়াল প্রভাব রয়েছে; এটি কাশি এবং গলা ব্যথার জন্য সহায়ক এবং এটি চা কিংবা লেবুর সাথে গরম পানিতে যুক্ত করা যেতে পারে।
৭।রসুন; শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণের তীব্রতা হ্রাস করতে পারে এবং সাধারণ সর্দি-ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কার্যকরী হতে পারে।
৮।প্রোবায়োটিক; প্রোবায়োটিকগুলিতে “ভাল ব্যাকটিরিয়া” থাকে যা অন্ত্রের কার্য্যক্রমকে সহায়তা করে, ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা এবং নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করে। এগুলি শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ হ্রাস করতে পারে, বিশেষত বাচ্চাদের মধ্যে।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা নিয়ে গবেষণা অব্যাহত আছে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় নিম্নলিখিত অতিরিক্ত কিছু পথ্য কার্য্যকরী বলে মনে করা হচ্ছে:
১।বিটা–গ্লুকানস– বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে বিটা-গ্লুকান শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি করতে সক্ষম ।
২।মাশরুম – মাশরুমের বিভিন্ন প্রজাতি প্রতিরোধ ক্ষমতাতে সহায়তা করে থাকে বলে কিছু গবেষণায় দেখানো হয়েছে; প্রজাতিগুলোর মধ্যে মধ্যে রয়েছে শাইতাকে, সিংহের কেশর, মাইতেকে এবং রিশি অন্যতম।
৩।বারবারিন – বিভিন্ন গাছের শিকড়, রাইজোম এবং কান্ডের খোসার মধ্যে পাওয়া যায়। এই প্রাকৃতিক যৌগটি অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্যযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে; এটি গোল্ডেনসিল, গোল্ডথ্রেড এবং ওরেগন প্রজাতির আঙ্গুরের মধ্যে পাওয়া যায়।
৪।সালফোরাফেইন – সালফোরাফানে শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টি-ভাইরাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে; কিছু ক্রুসিফেরাস শাকসব্জী খেলে বা গ্লুকোরাফিনিন এবং মাইরোসিনেজ এনজাইমযুক্ত খাবারে পাওয়া যায়।
৫।এলডারবেরি – গবেষণায় দেখা গেছে যে এল্ডারবেরিতে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
সকলের অনুধাবনের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ যে উপরে উল্লেখিত বক্তব্য শুধুই পরামর্শ; এব্যাপারে আরও গবেষণা চলছে। আমাদের মধ্যে কেউ যদি এগুলি চেষ্টা করতে আগহী হন তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং যদি কেউ কোন উপাদান গ্রহণ করেন তাহলে অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক অন্যথায় অতিরিক্ত গ্রহণের কুফল প্রদর্শিত হতে পারে।
পাঠকদের মধ্য থেকে কেউ অসুস্থ বোধ করলে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।।
সূত্রঃ
১। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/26118561
২। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/30920354
৩।
৪। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/27881064
৫। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/23440782
৬। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/29080635
৭। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/28515951
৮। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/30670267