রমজানের পরও জারি থাকা জরুরি যেসব আমল

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ রমজান শেষ হলেও কোনো ইবাদতেই পিছিয়ে থাকবে না মুমিন মুসলমানেরা। তারা রমজান মাসের আমল ও অভ্যাসগুলো বছরজুড়ে ধরে রাখবে।

উল্লেখ্য, রমজানের রোজা রেখে যে আমলগুলো করেছে তা সারা বছর জীবিত রাখবে মুমিন মুসলিম উম্মাহকে। আর তাতেই মিলবে অফুরন্ত রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত। এবার জেনে নিই আমলগুলো সম্পর্কে-

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। নির্ধারিত সময় মানুষ দুনিয়াতে অবস্থান করবে। এ সময়টি পরকালের শস্যক্ষেত্র। যারা এখানে ভালো কাজ করবে; তারাই ভালো ফল পাবে। আর যারা মন্দ কাজ করবে তারাও এর প্রতিফল পাবে।

মানুষের শান্তি ও মুক্তির লক্ষ্যে মহান আল্লাহ প্রতি সপ্তাহে কিছু নির্ধারিত মর্যাদার দিন রেখেছেন আবার মাসে নির্ধারিত কিছুদিন রেখেছেন আবার বছরের বিভিন্ন সময়ে রেখেছেন বিশেষ কিছু নির্ধারিত দিনও সময়। এর মধ্যে রমজান মাসও একটি। এ মাসের আমলগুলো নিজেদের মধ্যে ধরে রাখতে পারলে বছরজুড়ে পাওয়া যাবে রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত। তাই রমজান পরবর্তী বাকি ১১ মাস আমলগুলো করা যেতে পারে

দোয়া ও প্রার্থনা করা

মুমিন মুসলমান মহিমাম্বিত রমজানের পরও একটি সুন্দর জীবনযাপনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। আল্লাহর অনুগ্রহেই কেবল মুমিন বিভ্রান্তির হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করবেন না এবং আপনার কাছ থেকে আমাদের করুণা দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা’। (সূরা: আলে ইমরান: আয়াত: ০৮)

আল্লাহভীতির জীবন যাপন করা

দীর্ঘ এক মাস রোজা আদায়ের প্রধান উদ্দেশ্য তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

সুতরাং রমজান-পরবর্তী জীবনে যদি আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখে চলা যায়, তবে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা সার্থক বলে গণ্য হবে। আর আল্লাহভীতিই মুমিনজীবনে সাফল্যের মাপকাঠি।

আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষা

রমজান মাসে যেসব নেক আমল করা হতো, তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা মুমিনের দায়িত্ব। নবীজি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষায় উৎসাহিত করেছেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাধ্যানুযায়ী (নিয়মিত) আমল করবে। কেননা তোমরা বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ প্রতিদান দেওয়া বন্ধ করেন না। মহান আল্লাহ ওই আমলকে ভালোবাসেন, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো আমল করলে তা নিয়মিতভাবে করতেন’। (আবু দাউদ ১৩৬৮)

মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়

সমাজের অনেকে রমজান মাসে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে এবং রমজানের পর মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না- এটি নিন্দনীয়! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব মানুষের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, যারা মসজিদে উপস্থিত না হয়ে ঘরে নামাজ আদায় করে। তিনি বলেন, ‘যদি ঘরে নারী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা না থাকত, তবে আমি এশার নামাজে দাঁড়াতাম এবং দুই যুবককে নির্দেশ দিতাম, যারা (জামাতে অংশ না নিয়ে) ঘরে আছে তাদের পুড়িয়ে দিতে’। (মুসনাদে আহমদ ৮৭৯৬)

কোরআনচর্চা অব্যাহত রাখা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে পরবর্তী যুগের সব মনীষী রমজান মাসে কোরআনচর্চা বাড়িয়ে দিলেও বছরের কোনো সময় তারা কোরআনচর্চা থেকে একেবারেই বিরত থাকতেন না। ইসলামি আইনজ্ঞরা কোরআন থেকে বিমুখ হওয়াকে হারাম বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কোরআন পরিত্যাগকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসূল (সা.) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এই কোরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করে।’ (সূরা: ফোরকান: আয়াত: ৩০)

সুযোগ হলে নফল রোজা রাখা

রমজানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাওয়াল মাসে গুরুত্বের সঙ্গে ছয় রোজা পালন করতেন। একাধিক বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা শাওয়ালের ছয় রোজার মর্যাদা ও ফজিলত প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখলো, এরপর তার সঙ্গে সঙ্গে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখলো, সে যেন পূর্ণ বছরই রোজা রাখল।’ (মুসলিম ১১৬৪)

এ ছাড়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আইয়ামে বিজ তথা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমার বন্ধু (নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লাম) আমাকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা পালন করা, দুই রাকাত সালাতুদ-দুহা আদায় এবং ঘুমানোর আগে বিতর নামাজ পড়া। (বুখারি ১৯৮১)

