৩ কোটি টাকায় মেরামত হওয়া ইঞ্জিন ৩ মাসেই বিকল!

৩ কোটি টাকায় মেরামত হওয়া ইঞ্জিন ৩ মাসেই বিকল!

শাহেদ শফিক
প্রকাশিত : ২৩:২২, জুলাই ২৭, ২০২০ | সর্বশেষ আপডেট : ০১:২০, জুলাই ২৮, ২০২০1.7K

লোকোমোটিভ-২৯৩৩ (ছবি সংগৃহীত)

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ তিন কোটি টাকা খরচ করে মেরামত করা রেলওয়ের ২৯৩৩ নম্বর লোকোমোটিভটি (ইঞ্জিন) তিন মাস না যেতেই বিকল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ৮ মাসের প্রচেষ্টায় সারিয়ে তোলা হয় ইঞ্জিনটি। তবে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে মেরামত করায় এমন অবস্থা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে মেরামতের পুরো টাকাই গচ্চা গেছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে।

রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকা-সিলেট রেল রুটে পারাবত আন্তনগর ট্রেনটিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় হবিগঞ্জের মাধবপুর নোয়াপাড়া স্টেশনে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনায় পতিত হলে ইঞ্জিনটির নিচের অংশের জ্বালানি ট্যাংকে আগুন লেগে যায়। ফলে তা সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়ে। পুড়ে যাওয়া ইঞ্জিনটি নেওয়া হয় চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ডিজেল শপে। ইঞ্জিনটি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা কোনোক্রমে মেরামত করা সম্ভব হচ্ছিলো না। ফলে এর সচল হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। পরে ২০১৯ সালের ১৫ মে মেরামতের জন্য তা কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা- কেলোকায় পাঠানো হয়। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে সচল হওয়া ইঞ্জিনটি তিন মাস যেতে না যেতেই ফের বিকল হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিন মেরামত করার কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা কেলোকার শিডিউল ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা জানান, ২০১৯ সালের ১৫ মে ২৯৩৩ লোকোমোটিভটি কেন্দ্রীয় কারখানায় মেরামতের জন্য পাঠানো হয়। দীর্ঘ ৮ মাসের প্রচেষ্টায় এটিকে সারিয়ে তোলা হয়। চলতি বছরের মার্চে ট্রেন পরিচালনার জন্য লোকোমোটিভটিকে বাংলাদেশ রেল বহরে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু মেরামতের তিন মাস না যেতেই ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পড়ে আছে।

তিনি জানান, চলতি বছরের ২৮ জুন লোকোমোটিভটি মাত্র তিন মাস চলার পর আবার নষ্ট হয়ে যায়। পুনরায় মেরামতের জন্য এটিকে কেলোকাতে পাঠানো হয়েছে। এ সময় ইঞ্জিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ট্রাকশন মোটরে ত্রুটি ধরা পড়ে। ট্রাকশন মোটর মেরামত করে এটিকে সারিয়ে তোলা হয়। এরপর গত ৭ জুলাই পুনরায় এটাকে ট্রেন পরিচালনায় সংযুক্ত করা হয়। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনটি পরিচালনার কাজে এটি ব্যবহার হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় মেরামতের ১১ দিন পর আবারও গত ১৮ জুলাই ইঞ্জিনটি পার্বতীপুর লোকোশেডে বিকল হয়ে পড়ে।

শেডের ইনচার্জ কাফিউল ইসলাম জানান, ইঞ্জিনটি মেরামতের মাত্র ১৮ দিনের মাথায় আবারও বিকল হয়ে গেছে। ট্রেন পরিচালনা সম্ভব না হওয়ায় লোকোশেডের ইলেকট্রিক মেশিন (ইএম) বিভাগের কর্মচারীরা এটা সারিয়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কেননা, ইঞ্জিনটির ট্রাকশন মোটরের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে, যা লোকোশেডে মেরামত করা সম্ভব না। এ জন্য এটিকে সঠিক মেরামতের জন্য ফের কেলোকায় পাঠানো হয়েছে।

কেলোকা সূত্র জানিয়েছে, ইঞ্জিনটি রিকন্ডিশনিংয়ে ব্যয় হয়েছে তিন কোটি টাকা। মেরামতে ইঞ্জিনটি সচল হওয়ার পর রেল কর্তৃপক্ষ একে বিস্ময় বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, একটি নতুন মিটারগেজ ইঞ্জিন আমদানিতে খরচ হতো ৩৩ কোটি টাকা। অথচ ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অচল মেশিনকে সচল করা হয়েছে। এতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে।

কেলোকার মেরামত কাজের শিডিউল ইনচার্জ গোলাম মোস্তাফা জানিয়েছেন, ২১ জুলাই (মঙ্গলবার) ইঞ্জিনটিকে কেলোকাতে পাঠানো হয়েছে। এবারও ট্রাকশন মোটরের সমস্যা হয়েছে। বর্তমানে ইঞ্জিনটি পার্বতীপুর কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় বিকল হয়ে পড়ে আছে।

তিনি জানান, একটি লোকোমোটিভে চারটি ট্রাকশন মোটর থাকে। যখন ২০১৯ সালের মে মাসে ইঞ্জিনটি কেলোকাতে মেরামতের জন্য আনা হয় তখন সেখানকার চারটি ট্রাকশন মোটরই অকেজো ছিল। তখন চারটিই নতুন ট্রাকশন মোটর কিনে লাগানো হয়েছিল। চারটি নতুন মোটর দেওয়ায় ইঞ্জিনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়।

মাত্র তিন মাসের মধ্যে ইঞ্জিনটি দুইবার কেন বিকল হয়ে পড়লো? এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘মেশিনারিজ যেকোনও সময়ই ফেইল করতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।’

তবে কেলোকার সদ্য সাবেক ট্রাকশন মোটর কাজের ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম জানান, প্রথমবার চারটি নয়, মাত্র দুটি ট্রাকশন মোটরের কাজ করা হয়। একটি ট্রাকশন মোটর নতুন দেওয়া হয়। আরেকটি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একটি পুরাতন ট্রাকশন মোটরকে মেরামত করে ইঞ্জিনটিকে সচল করা হয়। লোকোমোটিভের চারটি ট্রাকশন মোটরের দুটি তখন ভালো ছিল।

তিনি আরও বলেন, কেলোকাতে যা কিছুই মেরামত করা হয় সবকিছুই ৬ বছর মেয়াদে করা হয়ে থাকে। তবে মাত্র তিন মাসেই কেন বারবার বিকল হয়ে পড়ছে ইঞ্জিনটি? এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম বলেন, রেল ইঞ্জিনের এই গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশটির বেশিরভাগই বহু পুরনো। মেরামত করেই চালানো হয়। প্রথমবার পরিবর্তন করে যে ট্রাকশন মোটরটি লাগানো হয় সেটিও ১৭ বছর আগে ২০০৩ সালে কেনা। পুরনো ট্রাকশন মোটরের কারণে বারবারই ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পড়ছে।

এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ইঞ্জিন মেরামতে রেলওয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। অনেক ইঞ্জিনই চলতে চলতে বিকল হয়ে যায়, সেগুলোকে নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশ হিসেবে কেলোকাতে পাঠানো হয়ে থাকে। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৯৩৩ লোকোমোটিভটিকেও কেলোকাতে পাঠানো হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।

তবে তিনিও স্বীকার করেন, ট্রাকশন মোটরের কারণেই লোকোমোটিভটি বিকল হয়ে পড়ছে।

SHARE THIS ARTICLE