আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নানা কিছু বুঝিয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। এমনকি ভাসানচরে গেলে মেরে ফেলারও হুমকি দিতো একটি পক্ষ। ফলে স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে হস্তান্তরের বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
সরকারের প্রচেষ্টায় শুক্রবার (৪ ডিসম্বর) দুপুরে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে স্থানান্তরের প্রথম ধাপে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা হাসিমুখেই পা রেখেছেন বলে জানা গেছে। এর আগে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী এসব রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বৃহস্পতিবার গাড়িতে করে এনে চট্টগ্রামে শাহিন স্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হয়।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও ভাসানচরে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরপরই ক্যাম্পে বিভিন্নভাবে বাধা দিয়ে আসছিল একটি চক্র। এ চক্রে ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ি গ্রুপ, দাতা সংস্থাসহ রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
‘তুই কে? ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যেতে উৎসাহিত করতে তোকে কে দায়িত্ব দিয়েছে? ভাসানচর নিয়ে উল্টাপাল্টা প্রচারণা করবি। না করলে দুনিয়ায় বেশি দিন ঠাঁই হবে না।’ গত ৯ সেপ্টেম্বর ভাসানচরের বিষয়ে ক্যাম্পে প্রচারণাকালে এভাবেই হুমকির শিকার হয়েছিলেন টেকনাফের শামলপুর শিবিরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা নেতা। এর আগের দিন ভাসানচরে ঘুরে আসেন রোহিঙ্গা নেতাদের ৪০ জনের একটি দল।
পাহাড়ি গ্রুপ পরিচয়ে তাকে হুমকি দিয়েছিল জানিয়ে এ রোহিঙ্গা নেতা জানান, ‘তার ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। হাসিমুখে তারা সেখানে একদিন পার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ভাসানচরে সরকারের গড়ে তোলা অবকাঠামোগুলো মজবুত ও সুন্দর। যাওয়ার সময় তাদের খুবই ভালো ব্যবস্থাপনায় নেওয়া হয়েছিল। বসবাস করার প্রয়োজনীয় সবই আছে সেখানে। যেটি ধারণারও বাইরে ছিল তাদের। তাদের কথা শুনে ক্যাম্পের আরও লোকজন যাওয়ার জন্য আগ্রহী হচ্ছে।’
চলতি সপ্তাহে আরও সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচর পাঠানো হবে বলে নৌবাহিনী সূত্রের বরাতে শুক্রবার জানায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)।
ভাসানচর ‘আশ্রয়ণ-৩’ উপ-প্রকল্পের পরিচালক কমান্ডার এম আনোয়ারুল কবির জানান, ‘ভাসানচরে নামার পর পরিবেশ দেখে তারা এখানকার জীবন কক্সবাজারের চেয়ে নিরাপদ হবে বলে জানিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গা দলটি খুব খুশি, তারা সব জায়গায় ঘুরে দেখছেন। তবে দ্বিতীয় ধাপে রোহিঙ্গা আসার বিষয়টি নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’
ভাসানচর পৌঁছে মোবাইল ফোনে টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবির থেকে যাওয়া মো. সালামত উল্লাহ বলেছেন, ‘ভাসানচরের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং এখানকার চাষাবাদের পরিবেশ দেখে আমরা অনেক খুশি। এখানে আসার সিদ্ধান্ত সময় উপযোগী হয়েছে বলে মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘এখানে আসার আগে ক্যাম্পে কিছু মানুষের কথা শুনে একটু ভয়ে ছিলাম। তারা বলেছিল, ভাসানচরের পরিবেশ ভালো না। সাগরের পানি ওঠে। মাটি নরম। এখানে আসার পর বুঝেছি তাদের কথা সত্য নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘ভাসানচরে যারা যেতে নিষেধ করছে তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তারা এখানে বসে নানা অপকর্ম করার সুযোগ পায়। নিরীহ রোহিঙ্গাদের তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। ভাসানচরে গেলে তাদের অবাধ যাতায়াত ও অপকর্ম করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।’
২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো সালামত উল্লাহ বলেন, ‘পরিবারের ৮ সদস্যকে নিয়ে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে এসেছি। তবে সেখানে যেতে বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করেছিল ক্যাম্পের কিছু লোকজন। তারা চায়নি আমরা ভাসানচরে আসি। আমাদের ভালো থাকা না থাকায় তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের উদ্দেশ্য মূলত দল ভারি করা। এখানে আসার পর ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন লোকজন জানতে চেয়েছিল আমরা কেমন আছি। আমাদের কথা শুনে এখন অনেকেই আসতে আগ্রহী।’
মোবাইল ফোনে শারমিন আক্তার নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী ভাসানচরে পৌঁছে একই অভিযোগ করেন, তাদেরও সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল বিভিন্নভাবে।
শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবুল কালাম বলেন, ‘তার শিবির থেকে ভাসানচরে যাওয়া লোকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। সবাই ভালো আছেন। শিবির থেকে আরও ২০ রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে।‘
তিনি বলেন, ‘নানা অপকর্মের সুযোগ কমে যাবে বলে ক্যাম্পে একটি চক্র ভাসানচরের বিপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে আমরা যারা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে এসেছি তাদের স্বপ্ন নিজ দেশেই ফিরে যাওয়া।’
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে নিরুৎসাহিত করার বিষয়টি ইদানীং সামনে এসেছে জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে বলছি সরকার ভাসানচরে যেতে কাউকে জোর করেনি। ফলে সেখানে নিরুৎসাহিত করার প্রশ্নও আসে না। এসব অপচেষ্টাকারীকে চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন গোটা বিশ্ব জেনেছে ভাসানচরে যেতে কাউকে জোর করা হয়নি। এমন সুযোগ-সুবিধা পাবেই বা কোথায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে খবর আসছে আরও রোহিঙ্গা সেখানে যেতে আগ্রহী। দ্বিতীয় ধাপে রোহিঙ্গা পাঠানোর বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে অস্থায়ীভাবে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ‘আশ্রয়ণ-৩’ নামে প্রকল্প নেওয়া হয়। চরটিকে বাসের উপযোগী করতে সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও বনায়ন করা হয়। দ্বীপটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরকে একটি ‘টাউনশিপ’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ছাড়াও এখানে এনজিও কর্মকর্তা, দূতাবাস কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য উন্নত ও আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলা, নিপীড়ন ও হত্যার কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়াও এর আগে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। বর্তমানে তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ১১ লাখ। এ পরিস্থিতির মধ্যেই রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও টেকনাফের ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পগুলো থেকে সরিয়ে নিরাপদে রাখতে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে বিপুল ব্যয়ে আশ্রয় ক্যাম্প নির্মাণ করে সেখানে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।