আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই জয়ের পেছনে তার মূলশক্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। মুসলিমসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। যার ফসল তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এমন বিশ্লেষণ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর।
মমতার নতুন মন্ত্রিসভায় ৪৩ জন সদস্যের তালিকায় দেখা যায়, রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় থেকে মাত্র ৭ জনকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে নতুন সরকারে। তার মধ্যে ৪ জন পূর্ণমন্ত্রী, ১জন স্বাধীন প্রতিমন্ত্রী ও দু’জন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পাচ্ছেন তারা হলেন কলকাতার বর্তমান মেয়র ফিরহাদ হাকিম, জাভেদ আহমেদ খান, সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী ও গোলাম রব্বানি। এঁদের মধ্যে গোলাম রব্বানি তৃণমূলের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় অর্থাৎ বিদায়ী মন্ত্রিসভায় পঞ্চায়েত দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বাধীন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব যে তিনজনকে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে এই প্রথম মন্ত্রী হলেন আখরুজ্জামান। তিনি দুই বছর আগে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন।
হুমায়ুন কবীর ও সাবিনা ইয়াসমিন এর আগে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন। দু’জনেই রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পরে অর্থাৎ ২০১১ সালে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মমতার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছিলেন।
মমতার গত মন্ত্রিপরিষদেও ৭জন মুসলমান ছিলেন। কিন্তু এবার মমতার তৃণমূলের মুসলমান প্রার্থীরা নিজেদের আসনে দলকে বড় বিজয় এনে দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি আসনে বিপুল বিজয় পেয়েছেন তারা। সে কারণে এবার মনে হয়েছিল এ সংখ্যাটা বাড়বে।
তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনাতে তৃণমূল কংগ্রেস ৩১টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসন পেয়েছে। তাই এখান থেকেও নতুন মুখ আসতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক সওকত মোল্লা মন্ত্রী হতে পারেন বলে গুঞ্জন উঠেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি প্রতিমন্ত্রীও হতে পারেননি।
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার ভোটের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানের জয়ও মুসলমান প্রার্থীর। তৃণমূলের হয়ে মালদহ জেলার সুজাপুরের প্রার্থী সাবেক বিচারপতি আব্দুল গনি সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
অথচ ২০১৬ সালে কংগ্রেস প্রার্থী প্রায় ৪৬ হাজার ভোটে তৎকালীন তৃণমূল প্রার্থীকে পরাজিত করেছিল। এবার সাবেক বিচারপতি আবদুল গণি মনোনয়ন পেয়ে তৃণমূলকে অবিস্মরণীয় জয় এনে দিলেন। যার কারণে সাবেক এ বিচারপতির তার মন্ত্রিত্ব পাওয়া এক প্রকার নিশ্চিত বলে খবরও প্রকাশ করেছিল ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
এদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটে জেতার রেকর্ডও আরেক মুসলমান প্রার্থীর। কলকাতার মেটিয়াব্রুজের তৃণমূল প্রার্থী আব্দুল খালেক মোল্লা বিজেপির প্রার্থী রামজি প্রসাদকে ১ লাখ ১৯ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে হারান। তাকেও পুরস্কার স্বরূপ মন্ত্রিসভায় নেয়া হতে পারে বলে ধারণা করছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কিন্তু তারা কেউই মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত হননি। যার ফলে সংখ্যালঘুদের মনে কিছুটা আক্ষেপ তো রয়েই গেছে।
আসুন জেনে নিই মমতার মন্ত্রিসভায় মুসলিম নেতাদের বিস্তারিত পরিচয়-
ফিরহাদ হাকিম
ভারতের স্বাধীনতার পর কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র হিসাবে দায়িত্বপালন করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। ববি হাকিম নামে বেশি পরিচিত এই নেতা আগে থেকেই রাজ্যের নগরোন্নয়ন এবং পৌর দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার আগে পাঁচজন মেয়র ছিলেন মুসলিম, যাদের মধ্যে ছিলেন শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক। কিন্তু তারপর থেকে কখনও কোনও মুসলিম ধর্মাবলম্বী নেতা কলকাতার মেয়র পদে বসেননি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ফিরহাদ হাকিম দক্ষিণ কলকাতার চেতলা অঞ্চলের মানুষ। কংগ্রেস রাজনীতি করতে করতেই মমতা ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা এবং গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শেষ দিকে কলকাতা কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসাবে প্রথম ভোটে জেতা।
যতদিন গেছে, ততই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠদের বৃত্তে ঢুকে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছাকাছি পাড়ার বাসিন্দা ফিরহাদ হাকিম।
কর্পোরেশনের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছিয়ে গেছেন বিধানসভায়। ভোটে জিতে বিধায়ক হওয়ার পরে হয়েছেন মন্ত্রী।
আর রাজনীতির ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছেন মমতা ব্যানার্জীর ‘ম্যান ফ্রাইডে’দের অন্যতম।
এক সাক্ষাৎকারে ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, তার দাদু বিহারের গয়া জেলা থেকে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। বাবা ছিলেন কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের আইন কর্মকর্তা। আর মা ছিলেন কলকাতার একটি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা।
ফিরহাদ হাকিমের মায়ের আদি বাড়ি ছিল ফরিদপুরে।
তার মা হিন্দু মুখার্জী পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে জানিয়েছেন ফিরহাদ হাকিমের বাল্যবন্ধু ঋষিকেশ মুখার্জি।
