আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার বড়ি মলনুপিরাভির। যা বাংলাদেশের বাজারেও এখন পাওয়া যাচ্ছে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ইমোরিভির, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসের মনলুপিরাভির এরইমধ্যে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা এই ওষুধটিকে দেখছেন করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় মোড়-পরিবর্তনকারী কিম্বা গেমচেঞ্জার ড্রাগ হিসেবে। তারা বলছেন, এই ওষুধ পরিস্থিতি বদলাতে সাহায্য করবে।
কোভিড-নাইনটিনের চিকিৎসায় এই মলনুপিরাভির বিশ্বের প্রথম মুখে খাওয়ার ওষুধ। এটি ঘরে বসেই সাধারণ যেকোনো ট্যাবলেটের মতো খাওয়া যাবে। এজন্য হাসপাতালে যাওয়া কিম্বা কোন ডাক্তার বা নার্সের সহায়তার প্রয়োজন হবে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই ওষুধটি খেলে রোগীর গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিম্বা মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পৌনে আটশর মতো রোগীর ওপর এই ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মার্ক, শার্প এন্ড ডোম এবং রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিকস এই ওষুধটি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশেও ঔষধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ ঔষধটির জরুরি ব্যবহার, বিপণন ও উৎপাদনের অনুমোদন দেবার পর এরই মধ্যে ঔষধটি বাজারে নিয়ে এসেছে অন্তত তিনটি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। মলনুপিরাভির তৈরি করা হয়েছিল মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য। পরে তাতে কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, ওই ওষুধটি করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোডের মধ্যে কিছু ত্রুটির জন্ম দেয়। তখন সেটি আর শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে না।
যেভাবে কাজ করে
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, “শরীরের ভেতরে যখন করোনাভাইরাস প্রবেশ করে তখন তার অনেক কপি তৈরি করতে হয়। এই কপি করার মূল প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে মলনুপিরাভির।
‘ড্রাগটি বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি তৈরি করে যাতে জিনগুলো বুঝতে না পারে যে সে কোন প্রোটিন তৈরি করবে। যখন বিভিন্ন প্রজন্মে এই ভাইরাস তৈরি হতে থাকে তখন ত্রুটির সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
তিনি বলেন, ভাইরাসটি তখনও বুঝতে পারে না তার ভেতরে কী পরিমাণ ত্রুটি প্রবেশ করেছে। কিন্তু ভাইরাসটি মনে করে যে সে বুঝি তৈরি করেই যাচ্ছে। এবং একটা সময় ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মলনুপিরাভিরের যে রাসায়নিক কাঠামো সেটা দেখতে ভাইরাসের কপি তৈরি করার টেম্পলেট বা নকশার মতো। একারণে সে এটাকে ঘুরিয়ে দিতে পারে।
এদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, মলনুপিরাভিরের রাসায়নিক পদার্থগুলো খুব দ্রুতই রোগীর রক্তের ভেতরে গিয়ে ভাইরাসকে নির্মূল করার কাজ শুরু করে দিতে পারে। প্রাণীর ওপর চালানো পরীক্ষায় দেখা গেছে ১২ ঘণ্টা পরেই এই ওষুধটিকে বেশ কার্যকর দেখায় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এটি ভাইরাসকে শূন্য করে ফেলতে পারে।
অন্যদিকে মানুষের ওপর চালানো পরীক্ষার ফলাফল হচ্ছে: তিনদিন পরেই ভাইরাস অনেক কমে গেছে কিন্তু ভাইরাসটি পুরোপুরি ধ্বংস হতে সময় লেগেছে পাঁচদিন।
আঠারো বছরের নীচের বয়সী কারো ওপর এই ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। গর্ভবতী নারীকেও এই ওষুধটি দেওয়া হয়নি। ফলে তাদের শরীরে মলনুপিরাভির কাজ করবে কি না সেটা পরিষ্কার নয়।
রোবেদ আমিন বলছেন, ‘যারা বয়স্ক মানুষ, যাদের অন্তত একটি রিস্ক ফ্যাক্টর ছিল, তাদের অসুস্থতা যখন মৃদু থেকে মাঝারি, তাদের শরীরে এই সময়ে ওষুধটি সবচেয়ে ভাল কাজ করে বলে পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে। কিন্তু কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন এই ওষুধটি আসলে কাজ করে না।
টিকার বিকল্প নয়
ডাক্তাররা বলছেন, কোভিড টিকা নেওয়া সত্ত্বেও কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার উপসর্গ যদি মৃদু থেকে মাঝারি হয় তাহলে তারাও এই ওষুধটি সেবন করতে পারবেন।
চিকিৎসকরা মনে করেন, মহামারি মোকাবেলায় এই মলনুপিরাভির যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে।
রোবেদ আমিন বলেন, কেউ আক্রান্ত হলে যদি তার উপসর্গ শুরু হয়ে যায়, তাহলে এমন কোন পদ্ধতি কিন্তু এখনও পর্যন্ত নেই যা তার গুরুতর অসুস্থতাকে কমাতে পারবে, কী দিলে সেটা হবে তা এখনও পর্যন্ত কেউ বলতে পারে নাই। কিন্তু মলনুপিরাভির এই কাজটা করতে পারছে বলে বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে।
তবে চিকিৎসকরা মুখে খাওয়ার এই ওষুধটিকে টিকার বিকল্প হিসেবে না দেখার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, টিকা দেওয়া হয় সুস্থ মানুষকে যাতে রোগটি তাকে আক্রান্ত করতে না পারে। আর মলনুপিরাভির দেওয়া হবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলার জন্য। একারণে কোভিড টিকা নেওয়ার কোন বিকল্প নেই।
দাম কত, কোথায় পাবেন?
বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্রতিটি ক্যাপসুলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ৫০ টাকা। এই দাম সবগুলো কোম্পানির জন্যই প্রযোজ্য বলে জানিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন।
তিনি বলেন, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন খরচসহ অন্যান্য ব্যয় হিসাব করে একটা দাম নির্ধারণ করেছে। ওই দাম প্রস্তাব করার পর অধিদপ্তর যাচাইবাছাই করে তা অনুমোদন দিয়েছে।
‘তারা ক্যালকুলেশন করে একটা প্রাইস আমাদের কাছে সাবমিট করে। আমরা সেটা দেখে যদি যুক্তিযুক্ত মনে হয়, তাহলে ওই দামের অনুমোদন দিই। মলনুপিরাভিরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। উনারা প্রপোজ করেছেন আমরা যাচাইবাছাই করে ৫০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছি। প্রতিটি কোম্পানিই এই ওষুধ এই দামে বিক্রি করবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমিত হলে টানা পাঁচ দিন খেতে হবে এই ওষুধ। ২০০ মিলিগ্রামের ৪টি করে ক্যাপসুল দৈনিক দুই বার খেতে হবে। সে হিসেবে করোনাভাইরাস আক্রান্ত একজন রোগীকে পাঁচ দিনে ২ হাজার টাকার ওষুধ সেবন করতে হবে।
এখন পর্যন্ত বাজারে আসা দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ক্যাপসুল ৫০ টাকা করে রাখছে, তবে প্রথম আসা বেক্সিমকোর ক্যাপসুল বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৭০ টাকায়।
এখন ঢাকায় করোনাভাইরাসের চিকিৎসা হয় এমন হাসপাতালগুলোর আশপাশের ফার্মেসিতে এই ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, সিলেটে অল্প অ্লপ করে সরবরাহ করেছি। ধীরে ধীরে সারাদেশেই পাঠানো হবে।