অবশেষে কুমিল্লার সেই ইকবাল কক্সবাজারে গ্রেপ্তার, ইকবালকে ঘিরে রহস্য

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ কুমিল্লায় কুরআন অবমাননার ঘটনায় আলোচিত যুবক ইকবাল হোসেনকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।

কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম (ক্রাইম অ্যান্ড অ্যাডমিন) বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় বলেন, “ইকবাল নামে ওই যুবককে একটু আগেই আমরা সৈকত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছি।” তাকে কুমিল্লা জেলা পুলিশে হস্তান্তর করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কুমিল্লার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ইকবাল (৩৫) কুমিল্লা শহরের সুজানগরের খানকা মাজার এলাকার নূর মোহাম্মদ আলমের ছেলে। তিনি পেশায় রঙমিস্ত্রি।

ইকবালকে ঘিরে রহস্য : এদিকে ইকবাল হোসেনকে নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। তার মা দাবি করছেন, তার ছেলে ‘পাগল’। অন্যান্য সূত্র থেকে ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে মিলছে ইয়াবা সেবনের সত্যতা। কেউ কেউ বলছেন, ইকবাল ভবঘুরে প্রকৃতির লোক। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, টাকার বিনিময়ে একটি অপশক্তি ইকবালকে দিয়ে মন্দিরে কুরআন রেখেছে। 

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, কুমিল্লার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দায়ী ব্যক্তিকে আমরা চিহ্নিত করেছি। মাজারের সঙ্গে যে মসজিদ, সেটা প্রসিদ্ধ মসজিদ।

লোকটি (যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে) রাত ৩টার দিকে কয়েকবার (সেখানে) গিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, আমাদের যারা এ কাজে অভিজ্ঞ, তারা নিশ্চিত হয়েছেন ব্যক্তিটি মসজিদ থেকে কুরআন এনে রেখেছেন, এটা তারই কাজ। 

জানা যায়, ইকবাল হোসেন কুমিল্লা নগরীর সুজানগর এলাকার মাছ বিক্রেতা নূর আলমের ছেলে। সে মাদকাসক্ত। টাকার জন্য সে তার মা আমেনা বেগমকে বিভিন্ন সময় মারধর করত এবং আসবাবপত্র ভাঙচুর করত।

চুরির অভিযোগে সম্প্রতি এলাকাবাসী তাকে মারধর করে। এরপর ১৫ দিন আগে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ইকবাল মাজারে থাকত।

সম্প্রতি সেখানে (মাজারে) আরও কয়েকজন অপরিচিত ব্যক্তি আসা-যাওয়া করত। পাগলের বেশে থাকা ওই ব্যক্তিরা ঘটনার পর থেকে উধাও। তবে ইকবালের সহযোগী হিসাবে মাজার থেকে অন্তত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৩ অক্টোবর রাত ২টা ১০ মিনিটে দারোগাবাড়ির মাজার থেকে কুরআনসদৃশ গ্রন্থ হাতে নিয়ে পুকুরের পূর্ব পাড় দিয়ে বের হন এক ব্যক্তি।

আরেক ফুটেজে দেখা যায়, রাত ৩টা ১২ মিনিটে পূজামণ্ডপ থেকে আসতে দেখা যায় তাকে। এ সময় তার কাঁধে হনুমান মূর্তির গদাটি রাখা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, মূর্তির যে স্থানে পবিত্র কুরআন রাখা হয়েছে, গদাটি না সরালে হয়তো সেখানে তা (কুরআন) রাখা যেত না।

ইকবাল হোসেনের প্রতিবেশী ও তার পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জানিয়েছে, ইকবাল মানসিকভাবে অস্বাভাবিক ছিল। তার মানসিক অবস্থাকে ব্যবহার করে কেউ ঘটনাটি ঘটিয়েছে।

ইকবাল অনেক কারণে মানসিকভাবে অস্থির ছিল। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পূজামণ্ডপ থেকে কয়েক মিনিট দূরে নগরীর দারোগাবাড়ি মাজার ও মসজিদ যাওয়া-আসা করছিল সে।

সেখানকার কারও উসকানিতে ইকবাল মসজিদ থেকে কুরআন নিয়ে নানুয়ারদিঘির পাড় পূজামণ্ডপে সেটি রেখে আসে। ইকবালের মা বিবি আমেনা জানিয়েছেন, মন্দিরে কুরআন রাখা সংক্রান্ত সিসিটিভির ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার পর ইকবালের বাবা নূর আহম্মেদ, মামা তাজুল ইসলাম ও সাফায়েতকে সাদা পোশাকে পুলিশ বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইকবাল মাদকসেবনে অভ্যস্ত ছিল। নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর এলাকায় নানুর বাড়িতে বড় হয়েছে। ১২ বছর বয়স থেকে ইকবাল মাদকসেবন শুরু করে। প্রায় ১২ বছর আগে তাকে বিয়ে করানো হয়। তবে ইকবালের নানা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার প্রথম স্ত্রী আশা একমাত্র ছেলে তৌসিফকে নিয়ে চলে যায়।

ছেলে হারানোর শোক থেকে ইকবাল আগের চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। পরে তাকে আবার বিয়ে করানো হয়। কিন্তু তার দ্বিতীয় স্ত্রী রুমি করোনা মহামারি শুরুর ঠিক আগে তাকে ছেড়ে চলে যায়।

এটি তাকে মানসিকভাবে আরও অস্থির করে তোলে। পরে মহামারি শুরু হলেও প্রায়ই নগরীর দারোগাবাড়ি মাজারে যেতে শুরু করে ইকবাল। বেশির ভাগ সময়ই সে মাজারে থাকত। 

তদন্তসংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, মণ্ডপে কুরআন রাখায় যে চক্রটি জড়িত, ইকরাম তাদের একজন। তিনিই গত বুধবার সকালে ঘটনাস্থল থেকে ৯৯৯-এ কল করেন। তারপর ওসি আনওয়ারুল আজিম ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

তিনি কুরআন শরিফটি উদ্ধারের পাশাপাশি ইকরামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে থানায় নিয়ে যান। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ইকরাম রাতে নেশা করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে ওই রাতে ৩টি ইয়াবা সেবন করে। পরে মণ্ডপের পাশে অবস্থান নেয়। 

উল্লেখ্য, ১৩ অক্টোবর রাত আড়াইটা থেকে ভোর সাড়ে ৬টার মধ্যে কুমিল্লা শহরের একটি মন্দিরে কুরআন রাখার ঘটনা ঘটে। এর জের ধরে নানুয়া দিঘিরপাড় পূজামণ্ডপসহ নগরীর কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।

পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, প্রতিমা ভাঙচুর, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এ ইস্যুতে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (ইনস্পেকশন) মোহাম্মদ শাহ জালাল বলেন, কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে সারা দেশে এ পর্যন্ত ৭২টি মামলা হয়েছে। ৪৫০ জন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। 

কুমিল্লা ব্যুরো জানায়, বৃহস্পতিবার বিকালে নানুয়ারদিঘিরপাড় এলাকায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এই ঘটনায় পুলিশের গঠিত অনুসন্ধান দল। পুলিশের ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) ওয়াই এম বেলালুর রহমানের নেতৃত্বে দলের সদস্যরা এলাকা পরিদর্শন করেন।

তারা পূজামণ্ডপের লোকজনসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পুলিশ জানায়, অনুসন্ধান দলটি আজ চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এবং আগামীকাল শনিবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ এলাকা পরিদর্শন করবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করবে। এরপরই তারা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে প্রতিবেদন দাখিল করবে।

SHARE THIS ARTICLE