এ, কে, আজাদ – আইরিশ বাংলা পোষ্ট ডেস্কঃ করোনাভাইরাসের কারণে এখন পুরো বিশ্ব অবরুদ্ধ। বন্ধ আছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ঘর থেকে বের হতে পারছে না মানুষ। রেমিট্যান্স পাঠানো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে আশা জাগানো প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লেগেছে। রেমিট্যান্স আহরণের দেশগুলোর অচলাবস্থায় বেকার হয়ে পড়ছেন অনেক প্রবাসী। সামনের দিনগুলো প্রবাসীদের জন্য কঠিন হওয়ার পাশাপাশি অব্যাহত থাকবে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক ধারা বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা।
এদিকে বেশিরভাগ দেশে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না। কিছু কিছু দেশ থেকে অনলাইনে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকলেও দক্ষতার অভাবে তা কাজে লাগাতে পারছে না। এতে গত ১০-১৫ দিনে ধরে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রায় বন্ধ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্চের শুরু থেকেই অনেক দেশ অবরুদ্ধ। সব মানুষ ঘরে বন্দি। দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছে না। কাজ নেই, আয়ের পথও বন্ধ। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে নিজেদের খরচ মেটানোই দায় হয়ে যাবে।
এমনই একজন ফেনীর প্রবাসী বাচ্চু মিয়া। ১৮ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। খামিজ মুশায়েতে একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কাজ কম। তার আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও রিনিউ করছে না মালিক। নাম মাত্র বেতনে কাজ করছে সে। মার্চে ওমরা বন্ধ করায় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তিন সপ্তাহ ধরে বেকার মক্কায় অবস্থানরত হাজারো বাংলাদেশী । ঘর থেকে বের হতে পারেন না। আগের কিছু পাওনা অর্থ কারখানার মালিক দিয়েছিল, তা দিয়েই ২০ দিন চলছে।
তাদের অনেকেই বলছেন , মা-বউ-বাচ্চা দেশে আছে। তাদের খরচ পাঠানো দরকার। কিন্তু কাজ বন্ধ নিজেরই থাকা খাওয়ার খরচ নাই, দেশে টাকা পাঠাবো কীভাবে। এছাড়া সব বন্ধ, বের হলে পুলিশ ঝামেলা করে। তাই বাইরে যাই না, ঘরেই থাকছি। কয়দিন নামাজের জন্য বের হয়েছি কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে তাও বন্ধ। খুব সমস্যায় আছি।
দেশের রেমিট্যান্স আহরণের সবচেয়ে বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশ সৌদি আরব। করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৫ মার্চ থেকে দেশটিতে লকডাউন চলছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য দোকানপাট অফিস-আদালত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। গৃহবন্দি হয়ে আছে সবাই। ফলে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছে না প্রবাসীরা। অনলাইনে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকলেও তা অনেকে বোঝেন না, ফলে দেশে অর্থ পাঠাতে পারছেন না।
সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখানকার প্রবাসীদের অনেকের কাজ নেই। খুব কষ্টে দিন পার করছেন। এ অবস্থা আর কিছু দিন চললে এ দেশে থাকাই দায় হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
করোনার প্রার্দুভাবের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে মোর্শেদ আলম লিটন জানান, কয়েক সপ্তাহ ধরে নিউইয়র্ক প্রায় অচল। সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ। রেমিট্যান্স পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে কাজ বন্ধ হলে কর্মহীন অবসর সময় কাটান বেশিরভাগ প্রবাসী। দেশটিতে এ পর্যন্ত করোনায় ৫৩ প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন। আক্রান্তের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন পৃথিবীর শীর্ষে- এ সংখ্যা দুই লাখ ৩৫ হাজার ৭৪৭ জন। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির হাসপাতাল ও অন্য সেবা সংস্থাগুলো।
স্পেন থেকে ফিরোজ আলম বিপুল জানান, এখানে পুরো লকডাউন, কাজকর্ম বন্ধ। ঘর থেকে কেউ বের হতে পারে না। সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ। দোকানপাট বন্ধ থাকায় সরাসরি রেমিট্যান্স পাঠানো যাচ্ছে না। তবে অনলাইনে রেমিট্যান্স পাঠানো যাচ্ছে।
ফেনীর দাগনভুইয়া উপজেলার বারাহীগুনী গ্রামের নাজমুন নাহার মুক্তা দীর্ঘ ২৭ বছর যাবত ইতালীতে স্বামী আহমেদ সাঈদ ও দুই কন্যা নিয়ে বসবাস করে আসছে। মৃত্যুপুরী যেন তার চতুরদিকে। অতংকে কাটছে তার জীবন। আজকে পর্যন্ত ইতালিতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার নয়শ ১৫ জনে। এখানে এই পর্যন্ত ৩ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইতালিতে প্রায় সবকিছু বন্ধ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। ইতালী প্রবাসীরা তেমন ভালো নেই, এমনটি জানালেন তিনি। তিনি আরো জানান, দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবে কয়েক জায়গায় রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকলেও অনেকেই বাসা থেকে বের হচ্ছেন না পুলিশের ভয়ে।
কুয়েত প্রতিনিধি নাছির উদ্দিন খোকন জানান, আগামী ৯ তারিখ পর্যন্ত কুয়েতের সব বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম অনলাইন। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ শ্রমিক অনলাইনে কীভাবে লেনদেন করতে হবে তা জানেন না; তাই রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না।
ওমান থেকে আক্তার হোসেন জানান, গত ১৮ মার্চ থেকে ওমানের সবকিছু বন্ধ। এ অবস্থা চলবে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। কেউ বাইরে বের হতে পারছেন না, কাজ নেই। এখন প্রবাসীদের নিজের খরচ চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকসহ মানি এক্সচেঞ্জগুলো বন্ধ থাকায় অনেকে চাইলেও রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মোসলে উদ্দিন জানান, গত মাসের শুরু থেকেই কাজ কম ছিল, মাঝামাঝিতে এসে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন প্রায় বেকার। নিজেই চলতে পারি না, দেশে টাকা পাঠাবো কীভাবে। প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশি টাকায় ২২ হাজার টাকা করে ঘর ভাড়া দিতে হয়। গত দুই সপ্তাহ কোনো কাজ নেই, কিন্তু খরচ তো থেমে নেই। এখন যে অবস্থা এটা আর কিছুদিন চললে দেশ থেকে টাকা আনতে হবে, এখানে খরচের জন্য!
বর্তমান পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স কমায় অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমলে দু’টি জায়গায় সরাসরি আঘাত হানবে একটি হলো নিম্নবিত্তদের অবস্থা করুণ হবে আর দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রথম ক্ষতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশ থেকে যারা বিদেশে কাজের জন্য গেছেন তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের। তাদের রেমিট্যান্সের টাকায় ওই পরিবারগুলো চলে। এতে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করছে। এখন যদি রেমিট্যান্স কমে তাহলে নিম্নবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পাশাপাশি দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাবে।
রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবাহের অন্যদিকটি সার্বিক অর্থনীতিতে পড়বে জানিয়ে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রেমিট্যান্স আমাদের সার্বিক অর্থনীতির চাহিদা পূরণে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। তাই রেমিট্যান্স যখন কম আসবে তখন দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে এতে আগামী ছয় মাস-এক বছরে এর উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। যাতে করে বেকার শ্রমিকরা দ্রুত কাজ পায়। যেসব জটিলতা রয়েছে তা সমাধান করতে সহায়তা করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত ফেব্রুয়ারির আগে প্রায় প্রতি মাসেই গড়ে ১৫ শতাংশের ওপরে রেমিট্যান্স আসত। বিশেষ করে রেমিট্যান্সের ওপরে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার পর রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরো বেড়ে যায়। সেই রেমিট্যান্সপ্রবাহ গত ফেব্রুয়ারির হিসাবে কমে ১০ শতাংশে নেমে গেছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। চলতি মার্চ মাসে রেমিট্যান্সপ্রবাহের অবস্থা আরো খারাপ।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৪ মার্চ পর্যন্ত ১১৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের মার্চের একই সময়ে এসেছিল ১২০ কোটি ডলার। এ হিসাবে রেমিট্যান্স কমেছে দুই কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আসে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে অবস্থান করছেন। এদের বড় একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। ইতালিতে বৈধ-অবৈধভাবে থাকেন প্রায় আড়াই লাখ। কিন্তু করোনায় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বেশির ভাগ মানুষ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
করোনাভাইরাসের কারণে পুরা বিশ্বই এখন অচল। এসময় রেমিট্যান্স কমাটাই স্বাভাবিক। আমাদের রেমিট্যান্স আহরণ এর প্রধান প্রধান যেমন সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্য, ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশগুলোও কঠিন অবস্থা পার করছে। সেখানে অনেক প্রবাসীর চাকরি চলে যাচ্ছে, ফলে ইনকাম নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠাবে দূরের কথা তাদের নিজেদের খরচ মেটানোও এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। এক সপ্তাহ ধরে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এটা গিগগিরই যে স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। রেমিট্যান্স আমাদের একটা বড় শক্তি। এটি কমে যাওয়া মানে অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতি বলে জানান ব্যাংকাররা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা অর্থবছর হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ।
এর ধারা অব্যাহত রাখতে গত অর্থবছরের বাজেটে রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনাসহ প্রবাসীরা যেন অর্থ সহজে পঠাতে পারেন এ জন্য বেশ কিছু শর্ত শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।