মা-বাবার আনুগত্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ


ড. মো. শাহজাহান কবীরঃ ইসলামে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যের পরই একজন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো তার মা-বাবার আনুগত্য। কারণ, আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর পর একজন মানুষের প্রতি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহ, মমতা ও ভালোবাসা দেওয়া ব্যক্তিরা হলেন নিজের মা ও বাবা। তাই তাঁরাই একজন সন্তানের সবচেয়ে আপনজন। এবং এ কারণেই মা-বাবাই সন্তানের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আনুগত্য, যত্ন ও সেবা পাওয়ার অধিকার রাখেন। কোরআন-হাদিসের আলোকে বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো। 

ইবাদতের পরেই মা-বাবার আনুগত্য
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক এ আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারও ইবাদত করো না। আর মা-বাবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। যদি তাদের একজন কিংবা উভয়েই তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের প্রতি (বিরক্ত হয়ে) উফ্‌ শব্দ পর্যন্ত বলবে না। তাদের ধমক দেবে না। বরং তাদের সঙ্গে মার্জিত ভাষায় কথা বলবে। তাদের জন্য সদয়ভাবে নম্রতার বাহু প্রসারিত করে দাও আর বলো, হে আমার প্রতিপালক, তাদের দয়া করো, যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালনপালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ২৩-২৪)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইবাদতের ক্ষেত্রে নিজেকে সর্বতোভাবে এক ও অংশীদারহীন ঘোষণা করে তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারও ইবাদত করতে নিষেধ করার পরপরই মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য আয়াতেও একই সুরে বলেছেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না এবং মা-বাবার প্রতি উত্তম আচরণ করো।’ (সুরা নিসা: ৩৬)

তবে তাঁরা যদি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার আদেশ করেন, তা মানা যাবে না। তবে তখনো তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। আর যদি তোমার মা-বাবা তোমাকে আমার সঙ্গে শিরক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করো না।’ (সুরা আনকাবুত: ৮)

মা-বাবাকে দেখলেও সওয়াব
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি মানুষকে তার মা-বাবা সম্পর্কে আদেশ করেছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছেন। দুই বছর পর্যন্ত তাকে দুধ পান করিয়েছেন। তোমরা আমার এবং তোমাদের মা-বাবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। আমার দিকেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা লুকমান: ১৪) 
আয়াতে মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অর্থ হলো, তাঁদের আনুগত্য করা, সেবা করা, উত্তম আচরণ করা ইত্যাদি। এসবের সওয়াব অসংখ্য। এমনকি তাঁদের দিকে তাকালেও হজের সওয়াব হওয়ার কথা এসেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারী সন্তান নেক দৃষ্টিতে মা-বাবার দিকে তাকালে মহান আল্লাহ এর বিনিময়ে কবুল হজের সওয়াব লিখে দেন।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি সে এক শ বার তাকায়?’ মহানবী (সা.) বললেন, ‘যদি সে ইচ্ছা করে এক শ বার তাকাতে পারে, তাহলে তার সওয়াবও সে পাবে।’ (বায়হাকি)

মায়ের অধিকার বেশি
সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালনপালনের ক্ষেত্রে বাবার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট করেন মা। তাই সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে বাবার চেয়ে মায়ের অবদান অনেক বেশি। তাই ইসলামে বাবার চেয়ে মাকে বেশি অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমার কাছে সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার কার?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি ফের জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর কার?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘এরপর কার?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি ফের জিজ্ঞেস করল, ‘এরপর কার?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার বাবার।’ (মুসলিম)

মা-বাবার অবাধ্যতার পরিণাম
মা-বাবার অবাধ্যতার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আখিরাতে এ জন্য কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। দুনিয়ায় অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হবে। মহানবী (সা.) একদিন বললেন, ‘সে ধ্বংস হোক! সে ধ্বংস হোক! সে ধ্বংস হোক!’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই হতভাগাটা কে, হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘যে ব্যক্তি তার মা-বাবা উভয়কে বা কোনো একজনকে বুড়ো বয়সে পেয়েও তাঁদের সেবা করে জান্নাতে যেতে পারেনি, সে।’ (মুসলিম)

অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, মা-বাবার অবাধ্যতা ছাড়া অন্য সব গুনাহ আল্লাহ তাআলা চাইলে ক্ষমা করে দেবেন, তবে মা-বাবার অবাধ্যতার শাস্তি আল্লাহ তাআলা মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই দিয়ে দেবেন। (বায়হাকি)

অন্যের মা-বাবাকে গালি দেওয়াও গুনাহ
মহানবী (সা.) বলেন, ‘কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো, নিজের মা-বাবাকে লানত করা।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল, কীভাবে একজন লোক নিজের মা-বাবাকে লানত করতে পারে?’ জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, ‘একজন লোক যখন অপরজনের মা-বাবাকে গালি দেয়, তখন সেও ওই লোকের মা-বাবাকে গালি দেয়। (বুখারি)

সুতরাং মা-বাবার আনুগত্য করা ইসলামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাঁদের প্রতি যেকোনো ধরনের অবহেলা দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংসের কারণ। 

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

SHARE THIS ARTICLE