আল্লাহওয়ালা ও সৎকর্মশীলদের সংস্পর্শ

আল্লাহওয়ালা ও আল্লাহমুখী মানুষের সংস্রব মানুষকে সুপথে থাকতে সহায়তা করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো’। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ১১৯)

রমজানের এই দিনগুলোতে মানুষ অনেক নেক কাজ করেছেন। সেগুলোকে নিজেদের জীবনে স্থায়ী রূপ দান করতে হবে। যদি এমনটি করা যায়, তবে এই রমজান আমাদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম কারণও হবে। কেননা হাদিসে পাকে এ প্রসঙ্গেই সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এসেছে-

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং এক রমজান থেকে আরেক রমজান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহগুলো মুছে দেয়, যদি সে কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে’। (মুসলিম)

সুতরাং প্রতি সপ্তাহ, মাস ও বছরের আমলগুলো যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমে হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলা খুবই জরুরি। এ ছাড়া মানুষের মৃত্যুর পর যেন সওয়াবের পথ বন্ধ হয়ে না যায়; সে জন্য বিশেষ ৩টি আমল অব্যাহত রাখতে হবে। এ জন্য সপ্তাহ, মাস ও বছর হিসাব করার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিনই বিশেষ ৩টি আমল করা জরুরি। হাদিসে এসেছে-

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পর তিনটি আমল ছাড়া সব রকমের আমলই বন্ধ হয়ে যায়। তাহলো-

১. সাদকায়ে জারিয়া
২. উপকারি ইলম বা জ্ঞান
৩. এমন নেক সন্তান, যে তাঁর (মৃত্যুর পর তার) জন্য দোয়া করতে থাকে’। (মুসলিম)

সদকায়ে জারিয়া: যার অর্থ এমন ধরনের জনকল্যাণকর কাজ ব্যয় হয়, যার সুফল বহু দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। মানুষ এ কাজে উপকার পেয়ে থাকে। যেমন- পুকুর কাটা, কুপ খনন করা বা পরিস্কার পানির ব্যবস্থা করা, মুসাফিরদের জন্য সরাইখানা তৈরি করা, রাস্তার পাশে ছায়াদানকারী বৃক্ষ রোপন করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করে যাওয়া, রাস্তাঘাট নির্মাণ বা ব্রিজ-কালর্ভাট তৈরি করা

উপকারি জ্ঞান: এমন জ্ঞানমূলক বই-পুস্তক লেখা, যার মাধ্যমে লোকেরা সঠিক পথের সন্ধান লাভ করবে। কল্যাণের পথে পরিচালিত হবে। দুনিয়া ও পরকালের যাবতীয় জ্ঞান লাভে জীবন সাজাতে পারবে। কিংবা মৃতব্যক্তি কাউকে এমন কিছু শেখায় যে তার ফলেও সে প্রতিদান পেতে থাকবে।

নেক সন্তান: তৃতীয় যে কাজটির জন্য মৃত্যুর পরও সে প্রতিদান পেতে থাকবে তা হল তার নেক সন্তান। যাকে সে প্রথম থেকেই সুশিক্ষা প্রদান করেছে এবং তার চেষ্টার ফলেই সে আল্লাহভীরু ও দ্বীনদার হতে পেরেছে। যতদিন পর্যন্ত এমন নেক সন্তান দুনিয়ায় জীবিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত তার কৃত সৎকাজের ছওয়াব সেও পেতে থাকবে। এমনকি সে সন্তান বাবা-মার কথা স্মরণ করে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে বলবে- رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
 
উচ্চারণ : ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা’। (সূরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত: আয়াত ২৪)

অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’।

সুতরাং আমাদের রমজানের আমলগুলো যেন এমন হয় যে, রমজান পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে জীবন পরিচালনায় সহায়ক হয়। এমনকি মৃত্যুর পরও যেন তা আমাদের জন্য সাদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভূক্ত হয়।

বছরজুড়ে যে কাজগুলোও করা যেতে পারে-

১. নিয়মিত বাবা-মায়ের সেবা করা।
২. প্রতিবেশির খোঁজ-খবর নেওয়া।
৩. অসহায় মানুষের ঘরে ঈদ উপহার ও পরবর্তী সময় খাদ্য-সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।
৪. বিপদ-আপদে অন্যের পাশে দাঁড়ানো।
৫. অহংকার-দম্ভ পরিহার করা।
৬. পাপ কাজ থেকে দূরে থাকা।
৭. লেন-দেনে সততা অবলম্বন করা।
৮. অন্যের সম্পদ দখল করা থেকে বিরত থাকা।
৯. কখনো মিথ্যা কথা না বলা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজান মাস চলে যাওয়ার পরও উক্ত আমলগুলো চালু রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

SHARE THIS ARTICLE