তিনি বলেন, “ববি ধর্মে মুসলমান ঠিকই, নিয়মিত নামাজও পড়ে, গত বছর হজ করে এসেছে, কিন্তু ওর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম প্রসঙ্গটা একেবারেই নেই। ওর মা ছিলেন পূর্ব বঙ্গীয় হিন্দু পরিবারের মানুষ, বোনের বিয়ে দিয়েছে হিন্দু পরিবারে।”
জাভেদ আহমেদ খান
তিনি এর আগেও তিনি মমতার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কসবা আসন থেকে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে ১লাখ ২০ হাজার ৯৫৭ ভোট পেয়ে জয়ী হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. ইন্দ্রনীল খাঁ পেয়েছেন ৫৭,৭৫০ ভোট। অর্থাৎ তিনি ৬৩ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়লাভ করেন।
সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী
পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয় পান সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী। তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি তিনি। ২০১৬ সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। পরবর্তীকালে তাকে মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী করা হয় এবং গণশিক্ষা, গ্রন্থাগার এবং সংসদীয় বিষয়গুলিতে স্বতন্ত্র দায়িত্বে ছিলেন।
গোলাম রব্বানি
তৃণমূলের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় অর্থাৎ বিদায়ী মন্ত্রিসভায় পঞ্চায়েত দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। উত্তর দিনাজপুর থেকে তিনি বিধায়ক হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
২০১১ সালে গোয়ালপোখর কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক নির্বাচিত হন। তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ করেন ১৯৯৩ সালে৷ ১৯৯৭ সালে ইসলামপুর হাইস্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হন৷
২০১৫ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন রব্বানি৷ ২০১৬ সালে তৃণমূলের হয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব পান ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হিসেবে পরিচিত গোলাম রাব্বানি।
আখরুজ্জামান
মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বিধায়ক আখরুজ্জামান প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হচ্ছেন। আখরুজ্জামানের বাবা হাবিবুর রহমান বিধায়ক ছিলেন ২৫ বছর। বাবার পরে ২০১১ সালে তৃণমূল জোটের শরিক হয়ে বিধায়ক হন আখরুজ্জামান। ২০১৬ সালে জিতেছেন কংগ্রেস ও সিপিএমের জোট প্রার্থী হিসেবে ২৪ হাজার ভোটে তৃণমূলকে হারিয়ে। দুই বছর আগে তিনি কংগ্রেস থেকে সরাসরি তৃণমূলে যোগ দেন।
আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আখরুজ্জামানের বাবা হাবিবুর রহমান পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন। হাবিবুর সাইকেল ভেঙে গ্রামে গ্রামে ছুটে শিশুদের লেখাপড়া উদ্বুদ্ধ করতেন। এজন্য তিনি সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলেন।
হুমায়ুন কবীর
চন্দননগরের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবীর। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। যদিও তার এপ্রিল পর্যন্ত চাকরির মেয়াদ ছিল। কিন্তু চাকরির মেয়াদের তিন মাস আগে পদত্যাগ করেন। তখন থেকেই জল্পনা শুরু হয় তিনি রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন। ২০০৩ ব্যাচের এই সাবেক আইপিএস অফিসারের স্ত্রী অনিন্দিতা কবীর আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
তিনি এর আগের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মোথাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক হিসেবে ২০১১ সাল থেকে নির্বাচিত হচ্ছেন।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সাবিয়া ইয়াসমিন বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হবার পূর্বে মালদা জেলা পরিষদের সভাধিপতি ছিলেন।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মনোনয়নে তিনি মোথাবাড়ি থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি সহ সাতজন মুসলিম নারী সেবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০১১ সালের মে মাসে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারে শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের রাজ্য সরকারের প্রথম মুসলিম নারী মন্ত্রী।
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসের টিকিটে তিনি পুনরায় মোথাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে তিনি দল পরিবর্তন করে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন।
প্রসঙ্গত, এবারের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ৪২ জন মুসলিম প্রার্থীকে টিকিট দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থী ছিলেন ৫৭ জন। অর্থাৎ, এবার তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটা কমেছে। অর্থাৎ ২৬ শতাংশের মতো কমেছে সংখ্যালঘু প্রার্থীর সংখ্যা।
এর আগে ২০১১ সালে ৩৮ জন সংখ্যলঘু প্রার্থী তৃণমূলের টিকিট পেয়েছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক মমতায় আস্থা মুসলমানদের
যে সময় মমতার দলের শতাধিক নেতা বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল। এরমধ্যে অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী ও অভিনেত্রী শ্রাবন্তীর মতো জনপ্রিয় তারকাদেরও মাঠে নামিয়েছিল বিজেপি। তারা ঘোষণাও দিয়েছিল যে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ দখল করবে।
ঠিক ওই সময় ভারতের মুসলিমরা রাজ্যের শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখতে অসাম্প্রদায়িকতাকেই বেছে নিয়েছেন। তারা ফুরফুরা দরবার শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর জোটে ভোট না দিয়ে মমতার দলেই আস্থা রেখেছেন। যার ফলে মমতা পেয়েছেন ভূমিধস জয়। তবে এ নিয়ে মুসলমানদের প্রতি বিজেপির ক্ষোভের অন্ত নেই।
বিজেপির আইটি সেল থেকে মুসলিম বিদ্বেষী নানা বিষয় ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা শান্তিপ্রিয়। তারা এ নিয়ে পাল্টা কোনো জবাব দেয়নি শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা।