সাবলেটে ঝুঁকছে নগরবাসী

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ রাজধানীর জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ভাড়াটিয়া পরিষদের হিসাব মতে এর মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়ায় বসবাস করে।

ঢাকা মহানগরীর অলিগলি, লাইটপোস্ট, রাস্তাসংলগ্ন দেয়াল ও বিভিন্ন বাসা-বাড়ির গেটে অসংখ্য ‘টু-লেট’ সাইন বোর্ড দেখা গেলেও গত দু’মাসে তা অনেকাংশেই কমেছে। তবে ওইসব ফাঁকা জায়গা এখন টু-লেটের পরিবর্তে শত শত সাবলেট লেখা সাইন বোর্ড দখল করেছে। রাজধানীর সবুজবাগ, মুগদা, মিরপুর, রামপুরা ও বনশ্রীসহ মধ্যবিত্তের বসবাসের উপযোগী প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের সাইন বোর্ড বেশি দেখা গেলেও অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোতে তা একেবারে কম নেই।

এদিকে শুধু ঢাকা মহানগরীতেই নয়, দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও এই একই চিত্র দৃশ্যমান বলে স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করছে। বিশেষ করে শিল্প অধু্যষিত এলাকাগুলোতে সাবলেট দেওয়ার প্রবণতা বেশি বেড়েছে। পাশাপাশি যেসব শহরে বাসা ভাড়া তুলনামূলক বেশি, সেখানে নতুন করে অনেক পরিবার সাবলেট দেওয়া-নেওয়ার দিকে ঝুঁকছে বলে জানান স্থানীয়রা।

রাজধানীর বাড়ির মালিকরা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের একটি বড় অংশ গ্রামে ফিরে গেছে। যাদের সে সুযোগ নেই তারা অনেকে মাটি কামড়ে ঢাকায় পড়ে আছেন। কেউবা স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে জীবন সংগ্রামে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ফলে বেশিরভাগ মানুষই দুই-তিন রুমের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় বাড়ির মালিকরা টু-লেট সাইন বোর্ড টাঙিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও নতুন ভাড়াটিয়া না পাওয়ায় মহাবিপাকে পড়েছেন। বাসা ভাড়ার উপর নির্ভরশীল অনেক বাড়িওয়ালা এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে টু-লেট সাইন বোর্ড নামিয়ে সাবলেট সাইন বোর্ড টাঙিয়েছেন। তারা নিজ উদ্যোগে একাধিক ভাড়াটিয়া জোগাড় করে তাদের মধ্যে ভাড়া সমন্বয় করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কোনো কোনো ভাড়াটিয়া বড় বাসা ভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালার সম্মতিতে এক বা দুই রুম সাবলেট দিচ্ছেন।

ভাড়াটিয়ারা জানান, আগে বাড়িওয়ালারা সাবলেট দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলায় অনেকে সহকর্মীদের ভাইবোন কিংবা অন্য আত্মীয় পরিচয় দিয়ে একসঙ্গে বাসা ভাড়া নিতেন। এ বিষয় টের পাওয়ার পর অনেক বাড়ির মালিক এ ধরনের ভাড়াটিয়াদের বিনা নোটিশে বাসা ছাড়তে বাধ্য করেছেন- এমন নজিরও রয়েছে। অথচ এখন বাড়িওয়ালারাই অনেকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছেন। এমনকি একাধিক পরিবার যাতে একই ফ্ল্যাটে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে এ জন্য কেউ কেউ আলাদা বাথরুম-কিচেন ও পার্টিশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

করোনার আগে কোনো ভাড়াটিয়া তার ফ্ল্যাটের অংশ অন্য পরিবারকে সাবলেট দিলে বাড়িওয়ালারা বাড়তি ভাড়া দাবি করতেন। এমনকি কেউ কেউ দ্বিগুণ সার্ভিস চার্জ নিতেন। অথচ তারা এখন সাবলেট দেওয়ার কথা জেনেও আগের চেয়ে কিছুটা কম ভাড়া নিচ্ছেন।

রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার বাড়ির মালিক হাজী আবু দাইয়েন এ ধরনের ছাড় দেওয়ার স্বীকার করে বলেন, ‘করোনায় সবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। যারা আগে শুধু বাড়িভাড়া দিয়েই সচ্ছলভাবে সংসার চালাতেন, তাদের অনেকের একাধিক ফ্ল্যাট খালি থাকায় তারা এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে অনেক কিছু মেনে নিচ্ছেন।’ এছাড়া ভাড়াটিয়াদের দুর্গতির কথা চিন্তা করেও কেউ কেউ তাদের কিছুটা সুযোগ দিচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি।

২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, রাজধানীর জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ভাড়াটিয়া পরিষদের হিসাব মতে, এর মধ্যে ৮০ শতাংশ লোক ভাড়ায় বসবাস করেন। সে হিসাবে ঢাকা শহরে ভাড়ায় থাকে এক কোটি ৩৬ লাখ মানুষ। এদের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এর মধ্যে একটি বড় অংশ করোনা মহামারিতে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন বা রাজধানীর আশপাশে কম ভাড়ায় বাসা নিয়েছেন। অন্যদিকে প্রায় চার লাখেরও বেশি বাড়িওয়ালার মধ্যে প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার বাড়ির মালিক মধ্যবিত্ত হওয়ায় তারা ভাড়াটিয়া হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। তাই দুই পক্ষই এখন অলিখিত সমঝোতায় এসে সাবলেটের পথ বেছে নিয়েছে। করোনাকালীন বেশকিছু বাড়ির মালিক বাড়ি ভাড়া কমিয়েছেন বলেও জানায় ভাড়াটিয়া পরিষদ।

ঢাকায় ভাড়াটিয়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করা অপর একটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময় ঢাকার ১০ থেকে ১২ শতাংশ মধ্যম আয়ের মানুষ পরিবার নিয়ে কিংবা ব্যাচেলর হিসেবে সাবলেট বাসায় থাকত। যা করোনা শুরু হওয়ার পর গত পাঁচ মাসে ধাপে ধাপে বেড়ে ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বর্তমানে ঢাকা শহরের অলিগলিতে যেভাবে সাবলেট সাইন বোর্ড ঝুলছে, তাতে এ হার আগামীতে আরও ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নগরবিদরা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে ঢাকায় টিকে থাকা মধ্যম আয়ের কত সংখ্যক মানুষ দুই রুমের বাসা ছেড়ে এক রুম সাবলেট নিয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও সেটি যে একেবারে কম নয়, তা পুরানো ফার্নিচারের দোকানগুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। সেখানে প্রতিদিনই শত শত ভাড়াটিয়া তাদের বড় সাইজের আলমারি, খাট, ডাইনিং টেবিল, সোফা সেট ও অন্যান্য আসবাবপত্র বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ এসবের সঙ্গে ছোট সাইজের আসবাবপত্র বদল করে নিচ্ছে। তারা নিঃসংকোচে দোকানিদের কাছে স্বীকার করছেন, আর্থিক সংকটে পড়ে বড় বাসা ছেড়ে দিয়ে ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছেন কিংবা পুরানো বাসাতেই সহকর্মীদের কাউকে সাবলেট দিয়েছেন। তাই ঘরে জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় এসব আসবাবপত্র বেচে দিচ্ছেন।

এদিকে গত কয়েক মাস ধরে ঢাকা থেকে ট্রাক-মিনিট্রাক, লঞ্চ ও বাসের ছাদে নানা ধরনের আসবাবপত্র বিভিন্ন জেলা শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার চিত্র অহরহ দেখা যাচ্ছে। এদের অনেকে পরিবার নিয়ে চিরদিনের জন্য ঢাকা ছাড়লেও কেউ কেউ সাবলেটে ব্যাচেলর হিসেবে রয়ে গেছেন। তাই বাড়তি ফার্নিচার পরিবারের সঙ্গে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

