
ডাঃ মুসাব্বির হোসাইনঃ প্রত্যকটি মানুষের জীবনে রয়েছে নানান ঘাত-প্রতিঘাত এবং নানামুখী সংগ্রামের বিচিত্র সব অব্যক্ত কাহিনী। সেসব কাহিনী কখনো কখনো কল্পকাহিনীকেও হার মানিয় যায়। Fact is stranger than fiction. আজ আমি আমার জীবনে তথা আমাদের পারিবারিক জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা তুলে ধরছি। আমার বড় ছেলে, মুনাসিব হোসেইন। ওকে কখনো আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া সম্ভব হয় নি। ও বর্তমানে ডাবলিনের “ট্রিনিটি কলেজ”-এ এমবিবিএস ২য় বর্ষের স্টুডেন্ট।

আমার ৩ ছেলেমেয়ের মধ্যে আমার এই ছেলেটি সবচেয়ে নম্র এবং ভদ্র। ওকে নিয়ে আমার একটাই অভিযোগ এবং তা হলো, ওর অনেক বন্ধু বান্ধব। অনেকটা বাবার মতো বন্ধু প্রিয়। আমিও আমার Students life- এ অনেক আড্ডাবাজ ছিলাম। সেদিন ছেলেকে বললাম, তোমার ২য় সেমিস্টারের রেজাল্ট পাঠাও। কিছুক্ষণের ভেতর ও ওর রেজাল্ট পাঠিয়ে দিল। আলহামদুলিল্লাহ, ও সবগুলো সাবজেক্টে “ফার্স্ট ক্লাস অনার্স” পেয়েছে। এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা সাধারণত হাতে গণা কয়েকটি মাত্র। সচারাচর অল্প সংখ্যক মেধাবী স্টুডেন্টদের দ্বারাই অর্জন করা সম্ভব। আরেকদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, নিয়মিত নামাজ পড়ো তো? আজ ক’ওয়াক্ত নামাজ পড়েছো? প্রত্যুত্তরে বললো, ৩ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে। আমি বললাম, ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে বাবা। বর্তমান ইয়ং জেনারেশনের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সমস্যা হলো, ওদেরকে কোন ব্যাপারে বেশী চাপ দেয়া যায় না, তাতে হীতে বিপরীত হতে পারে। আর তাই আমি ওদেরকে পথ ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। আমরা অনেক সময় নিজেকে ওদের বয়সের এর সাথে মেলাই। একবার ভেবে দেখুন তো ঐ বয়সে আমরা নিজেরাই কতটুকু বা আল্লাহর রাস্তায় ছিলাম?
হঠাৎ মনে পড়ে গেলো মদীনার কথা। একটা লম্বা সময় রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় চাকুরীর সূত্রে আমার সুযোগ হয়েছিল মহান নবীর “রওজা মুবারক”- এর কাছাকাছি থাকার। আমি তখন সৌদি আরবে Ministry of Health – এর অধীনে একটি সেকেন্ডারী কেয়ার হাসপাতালে “রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান” হিসেবে কর্মরত ছিলাম। একদিন আমি ইমার্জেন্সিতে ডিউটি করছিলাম, আমার সাথে একজন টার্কিশ কলিগ ডক্টর আবদুস সাত্তারও ডিউটিতে ছিলেন। সেদিন আমি মানসিক ভাবে একটু বিষন্ন ছিলাম। কারণ সম্প্রতি MRCP (Medicine) Final (part)- এর রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে এবং Unfortunately আমি অকৃতকার্য হয়েছি।

একসাথে ডিউটি করার সময় আমরা অনেক কিছু আমাদের সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করে থাকি। আমিও মনের ভেতরে চাপা পড়ে থাকা দুঃখটাকে কিছুটা হালকা করার নিমিত্তে ডক্টর আবদুস সাত্তারের সাথে শেয়ার করলাম।। আমার কথা শুনে ডক্টর আবদুস সাত্তার যে কথাগুলো বললেন তা শুনে আমি রীতিমতো “থান্ডার্ড” হয়ে পড়ি। উনি বললেন, “আরে ডক্টর এটাতে এত মন খারাপ করার কিছু নেই। এটা তো জাস্ট আমাদের দৈনন্দিন পার্থিব জীবন বা ইহলৌকিক জীবনের একটি পরীক্ষা মাত্র। আসল পরীক্ষা তো হলো, মৃত্যুর পর রোজ কেয়ামতের দিন বা আখেরাতে। সুতরাং এখন থেকে রোজ কেয়ামতের দিনের পরীক্ষার জন্য আমাদের সবার প্রস্তুতি নেয়া উচিত। ” ওনার কথাগুলো শুনে আমি এক রকম স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। মূহুর্তের মাঝে আমার চিন্তার জগতে এক মহা আলোড়ন শুরু হলো। আসলেই তো, আমি নিজে তো কখনো এভাবে চিন্তা করি নি এবং নিজেকেও পরকালের জন্য সেভাবে পূর্ণাংগ রূপে তৈরী করার চেষ্টা করিনি।
আজ থেকে ১২ বছর আগের ঘটনা হলেও আজও বিষয়টি আমার চিন্তার জগতে এবং স্মৃতিতে সদা দেদীপ্যমান রয়েছে। আজ আমি এমন একটা সময় এই লেখাটি লিখছি যখন আয়ারল্যান্ডে Junior Certificate & Leaving Certificate Exams চলছে। আমি চাই আমাদের দেশের নব প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও সবাই এ জাতীয় Test -এ ভালো রেজাল্ট করুক। আপনারা সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন, ও যেনো একজন নিবেদিত প্রাণ ও মানবিক চিকিৎসক হিসেবে এবং একজন ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সমর্থ হয় । এই প্রজন্মের চিকিৎসকদেরকেই আগামীদিনে আমাদের চিকিৎসার দায়ভার গ্রহন করতে হবে। দিনে দিনে আমাদের সবারই বয়স বাড়ছে, আমরা আর কতদিনই বা ডাক্তারী করতে পারবো???
রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় আমার ছেলেমেয়েদের একাডেমি সাফল্যের পেছনের মূল কারিগর হলো, ওদের মা। অর্থাৎ আমার স্ত্রী ডক্টর রীতা আউয়ালের। সুতরাং All credit’s goes to her. আয়ারল্যান্ড আসার আগে আমি যখন মদিনায় কর্মরত ছিলাম, আমার স্ত্রী তখন বাংলাদেশে তখন সরকারী চাকুরীর পাশাপাশি পোস্টগ্রাজুয়েশন ডিগ্রী করার জন্য প্রানন্ত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। একদিকে বাচ্চাদের টেককেয়ার করা এবং ওদের পড়াশুনা তদারকি করা এবং নিজের পোস্টগ্রাজুয়েশন কোর্সের পড়াশুনা কন্টিনিউ করা, সব মিলিয়ে খুব কঠিন একটা সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ রহমতে “Obs & Gynae” – তে ও এমএস (Ms Gynae) পোস্টগ্রাজুয়েশন ডিগ্রীটাও যথা সময়ে কমপ্লিট করে। বাচ্চাদের পড়াশুনা একটা সুবিধাজনক স্তরে পৌছানো পর্যন্ত উনি বাংলাদেশে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন।
একদিকে বাংলাদেশে সরকারী চাকুরীতে পোস্টগ্রাজুয়েশন ডিগ্রীধারী চিকিৎসক হিসেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। অন্যদিকে স্বামী সন্তান এবং পরিবারের দায়িত্ববোধ। সব মিলিয়ে একটা দোটানা অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমার মেয়েটাও তখন ছোট। তাই ও মদিনায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। মদিনায় আসার পর এবার ও MRCOG (UK) পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং যথা সময়ে এমআরসিওজি কমপ্লিট করে। মানুষের সব সাফল্য সব সময় তাঁর বাবা-মায়ের পক্ষে প্রত্যক্ষ করে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় না।আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। ওর এমআরসিওজির রেজাল্টের কদিন আগেই আমার শ্বশুর ইন্তেকাল করেন। আমার শ্বশুর অধ্যাপক আবদুল আউয়াল (প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান, সার্জারী বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ), ২০১৮ সনে ইন্তেকাল করেন। ওনার খুব সখ ছিল ওনার প্রথম নাতি যেনো ডাক্তার হয়। উনি অবশ্য নাতির ডাক্তার হওয়াটা দেখে যেতে পারেন নাই। দোয়া করি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ওনাকে বেহেশত বাসী করুন, আমিন। বাচ্চাদের নিয়ে প্রথমে মদিনায় আসলেও পরবর্তীতে আমরা স্বপরিবারে আয়ারল্যান্ডে মাইগ্রেট করি। বর্তমানে আমরা দু’জনই আয়ারল্যান্ডে একই হাসপাতালে অর্থাৎ Cork University Hospital এ কর্মরত আছি। আলহামদুলিল্লাহ।
লেখকঃ চিকিৎসক, MBBS (Dhaka), MRCP (Ireland), MRCP (Glasg), Diploma in Stroke and Cerebrovascular Medicine (RCPI) মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। সিনিয়র রেজিস্ট্রার জেরিয়েট্রিক ও স্ট্রোক মেডিসিন। কর্ক ইউনিভার্সিটি হসপিটাল আয়ারল্যান্ড।