এ,কে,আজাদ- আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ দেহের স্বাস্থ্যের জন্য আমরা অনেক কিছুই করে থাকি। খাবার পরিমিত খাই, নিয়মিত ডায়েট করি, কেউ কেউ জিমে ভর্তি হয়ে করে শরীরচর্চা করে, কেউ আবার ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়। কিন্তু প্রতিদিনের কাজ, চিন্তা, দৌড়াদৌড়ি-এসবের ফলে আমাদের যে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, তার কথা কি আমরা একবারও খেয়াল করি? প্রমথ চৌধুরী বই পড়া প্রবন্ধে যেমন বলেছিলেন, ‘দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, কিন্তু আত্মার মৃত্যু হয় না’। এই আত্মাই হলো মানুষের স্বাস্থ্য। মানুষের আনন্দ, মানুষের ভালো থাকার উপায়। আর এই আত্মা ভালো থাকলেই মানুষ সুখী, মানুষ তখন মানসিকভাবে সুস্থ।
আমরা দৈনন্দিন জীবনের দৌড়ঝাঁপে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এতটাই ক্লান্ত যে নিজের প্রতি যত্নশীল হতে পারি না। একসময় আমরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি, যা থেকে মানসিক সুস্থতা বিঘ্নিত হয়। আমরা কিছু কৌশল অবলম্বন করলে মানসিক সুস্থতা লাভ করতে পারি।
নিজেকে সময় দেওয়া
নিজেকে সময় দেওয়ার অর্থ নিজের ভালো লাগার দিকগুলো বিবেচনা করা। নিজেকে মূল্য দেওয়া, নিজের আবেগকে সম্মান দেওয়া, নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করা। আমরা প্রতিনিয়ত অন্যের কথা চিন্তা করি, অন্যের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ভাবি, অন্যেরা আমাদের নিয়ে কী ভাবল না ভাবল-সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি। এতে করে মানুষ সব সময় অপরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যার ফলে নিজের যত্ন নেওয়া, খেয়াল রাখা ভুলে যায়।
প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো
পছন্দের কাজ করা, নিজের পছন্দের আশপাশে থাকা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। যাবতীয় নেতিবাচকতাকে পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার। তাই আমাদের আশপাশে এমন কিছু মানুষ থাকে, যাদের পাশে থাকাতে আমাদের জীবন হয়ে ওঠে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ। আমরা সেই সব মানুষের সঙ্গে থাকতে পারি, তাদের সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটাতে পারি। আপনার যে বন্ধু আপনার সব সময় পাশে থাকে, যাকে আপনি নির্দ্বিধায় সব বলতে পারেন, যে কখনো আপনাকে ক্ষুদ্র অনুভব করতে দেয় না, যে আপনার ভালো দিক, মন্দ দিক সব জানে-তার সঙ্গে আপনি সময় কাটাতে পারেন।
ভ্রমণ
প্রতিদিনের কাজের চাপে আমাদের জীবন ঘড়ির কাঁটা ৯-৫টার মাঝেই আটকে থেকে যায়। জীবনে ব্যস্ততার পাশাপাশি অবসরেরও প্রয়োজন আছে। রাতকে দিন, দিনকে রাত করে যেভাবে আপনি আপনার ক্যারিয়ারের জন্য নিজের সময়কে প্রতিদিন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত, ঠিক তেমনি নিজের মনের ইচ্ছা গুলোর জন্যও সময় দেওয়াটা প্রয়োজন। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকা শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক নয়।
তাই ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও পাহাড়, নদী, সমুদ্রের সঙ্গে গল্প করে আসা জরুরি। আমরা প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের আছে অটুট সম্পর্ক। এ কথাটি আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। মানসিক সুস্থতার জন্য আমাদের দরকার একটু এখানে সেখানে ঘুরে আসা।
শখের কাজ