গত জুন মাসে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে দেশের তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন লোক চাকরি বা উপার্জন হারিয়েছেন। এর প্রায় ১০ শতাংশ রাজধানীর বাসিন্দা। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে বসবাসকারীদের একটি বড় অংশ এ তালিকায় রয়েছেন। কর্মহীন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে ফিরে গেলেও বাকিরা আগের কর্মস্থল শহরেই নতুন কাজের সন্ধান করছেন। যাদের বেশিরভাগই পরিবার ছেড়ে ব্যাচেলর হিসেবে মেসে ঠাঁই নিয়েছেন। অথবা আগের ভাড়া বাসাতে সাবলেট দিয়েছেন।

সরকারি প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ অধিকাংশ জেলা শহরেই বিপুল সংখ্যক ভাড়াটিয়া তাদের বাসার এক বা একাধিক রুম অন্য পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়ে নিজের চাপ কমিয়েছেন। এতে বাড়িওয়ালারাও নিঃসংকোচে সমর্থন দিচ্ছেন। যেসব বাড়ির মালিক এ ব্যাপারে আপত্তি তুলছেন, তাদের বেশিরভাগ বাসা মাসের পর মাস খালি পড়ে থাকছে।

অর্থনীতিবিদরা জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ না কমলেও জনগণের জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনায় রেখে সরকার অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা ও গণপরিবহণসহ সবকিছু খুলে দিলেও কর্মহীন বেশিরভাগ মানুষ চাকরি ফিরে পাচ্ছেন না। বরং এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানে নতুন করে কর্মী ছাঁটাই চলছে। অনেক শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় আগেভাগেই বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসা কিংবা সাবলেট খুঁজে নিচ্ছেন।

রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপেস্নক্সের একটি মোবাইল ফোনের শো-রুমের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত ৮ বছর ধরে তিনি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার একটি তিন রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ বসবাস করছেন। আগে অনায়াসে ২৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে পারলেও এখন তা দেওয়া তার পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা শো-রুম কর্তৃপক্ষ তার বেতন প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রথমে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তা করলেও তার বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। তিনি তার ফ্ল্যাটের বড় রুমটি ১১ হাজার টাকায় এক সহকর্মীকে সাবলেট দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি বাড়ির মালিককে বিষয়টি জানালে তিনি কোনো আপত্তি তোলেননি। ওই ভবনের আরও একাধিক ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াও তাদের এক বা দুই রুম সাবলেট দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

কে বি গ্রম্নপের একটি বায়িং হাউজের সহকারী ব্যবস্থাপক আনজুম রশিদ জানান, তিনি পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে রামপুরা মহানগর প্রজেক্টের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। জুলাইয়ের শেষ দিকে আকস্মিক ওই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। অথচ দুই সন্তান রাজধানীর একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকা ছাড়তে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি আগের বাসা ছেড়ে বনশ্রীর জি বস্নকের একটি ফ্ল্যাটের এক রুম ৮ হাজার টাকায় সাবলেট নিয়েছেন।

তরুণ স্কুল শিক্ষিকা কামরুন নাহার লাভলী জানান, রামপুরার আফতাবনগর প্রকল্পে ১৮ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে তিনি একাই দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে ৩ বছর ধরে আছেন। এতদিন বাসায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানোর কারণে সময়মতো ভাড়া পরিশোধ করতে তার কোনো সমস্যা হয়নি। তবে করোনার কারণে প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েছেন। এ অবস্থায় তিনি বাড়িওয়ালার অনুমতি নিয়ে তার এক রুম চাকরিজীবী ব্যাচেলর নারীকে সাবলেট দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।

লাভলী জানান, করোনা শুরুর পর থেকে স্কুলের বেতন অনিয়মিত হওয়ায় তার সহকর্মীদের অনেকেই ইতোমধ্যে তাদের ভাড়া বাসার এক বা দুই রুম সাবলেট দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিজের বাসা ছেড়ে অন্যের বাসায় সাবলেটে উঠেছেন। আগের মতো বড় বাসা এককভাবে ভাড়া নিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা অনেকাংশে কমেছে বলে মনে করেন তিনি।

SHARE THIS ARTICLE