আইরিশ বাংলা পোস্ট ডেস্কঃ বাহাত্তর ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নেয়ার পর্যবেক্ষণ দেয়া বিচারক কামরুন নাহারকে বিচার কাজ থেকে সাময়িক অব্যাহতির নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। আজ রবিবার ১৪ই নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তার এ ক্ষমতা খর্ব করেন। তাকে আদালত থেকে প্রত্যাহার করে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করতে চিঠি দেয়া হয়েছে। একই সাথে তার বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রতিদিনের মতো ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোসাম্মাৎ কামরুন্নাহার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আদালতে নিজের খাসকামরায় এলেও বিচারকাজে অংশ নেননি। আদালতে আসার পর তিনি জানতে পারেন তার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এরপর আনুষঙ্গিক কাজ শেষে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে তিনি খাসকামরা ত্যাগ করেন।
এদিকে আজ দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ঘটনার ৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার যে কথা বিচারক মোসাম্মত কামরুন্নাহার বলেছেন, তা বিচারকদের জন্য বিব্রতকর। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ভুল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেটাও সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে এগিয়ে যাবে। আইনে তাঁর যা সুবিধা…তাঁকে শোকজ করা হবে। তিনি কেন বলেছেন, তার ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। আইনিভাবে যে প্রক্রিয়া আছে, সেটাই তাঁর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিগত ১১ই নভেম্বর বৃহস্পতিবার বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামিকে খালাস দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোসাম্মাৎ কামরুন্নাহার। রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, ধর্ষণের ঘটনার ৩৮ দিন পর কেন মামলা করা হয়েছে, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ভবিষ্যতে সঠিক তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশনা দেন আদালত। একইসঙ্গে ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুলিশ যেন মামলা গ্রহণ না করেন, সে বিষয়েও রায়ে বলা হয়।
আইনমন্ত্রী এই রায়ের পর বলেছিলেন, রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার বিচারকের ক্ষমতা কেড়ে নিতে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেয়া হবে।
এই মামলার রায়ে আদালত বলেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের ডাক্তারি প্রতিবেদনে কোনো সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের বিবরণ নেই। ভুক্তভোগীর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিলেনি। ৩৮ দিন পর এসে তারা বললো ‘রেপড হয়েছি’, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের ‘পাবলিক টাইম নষ্ট’ করেছেন বলে পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক।
আদালত পর্যবেক্ষণে আরো বলেন, ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোনো ধর্ষণের মামলা যেন নেয়া না হয়।
বিচারক রায় পড়ার সময় আরো বলেন, আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এ মামলাটির মেডিকেল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।
মামলার আসামিরা হলেন- সাফাত আহমেদ, সাফাতের দুই বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম ও সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী।
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে বনানী থানায় মামলা হয়।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, হোটেলে আসার পর ওখানে কোনো পার্টির পরিবেশ না দেখে বাদী ও তার বান্ধবী চলে যেতে চান। সাফাত আহমেদ তাদের কেক কাটার পর যাওয়ার অনুরোধ করেন। সে সময় বাদী ও তাঁর বান্ধবী ছাড়াও তাঁদের একজন চিকিৎসক বন্ধু ও তার বান্ধবী ছিলেন। তারা সবাই চলে যেতে চাইলে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম বাদীর চিকিৎসক বন্ধুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ মারধর করে তাঁর গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেন এবং তাঁদের (চিকিৎসক ও তাঁর বান্ধবী) একটি কক্ষে আটকে রেখে ভয়ভীতি দেখিয়ে বলেন, ‘পালাবি না।’ এরপর সাফাত ও নাঈম বাদী ও তাঁর বান্ধবীকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন। গাড়িচালক বিল্লাল বাদীর চিকিৎসক বন্ধুকে মারধরের ভিডিও ধারণ করেন।
আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাফাত বলেন, বাদীর সঙ্গে জন্মদিনের সপ্তাহ দুয়েক আগে তাঁর পরিচয় হয় সাদমান সাকিফের মাধ্যমে। দ্রুতই তাঁরা বন্ধু হয়ে ওঠেন। তিনি দাবি করেন, বাদীর পছন্দে তিনি রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিন উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দুটি কক্ষ বুকিং দিয়েছিলেন। ২৮ শে মার্চ রাতে তাঁরা মদ খেয়ে বেসামাল ছিলেন।
আসামি নাঈম আশরাফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। নাঈম জবানবন্দিতে বলেন, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে বেশ কিছু মডেলের পরিচয় ছিল। তারা সুযোগ পেলে ইচ্ছেমতো এই নারীদের ব্যবহার করতেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও বিকেল থেকে দুজন মডেল ছিলেন। পরে তাঁদের অনুরোধে আরও একজন বাড্ডা থেকে যোগ দেন। ধর্ষণের শিকার দুই নারী ও তাদের বন্ধুরা হোটেলে আসেন রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে। অতিথিদের একজনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তিনি হোটেলে ফেরেন দিবাগত রাত দেড়টার দিকে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানানো হয়, এ মামলায় ৪৭ সাক্ষীর মধ্যে ২১ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। গত ৩ অক্টোবর এই মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। সেদিন এ মামলার পাঁচ আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই প্রধান আসামি সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
বিচারকের এমন পর্যবেক্ষণের প্রতিবাদও জানায় বেশ কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিচারকের ওই বক্তব্য বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এছাড়া, বিচারকের ওই পর্যবেক্ষণ এখতিয়ার বহির্ভূত বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রায়ের কপি হাইকোর্টে আসার পর রায় পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো, বি ডি নিউজ২৪।কম