নাগর্নো কারাবাখঃ উত্তপ্ত পর্বতমালা

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ আজ থেকে দশ দিন আগে নাগর্নো কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হলে ইতিমধ্যে কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। দু’দেশের সামরিক বাহিনী নাগরোণো-কারাবাখ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে  সংঘর্ষ চালাচ্ছে, আর এই সংঘর্ষে কয়েকটি বড় বিশ্বশক্তি বিরোধী পক্ষগুলির সমর্থন জানিয়েছে – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত রয়েছে – এই সংঘাত আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, এবার বিবদমান এই দুদেশের মধ্যে শান্তি আলোচনা নিয়ে সমস্যা হতে পারে, কেননা ন্যাটো সদস্য তুরস্ক আজারবাইজানকে সমর্থন জানিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘর্ষে কোন ভূমিকা পালন করতে এখনো এগিয়ে আসে নাই।

উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে অপর পক্ষের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উভয় পক্ষই দাবি করেছেন যে অপর পক্ষ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এদিকে গত সোমবার আজারবাইজানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, ৩ লক্ষ ৩০ হাজার নাগরিক অধ্যুষিত শহর  গঞ্জাতে আর্মেনিয়ান বাহিনী গোলাবারুদ চূড়ে আক্রমণ চালিয়েছে।



যুদ্ধের ময়দান থেকে অনলাইনে পোস্ট করা ভিডিওগুলিতে দেখা যায়, লড়াই বাড়ার সাথে সাথে ভারী আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক, ক্ষেপণাস্ত্র এবং এমনকি কামিকাজে ড্রোনের অভূতপূর্ব হয়েছে।  উভয় দেশই একে ওপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হতে না হওয়ার অভিযোগ করেছে এবং স্থগিত শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করতে এখনও কোনও পক্ষই আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

This image has an empty alt attribute; its file name is image-11.png

এই দ্বন্দ্বের মূল কোথায়? 

আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান উভয় দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ককেশাস অঞ্চলের নতুন সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেছে। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে যখন সোভিয়েত কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হয়ে আসছিল, তখন নাগর্নো-কারাবাখের স্বায়ত্তশাসিত আইনসভার পার্বত্য অঞ্চল আর্মেনিয়ায় যোগদানের পক্ষে ভোট দেয়, যদিও আজারিরা ভোট দানে সংযুক্ত হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে নাগর্নো-কারাবাখ তার স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল, যার ফলে সংঘর্ষে কয়েক হাজার মানুষ হতাহত হয়েছিল। কিন্তু তখন এই অঞ্চলকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে অন্য কোন দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। 

সর্বদাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অঞ্চলকে আজারবাইজানের অংশ হিসাবে স্বীকৃত প্রদান করে আসছে। ভৌগলিকভাবে নাগরোণো-কারাবাখ আজারবাইজানের অন্তর্গত দৃশ্যমান হলেও ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী নৃতাত্ত্বিকভাবে আর্মেনিয়ান। ১৯৯১ সাল থেকে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এই অঞ্চল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে, সেই সময় এই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইন্ধন ছিল বিপুল। রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষে যুক্ত থাকে। তবে বিপুল জান মালের ক্ষয়ক্ষতির পর ১৯৯৪ সালে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধ বিরতি স্থাপিত হয়। যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও, গত তিন দশক ধরে তথাকথিত “সীমানা রেখা” বরাবর সংঘাত চলছে। সর্বশেষ মারাত্মক সংঘাত ছিল ২০১৬ সালে, যখন উভয় পক্ষের কয়েক ডজন সেনা নিহত হয়েছিল।

এবারে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ২০২০ উভয়ের সীমানারেখা থেকে পুনরায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হলো এবং ইতিমধ্যে জীবন হানি হয়েছে, দোষারোপ চলছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে বারে বারে যুদ্ধ বিরতির আহবান জানালেও কোন পক্ষ কর্নপাত করছেনা। 

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয় দেশের সাথে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক আছে তবে আর্মেনিয়ার সাথে সামরিক বন্ধুত্ব্ব এবং আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার একটি সামরিক ঘাটি আছে। এদিকে ন্যাটো সদস্য তুরস্ক আর্মেনিয়াকে শান্তির প্রতি হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আজারবাইজানকে সমর্থন প্রদান করেছে। আর্মেনিয়ার পক্ষ থেকে বেশ কয়েকদফা দাবী করা হয়েছে যে, তুরস্ক এই যুদ্ধে মদদ দিচ্ছে, যদিও তুরস্ক এবং আজারনবাইজান এই দাবী প্রত্যাখ্যান করেছে। 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কী?

গত বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং রাশিয়া একটি যৌথ বিবৃতিতে নাগরনো-কারাবাখে লড়াইয়ের নিন্দা করে বলেছে, “আমরা সংশ্লিষ্ট সামরিক বাহিনীর মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি, আমরা আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান নেতাদের মধ্যে আলোচনা দেরী না করে পুনরায় শুরু করতে প্রতিশ্রুত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ গত সপ্তাহে বলেছিলেন যে তিনি আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ডেকে বলেছেন যে রাশিয়া আলোচনার আয়োজন করতে রাজি আছে।

সোমবার, ইরান, উভয় সরকারকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, তারা এই সপ্তাহে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানকে উপস্থাপনের জন্য একটি “পরিকল্পনা” প্রস্তুত করেছে। এখন অবধি, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান উভয়েই যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে।

This image has an empty alt attribute; its file name is image-13.png

ট্রাম্প প্রশাসনও গত সপ্তাহে একতরফা বিবৃতি জারি করে যুদ্ধরত পক্ষগুলিকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া ছিল। মনে করা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অসুস্থতা এবং নির্বাচন নিয়ে এতই ব্যাস্ত যে কোনরূপ আন্তর্জাতিক কার্য্যকলাপে মনোনিবেশ করা দুরূহ।

ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকল পাশিনিয়ান বলেছেন যে, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, প্রয়োজনে রাশিয়া চুক্তি অনুযায়ী এই যুদ্ধে তাদের সহায়তা প্রদান করবে। তিনি অবশ্য এই কথাও বলেছেন যে, আজারবাইজান ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকলে তারাও সমান্তরাল ছাড় দিতে প্রস্তুত আছেন।


তথ্যসূত্রঃ বি বি সি, আল জাজিরা, আল সাবাহ

SHARE THIS ARTICLE