যেভাবে ভারতের ধর্মীয় রাজনীতির ছায়া পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতি ভারতীয়-আমেরিকানদের চিরাচরিত আনুগত্যে যেভাবে চিড় ধরেছে, যেভাবে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভক্ত হয়ে পড়ছেন – নভেম্বরের নির্বাচনের আগে তা নিয়ে জো বাইডেন শিবির চিন্তিত।

‘ভারত-বিরোধী’ এবং এমনকি ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে ভারতীয়-আমেরিকান সমাজের বিরাট একটি অংশের মধ্যে যে ইমেজ তাদের তৈরি হচ্ছে – তা ঘোচানোর চেষ্টায় নেমেছেন ডেমোক্র্যাটরা।

ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজ (শনিবার) এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দুই সিনিয়র উপদেষ্টাকে সাথে নিয়ে জো বাইডেন ভারতীয়-আমেরিকান ভোটারদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন বলে কথা রয়েছে।

তাছাড়া, ডেমোক্র্যাটদের অনেকে ভরসা করছেন, ভারতীয় এবং জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত কামালা হ্যারিসকে রানিং-মেট হিসাবে বেছে নেওয়ায় ভারতীয়-আমেরিকান ভোটারদের সন্দেহ হয়ত কিছুটা ঘুচতে পারে।

মিজ হ্যারিসের মনোনয়ন নিশ্চিত করার পরদিনই আত্মপ্রকাশ করেছে ‘ইন্ডিয়ানস ফর বাইডেন (বাইডেনের পক্ষে ভারতীয়রা) ন্যাশনাল কাউন্সিল‘ নামে নূতন একটি সংগঠন।

সাংবাদিকদের কাছে এই খবর জানানোর সময় নতুন এই ক্যাম্পেইন গ্রুপের পরিচালক সঞ্জীব জোসিপুর বলেন, আমেরিকাতে ডেমোক্র্যাটরাই যে তাদের প্রকৃত মিত্র এবং ভরসা, তা ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে বোঝাবেন তারা।

২০১৯ সালের টেক্সাসের হিউস্টনে নরেন্দ্র মোদীর সম্বর্ধনায় প্রবাসী ভারতীয়দের একাংশ
ছবির ক্যাপশান,২০১৯ সালের টেক্সাসের হিউস্টনে নরেন্দ্র মোদীর সম্বর্ধনায় প্রবাসী ভারতীয়দের একাংশ

“একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং ইন্ডিয়ান-আমেরিকান নারীকে প্রথমবারের মত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে মনোনয়ন দেওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।”

“ইন্ডিয়ান-আমেরিকান সমাজকে বোঝানো খুবই জরুরী যে এদেশে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর“ – বলেন সঞ্জীব জোসিপুর

কামালা হ্যারিস বনাম ভারতীয় ভোট

কামালা হ্যারিসের মনোনয়নে ভারতে এবং ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে যে এক ধরণের সাড়া পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট।

ভারতের মিডিয়াতেও বিস্তর কথাবার্তা চলছে তাকে নিয়ে।

কামালা হ্যারিসের মনোনয়ন ঘোষণার দিনে ভারতের অন্যতম দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের শিরোনাম করে -‘ওয়ান অব আওয়ারস অর্থাৎ তিনি আমাদেরই একজন।‘

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ভারতীয়-আমেরিকানদের আনুগত্যে যে ফাটল তৈরি হয়েছে, কামালা হ্যারিসের মনোনয়নে তার কতটা সুরাহা হবে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি তারা যেভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন – তা কি বদলে যাবে?

অনেক পর্যবেক্ষক সন্দিহান। তাদের কথা – যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বা নির্বাচনে এখন ভারতীয়-আমেরিকানদের বিশাল একটি অংশের সমর্থনের প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের চলমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।

সেখানে আংশিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত কামালা হ্যারিসের মনোনয়ন খুব বেশি পার্থক্য তৈরি করবে না।

ভারতীয় রাজনীতি এবং হিন্দু-মুসলিম বিরোধ

ভারতে মুসলিম এবং কাশ্মীর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির নানা কর্মকাণ্ডে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিশেষ করে দলের বামপন্থী অংশটির খোলাখুলি সমালোচনায় চটে গেছেন হিন্দু ভারতীয়-আমেরিকানদের বিরাট অংশ।

পাশাপাশি, কাশ্মীর সহ মোদী সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত নীতির প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সর্বশেষ চীনের সাথে চলমান সীমান্ত বিরোধে ভারতের প্রতি তার সমর্থনের ফলে ভারতীয় আমেরিকানদের মধ্যে রিপাবলিকান-প্রীতি দিনে দিনে বাড়ছে।

২০১৯ সালে হিউস্টনে নরেন্দ্র মোদীকে দেওয়া প্রাবাসী ভারতীয়দের ‘হাউডি মোদী‘ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির হন ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবির ক্যাপশান,২০১৯ সালে হিউস্টনে নরেন্দ্র মোদীকে দেওয়া প্রাবাসী ভারতীয়দের ‘হাউডি মোদী‘ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির হন ডোনাল্ড ট্রাম্প

এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রে ‘হিন্দুজ ফর ট্রাম্প‘ (ট্রাম্পের জন্য হিন্দুরা) নতুন একটি গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করেছে।

অতি সম্প্রতি অনলাইনে ট্রাম্পের সমর্থনে একটি ভার্চুয়াল নির্বাচনী সভার আয়োজন করে যাতে এক লাখের মত ইন্ডিয়ান-আমেরিকান যোগ দেন।

ওয়াশিংটনে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সীমা সিরোহী দিল্লি-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ প্রকাশিত সাময়িকীতে লিখেছেন, প্রধানত ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাবে ভারতীয়-আমেরিকানরা রিপাবলিকান শিবিরে গিয়ে ভিড়তে শুরু করেছেন।

“তলে তলে ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে রিপাবলিকান দলের প্রতি সমর্থন যে বাড়ছে তা গবেষণা ডেটায় তা চেখে পড়বে না। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, জুম মিটিং এবং মানুষের সাথে কথা বলে তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।“

সীমা সিরোহী বলছেন “ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সেখানে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এসে পড়েছে।“

“ট্রাম্পকে অনেকে দেখছেন ভারতের এবং হিন্দুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অন্যদিকে বাইডেন এমন সব লোকজদের খপ্পরে পড়েছেন যারা ভারত বিরোধী।“

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির যাদের নিয়ে বহু হিন্দু ভারতীয়-আমেরিকানদের এই সন্দেহ বিরক্তি কামালা হ্যারিস তাদের বাইরে নন।

গত বছর অগাস্টে মোদী সরকার ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপর পর ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট বামধারার গোষ্ঠীগুলোর সাথে কিছু ইসলামপন্থী সংগঠন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

তারা মার্কিন কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সিটি কাউন্সিল এবং রাষ্ট্রের আইন সভাগুলোতে কাশ্মীরে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ভারতের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছে।

কাশ্মীর ইস্যুতে মার্কিন কংগ্রেসে নিন্দা প্রস্তাব তোলার প্রধান উদ্যোক্তাই ছিলেন আরেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক প্রমীলা জয়পাল। তাতে জোর সমর্থন দিয়েছেন কামালা হ্যারিসও।

তার আগে, মোদী সরকারের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এবং বিজেপির হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ নীতির খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন কামালা হ্যারিস।

সুত্রঃ বিবিসি

SHARE THIS ARTICLE