আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুলকে গ্রেপ্তার করেছে কুয়েত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগে শনিবার রাতে মুশরেফ আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম গতকাল রবিবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, সাংসদ পাপুলকে কুয়েতের সিআইডি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আমরা বিষয়টি খোঁজখবর রাখছি।
এদিকে স্বামীর গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুলের স্ত্রী ও সংরক্ষিত নারী আসনের (৩৪৯) সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম সিআইপি। তিনি একটি খুদে বার্তা পাঠিয়ে বলেন, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তার সম্পর্কিত যে তথ্য এসেছে তা ঠিক নয়। তিনি সেখানে কোনো মামলার আসামি নন। কুয়েত সরকার তাদের নিয়ম অনুযায়ী তার (পাপুল) ব্যবসায়িক বিষয়ে আলোচনার জন্য তাকে সরকারি দপ্তর বা সিআইডিতে ডেকে নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দূতাবাসের পরিষ্কার কোনো তথ্য ছাড়া কাউকে বিভ্রান্তি না ছড়ানোর অনুরোধ জানাচ্ছি। কুয়েত দূতাবাস কর্মকর্তা ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে ১০০ জনেরও বেশি ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করেছে কুয়েত সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ। এমপি কাজী পাপুলের নামও এই তালিকায় রয়েছে।
কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশি একজন সাংবাদিক নাসেরুদ্দিন খোকন আইরিশ বাংলাপোষ্টকে বলেন, কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুল গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কুয়েতে অবস্থান করছেন। অর্থ ও মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগে তিনি চলতি বছরের শুরু থেকেই কুয়েত পুলিশের ‘নজরদারি’র মধ্যে ছিলেন এবং সর্বশেষ শনিবার রাতে তাকে মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে কুয়েতের মুশরেফ আবাসিক এলাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। কুয়েতের গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত বড় কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি।’
এদিকে সাংসদ শহীদুল ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, হুন্ডি ব্যবসা ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান ও পাপুলের মেয়েসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান চলমান রয়েছে দুদকে। অনুসন্ধান প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং কমিশন দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে জানিয়েছে দুদক সূত্র।
গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি। তাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচারসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত উপায়ে শত শত কোটি টাকা অর্জন করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। কমিশনের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। দুদকে পাপুলের বিরুদ্ধে ১৭৪ পাতার অভিযোগ জমা হয়। দুদকের অনুসন্ধান শিরোনামে বলা হয়, ‘কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুল সংসদ সদস্য (লক্ষ্মীপুর-২) ও পরিচালক এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রধান কার্যালয়, ঢাকার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে গ্রাহক লোন বরাদ্দ করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ মানি লন্ডারিং করে বিদেশে পাচার এবং শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন।’
দুদকে জমা হওয়া নথি থেকে জানা গেছে, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এই পরিচালক বিদেশে ব্যবসার আড়ালে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। এর মধ্যে তিনি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৮০ কোটি টাকা হুন্ডি ও বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করেছেন। এ টাকার মধ্যে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মতিঝিল শাখার একটি হিসাবের মাধ্যমে ১৩২ কোটি টাকা ও প্রাইম ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা পাচার করেন। ইউসিবিএলের মাধ্যমে ১০ কোটি ও প্রাইম ব্যাংকে ঋণ সৃষ্টি করে ১০ কোটি টাকা পাচার করেন। বাকি টাকা পাপুল তার শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং জেডডব্লিউ লীলাবালি নামক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করেন। কয়েকজন ব্যাংক মালিক অর্থপাচারে পাপুলকে সহযোগিতা করেছেন।
দুদকে জমা হওয়া নথি অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন পাপুল, স্ত্রীর নামে একই ব্যাংকের ৩০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে অংশীদার হয়েছেন। গুলশান-১-এর ১৬ নম্বর সড়কে গাউসিয়া ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পে মেয়ে ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট, গুলশান-২-এর পিংক সিটির পেছনে গাউসিয়া ইসলামিয়া প্রকল্পে স্ত্রীর নামে ৯০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, স্ত্রী ও নিজের নামে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৯১ কোটি টাকার সম্পদ আছে। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের ঢাকার ওয়েজ আর্নার্স শাখায় স্ত্রীর নামে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার্স বন্ড ও মেয়ের নামে ২০ কোটি টাকার বন্ড আছে। শ্যালিকার নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনে নিজে ব্যবহার করছেন। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে নিজ নামে ৪০ কোটি, মেয়ের নামে ১০ কোটি ও স্ত্রীর নামে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় স্ত্রীর নামে একটি ছয়তলা বাড়ি আছে। এছাড়া শ্যালিকার নাম ব্যবহার করে দিগন্ত মিডিয়ার বেনামে পরিচালক ছিলেন পাপুল। ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর সঙ্গে তার বিপুল পরিমাণ ব্যবসা ছিল। মীর কাশেম আলীর ফাঁসি হওয়ার পর পাপুল তার বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগের তথ্য মতে, ব্যাংক পরিচালক হয়েও বেআইনিভাবে ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে চার পরিচালক বোর্ড সভায় অনুমতি ছাড়া ব্যাংক গ্যারান্টি সুবিধা ভোগ করছেন। এই ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে পাপুল রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে পাথর সরবরাহের ব্যবসা করেন। তার সহযোগী হিসেবে অভিযোগে লক্ষ্মীপুরের একটি উপজেলার চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের এক সদস্যের নামও উল্লেখ করা হয়েছে।’
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কুয়েত পুলিশের বরাত দিয়ে কুয়েতের আল-কাবাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, চক্রটি ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে কুয়েতে নেয়। যাতে তাদের ৫ কোটিরও বেশি কুয়েতি দিনার আয় হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাপুল নিয়মিতভাবে কুয়েত ও বাংলাদেশে যাতায়াত করেন। কখনো কুয়েতে ৪৮ ঘণ্টার বেশি থাকেন না। মানবপাচারের বিরুদ্ধে কুয়েত পুলিশের অভিযানের কথা জানতে পেরে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এছাড়াও তার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিতে পাঁচ মাস ধরে কর্মীদের বেতন বকেয়া রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কুয়েতে জনশক্তি রপ্তানির জন্য সরকারি কার্যাদেশ পেতে ঘুষ হিসেবে সেখানকার সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাদের পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি দেওয়ার তথ্য সামনে আসে।
জানা গেছে, পাপুল ক্লিনিং এবং সিকিউরিটির কাজের নামে মানবপাচার করে। পাপুল যে শুধু অবৈধ পথে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তা নয়, তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করছেন সব জায়গাতেই নিজের তথ্য গোপন রেখে ব্যবসা করেন।
লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মানবপাচার করে কুয়েতের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন পাপুল। তার কোম্পানির মাধ্যমে শ্রমিকদের কাছ থেকে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা করে নিয়ে তাদের কুয়েতে পাঠানো হয়েছে। অনেক শ্রমিক তাদের শ্রমের টাকা পাচ্ছেন না এমন অভিযোগের ভিডিও ছেড়েছেন অনেকে। লক্ষ্মীপুরের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হন কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুল। তার গ্রামের বাড়ি রায়পুর উপজেলার করোয়া গ্রামের কাজীবাড়ি। তার বাবার নাম কাজী নূরুল ইসলাম এবং মায়ের নাম তহুরুন নেছা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক পাস লেখা হয়েছে। তবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আশির দশকে কুয়েত যাওয়া পাপুল আউটসোর্সিং ও কনস্ট্রাকশন কাজ করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন। ২০১৬ সালের শেষের দিকে কুয়েতপ্রবাসী পাপুল লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে যান। তিনি রায়পুর পৌর শহরের আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাকি বিল্লাহের হাত ধরে রাজনীতি প্রবেশ করেন। পরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দিরসহ সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে ব্যাপক আর্থিক অনুদান দেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেকে সর্বমহলে দানবীর ও ধনকুবের হিসেবে পরিচিত করাতে সক্ষম হন। তার স্ত্রী সেলিনা হোসেনও স্বামীর গুণের কথা তুলে ধরেন। এক সভায় সেলিনা বলেন, ‘সাগরের পানি শুকিয়ে গেলেও পাপুলের টাকা শেষ হবে না।’ এরপর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চান পাপুল। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। এ আসনে মহাজোট থেকে মনোনয়ন পাওয়া জাতীয় পার্টির তৎকালীন এমপি মোহাম্মদ নোমান হঠাৎ আত্মগোপনে চলে যান। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থনে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেন পাপুল। এর কিছুদিন পর তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম স্বতন্ত্র কোটায় সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হন।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে শহীদুল ইসলাম পাপুল বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি বা এ ধরনের কোনো ব্যবসা নেই। মানবপাচারের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এটা একটি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। আমাদের প্রতিষ্ঠানটির সুনাম বিশ্বব্যাপী। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ। কুয়েতে কোনো রিক্রুটিং লাইসেন্স ও ম্যানপাওয়ার কোম্পানি হয় না। আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলো রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। আমি ও আমার স্ত্রী দুজনই সাংসদ হওয়ার কারণে এটা হয়েছে।