আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। টানা ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট দুর্যোগে এসব জেলায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৫ জন, কক্সবাজারে ২০, রাঙ্গামাটিতে তিন ও বান্দরবানে আটজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশের দোহাজারী থেকে সাতকানিয়ার কেরানীহাট পর্যন্ত সড়কে বন্যার পানির তীব্রতার কারণে দুদিন বন্ধ ছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে যানবাহন চলাচল। পানি সড়ক থেকে নেমে যাওয়ায় গতকাল সকাল থেকেই দুই জেলার মধ্যে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। তবে চট্টগ্রামের সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ গতকাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘বন্যায় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ১৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় ছয়, লোহাগাড়ায় চার, চন্দনাইশে দুই, রাউজানে এক, বাঁশখালীতে এক ও মহানগরীতে একজন মারা গেছে। এখনো দু-তিনজন নিখোঁজ থাকতে পারে। বিস্তারিত তথ্য জানতে পারলে পরে জানানো হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের হিসাবমতে, সাতকানিয়ায় সাড়ে ২২ হাজার পরিবার, চন্দনাইশে পাঁচ হাজার, পটিয়ায় ১৬ হাজার ৫৯৫ ও লোহাগাড়ায় চার হাজার পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার নলকূপগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়া প্রায় দেড় লাখ পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
সাতকানিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এমএ মোতালেব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাতকানিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বেশকিছু জায়গা থেকে পানি নেমে গেছে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে যেভাবে গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছিল এবং পানির স্রোত ছিল তা এখন কমতে শুরু করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ এলাকা থেকে পানি না নামায় বাড়িতে ফিরতে পারছে না লোকজন। পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে আশপাশের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে অবস্থানকারীদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। মহাসড়ক থেকে বন্যার পানি নামলেও এখনো বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ও লোকালয় তলিয়ে আছে পানিতে। বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ সব জায়গায় এখনো স্বাভাবিক হয়নি।’
উন্নতি হয়েছে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলায় প্লাবন পরিস্থিতি। বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং নদী, বিলাইছড়ির রাইক্ষ্যং নদী ও বরকলের কর্ণফুলী নদীর পানিও কিছুটা কমেছে। তবে বন্যার পানিতে ডুবে উপজেলায় তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমানা আক্তার।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দুপুরে উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের করেঙ্গাতলী এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্ধুদের সঙ্গে গোসলে নেমে রাহুল বড়ুয়া (১০) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। এছাড়া বাঘাইছড়ি সদরের উগলছড়ি এলাকা থেকে বিকালে মো. জুয়েল (৭) ও খেদারমার ইউনিয়নের দক্ষিণ হীরারচর এলাকা থেকে জুনি চাকমা (৭) নামে আরো দুই শিশুর মৃতদেহ পানি থেকে উদ্ধার করা হয়।
টানা পাঁচদিন বিদ্যুৎসেবা বিঘ্নিত থাকা জুরাছড়ি উপজেলায় বুধবার রাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হয়েছে। তবে কাপ্তাই হ্রদের পানি ঘোলাটে হয়ে পড়ায় জেলার বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকার মানুষ ব্যবহারযোগ্য ও সুপেয় পানি নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছে। তাদের পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছে স্থানীয় প্রশাসন। অব্যাহত রয়েছে ত্রাণ কার্যক্রমও।
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘গত বুধবার জেলার ২৮টি ইউনিয়ন পানিতে প্লাবিত থাকলেও গতকাল ছয়টি ইউনিয়নের পানি নেমে গেছে। এখনো ২২টি ইউনিয়নের মানুষ পানিতে প্লাবিত রয়েছে। জেলা প্রশাসনের ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৪২৫ টন চাল, ১৪ লাখ টাকা ও ১ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করেছি।’
বিলাইছড়ির ফারুয়াসহ দুর্গম এলাকায় প্লাবিত হওয়া মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছেছে কিনা জানতে চাইছে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘প্রশাসন থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যানদের দুর্গম এলাকায় ত্রাণ বিতরণের জন্য বলা হয়েছে। আমরা পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি সমন্বয় করে নেব।’
একদিন বৃষ্টি না হওয়ায় খাগড়াছড়িতে প্লাবিত এলাকার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জেলা শহরের সব এলাকার পানি নেমে গেছে। ঘরবাড়িতে চলে গেছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় থাকা লোকজন। তবে কিছুটা অপরিবর্তিত রয়েছে দীঘিনালা উপজেলার দুই ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি। কবাখালী ও মেরুং ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে এখনো পানিবন্দি আছে ঘরবাড়ি। ডুবে আছে মেরুং বাজারের একাংশ।
পানিতে সড়ক তলিয়ে থাকায় বন্ধ আছে দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি-সাজেক ও লংগদু রুটের যান চলাচল। বাঘাইহাট থেকেও পানি নামতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তবে সাজেক থেকে কিছু পর্যটক বিকল্পভাবে ফিরতে শুরু করেছে তাদের গন্তব্যে। সরাসরি যানবাহন চলাচল না করায় এখনো অনেক পর্যটক সাজেকে আটকে আছে।
খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাকসুদুর রহমান জানান, ছয়-সাতদিনের টানা বৃষ্টিপাতের কারণে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সড়ক কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে দীঘিনালা, বাঘাইহাট-মারিশ্যা সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে পাহাড়ধস হয়েছে। সড়কের পাশের মাটি সরে গেছে। পানিতে তলিয়েছে।
অন্যদিকে পানি কমতে শুরু করায় টানা তিনদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর বান্দরবান শহর থেকে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবস্থাও আংশিক ফিরেছে। গতকাল সকাল থেকে রবি, এয়ারটেল ও টেলিটক মোবাইল নেটওয়ার্ক একটু ভালো পাওয়া যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, এক সপ্তাহের ভারি বৃষ্টিতে বান্দরবানে বন্যা ও পাহাড়ধসে এখন পর্যন্ত আটজনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন একজন এবং আহত হয়েছে ১৭ জন। গতকাল বন্যা-পরবর্তী সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এরই মধ্যে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বান্দরবান সদর ও লামা এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি এখন বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি তিন উপজেলা ছাড়া অন্য তিন উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল হয়েছে। ঢাকা থেকেও কয়েকটি বাস যাওয়া-আসা করেছে।’
এছাড়াও বন্যাকবলিত কক্সবাজারের বেশির ভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে কক্সবাজারে মৃত্যু এখন পর্যন্ত হয়েছে ২০ জনের। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির তথ্য বিবরণীতে রামুতে একজন, চকরিয়ায় ১১, পেকুয়ায় ছয় ও উখিয়ায় দুজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার সাত উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল। গতকাল পর্যন্ত চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার নিচু এলাকা থেকে বন্যার পানি নামেনি। স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেছেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণসহায়তা দেয়া হচ্ছে।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যমতে, বন্যায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯টি ইউনিয়ন এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, বন্যায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণে কাজ করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। পরে ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বরাদ্দ দেবে জেলা প্রশাসন।