কথায় আছে, ‘শখের দাম আশি তোলা’। শখের বশে কেউ গান গায়, কেউ ছবি আঁকে। কেউ ডায়েরিতে চমৎকার সব শব্দ দিয়ে কল্পরাজ্যের মতো সাজিয়ে তোলে নিজের মনের কথা। অন্যের ক্ষতি না করে ভালো লাগে, তা-ই করুন। আপনার হাসি আপনি দেখে নিজের মতো করে সুখ খুঁজে নিন কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও।
কেনাকাটা
কেনাকাটা করলে মানুষ ব্যস্ত থাকে। নতুন নতুন জিনিস চোখের সামনে আসে। এতে করে মানুষের জীবনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কেনাকাটার পণ্য ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে; রঙিন পোশাক, বাতি, ঘর সাজানো কারুকাজময় জিনিস ইত্যাদি দেখলে মন ভালো থাকে। এ জন্যই মানুষ প্রতি বছর আর্ট সামিট, বাণিজ্য মেলা, বৃক্ষ মেলায় দল বেঁধে যায়। আমাদের জীবন বৈচিত্র্য পছন্দ করে। তাই বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের থাকা উচিত। জীবন হলো শিল্পীর ছবি আঁকার ক্যানভাস; এখানে যত রঙের ব্যবহার করব তত এই জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে।
রান্না করা
প্রতিদিন নিত্য-নতুন রান্না করার মাধ্যমেও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। কেননা রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিকল্পনা, নতুন কিছু করার উদ্যোগ, আনন্দ। বিভিন্ন উপাদান পরিমাণমতো মিশিয়ে সুস্বাদু কোনো খাবার তৈরি করা হলে সে খাবারের সঙ্গে মানসিক প্রশান্তির তৃপ্তির একটি সংযোগ তৈরি হয়।
বই পড়া
বই মানুষের প্রিয় বন্ধু, কেননা বইয়ের রাজ্যে থাকলে আপনি জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, হতাশা থেকে অনেক দূরে থাকতে পারবেন। ব্যক্তিগত জীবনের গ্লানি, ক্ষোভ, ব্যর্থতা থেকে কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে আসতে হলে আমরা বইয়ের সাহায্য নিতে পারি। বইয়ের পাতায় পাতায় থাকে বিভিন্ন গল্প, সেসব বিভিন্ন গল্পের মধ্যে বিভিন্ন চরিত্র থাকে আর অনেক সময় এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমাদের জীবনের গল্প মিলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা এসব গল্পের সঙ্গে নিজেদেরও এক করে দেখি।
আর তাই হয়তো রূপা নীল শাড়ি পরে বলে আপনিও নীল শাড়ি পরতে চান। কিংবা রুমির হৃদয় স্পর্শ করা কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে নিজের সত্তাকে খুঁজে পান। বই আমাদের আশ্রয়, আমাদের ভালো থাকার জায়গা। মানসিক সুস্থতার জন্য দিন শেষে প্রতিদিন একটু হলেও বই পড়া উচিত।
সিনেমা দেখা
বইয়ের মতো আরেকটি রাজ্য আছে, যেখানে আমরা হারিয়ে যেতে চাই, যেখানে আমরা নিজেদের দেখি, অনুপ্রাণিত হই, মুগ্ধ হই। আর সে রাজ্য হচ্ছে সিনেমার। সিনেমা আমাদের এক মুহূর্তে যেমন নস্টালজিয়ায় ফেলে দেয়, ঠিক অপর মুহূর্তে কোনো এক করুণ দৃশ্যে কষ্ট দেয়, আবার জিম ক্যারির অভিনয় দেখে মুখে হাসি ফোটে।
গাছ লাগানো
এর মাধ্যমে কিছুটা সময় হলেও আমরা প্রকৃতির কাছে থাকতে পারি। গাছ লাগানো এবং পরিচর্যা করা শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ভালো। আর এভাবে নিজের সঙ্গে কিছু সময় একা কাটানোও যাবে। গাছ লাগানো, গাছের পরিচর্যা, গাছ দিয়ে বারান্দা বা ঘর সাজানোর মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়, এবং একই সাথে প্রশান্তি মেলে।
নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে অতিমাত্রায় জড়িয়ে থাকার ফলে আমরা নিজের থেকেই ক্রমশ দূরে সরে যাই, যার চরম পর্যায়ে আমাদের মাঝে মাকড়সার জালের মতো হতাশা বাসা বাঁধে। তখন আমরা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এই অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি এবং তার জন্য নিজেকেই নিজের খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিদিন।