
ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ আফগানিস্তানে তালেবানরা কাবুল দখলের মাসখানেক পর নূতন সরকার ঘোষণা দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছিলো ১১ই সেপ্টেম্বর’২১। এই অনুষ্ঠানে তারা ছয়টি দেশকে অংশগ্রহণের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল বলে সংবাদে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ছয়টি দেশ হচ্ছে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান, কাতার এবং ইরান। এই সরকারগুলোর পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত না হলেও আমরা জেনেছি যে, রাশিয়া কাতারের মাধ্যমে ঐ দিনে অভিষেক না করার জন্য জানায়। আমেরিকার কয়েকটি মিত্র দেশও এই অনুরোধ জানিয়েছিল বলে জানা গেছে। তাই শেষ মুহূর্তে তালেবেনরা পিছিয়ে এসে অনুষ্ঠান স্থগিত করেছে। নূতন কোন তারিখ এখনো ঘোষিত হয়নি। আমার মনের কোণে একটা বাসনা জন্ম নিয়েছে, “আহারে আমি যদি এই অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারতাম? আমি যদি নিমন্ত্রণ পেতাম!
আপনাদের মনে হতে পারে, ”কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে?” আপনাদের মনে হতেই পারে। কিন্তু আমি ত আর “মন্থরা” নই। আপনারা হয়তবা জিজ্ঞাসা করবেন, “মন্থরা আবার কে”? “মন্থরা” ছিলেন অযোধ্যার রাজা দশরথের দ্বিতীয় স্ত্রী কৈকেয়ীর, বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত এক দাসী। বড় কুরূপা, কুব্জা, বিকৃতাকার, বক্রদেহী, ঈর্ষাপরায়ণা, কূটবুদ্ধিতে ভরা ও কুমন্ত্রণায় নিপুণা। কিন্তু কৈকেয়ীর বড় হিতাকাঙ্ক্ষী ও বিশ্বস্ত।

একসময় রাজা দশরথ, কৈকেয়ীর বড় সেবা পেয়েছিলেন। অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রাজা দশরথ ক্ষতবিক্ষত দেহে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। কৈকেয়ী রণস্থল থেকে তাঁকে এনে সেবা শুশ্রূষায় সারিয়ে তোলেন। রাজা বলেন—”দুটি বর দেব”। কৈকেয়ী বললেন, “পরে নেব”। উত্তরাধিকারী হিসেবে রামচন্দ্রের সিংহাসনে বসার সময় যখন এলো, “মন্থরার” কুমন্ত্রণায় কৈকেয়ী পুরনো বর দুটি চেয়ে বসলেন। রামের পরিবর্তে ভরতের রাজ্যাভিষেক ও রামচন্দ্রের জন্য ১৪ বছরের বনবাস। সত্য রক্ষার্থে রাজাকে তা মানতে হয়েছিল। এই হলো “মন্থরা”, যার কুমন্ত্রণায় রামরাজ্য ত্যাগী হয়েছিলেন, সীতা গিয়েছিলেন বনবাসে।

তা, আমাদের “ভরতচন্দ্র” যদি “তালেবান” হয়ে থাকে তাহলে “কৈকেয়ী” কে আর “মন্থরাই” বা কে? আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই ১৯৭৯ সালে এই আফগানিস্তান নামক দেশটিকে দখল করেছিলো রাশিয়ার সেনাবাহিনী, তখন “মুজাহেদিন” সৃষ্টি করেছিলো “মার্কিন-পাকিস্তান” চক্র আর তার ফলশ্রুতিতে ১০ বছরের মাথায় ১৯৮৯ সালে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়া যায় রাশিয়া। সেই সময় কৈকেয়ী ছিল মার্কিন আর মন্থরা ছিল পাকিস্তান। দেশের জনগণ “রামচন্দ্র” দীর্ঘদিন বনবাসে, ফেরার কোন নাম নেই, তিনি লিখছেন সীতার প্রেম কাহিনী। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৬ সালে রামরাজ্যে চলে গৃহযুদ্ধ। তাতে মারা গেলো রামের অসংখ্য প্রজা। তারপর ক্ষমতায় এলো নূতন “ভরত” নাম তার “তালেবান”; ১৯৯৬-২০০১ সাল, তালেবান শাসনে আবার শুরু হলো “কৈকেয়ী” আর “মন্থরার খেলা” এবারে কৈকেয়ী স্বয়ং “ভরতকে” সরিয়ে ক্ষমতা নিলেন, থাকলেন ২০ বছর।
২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৩০০০ মার্কিনী আর তার প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তান দখল করে প্রানদিলো আরও ৩০০০ মার্কিন সৈন্য, ৭০,০০০ আফগান সৈন্য আর ৫০,০০০ আফগান জনগণ। ব্যয় হলো ২ -৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার। “ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল, কিছু দূর গিয়া মর্দ রওনা হইল। ছয় মাসের পথ মর্দ ছয় দিনে গেল!, লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখি ১ লক্ষ ২০ হাজার।” আহারে! কি চিত্ত সুখ!

প্রতিশোধ আর কাকে বলে? এক ওসামা বিন লাদেনের জন্য বিশ্বটাকে ওলটপালট করে দিলো “বুশ”। তাহলে আমি কি উসামা বিন লাদেনের পক্ষে সাফাই গাইছি। না সেটা নয়, বরং দেখছি কিভাবে নিউটনের তৃতীয় অভিব্যাক্তি এখানে আংশিক মিলে যায়, “প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে”। এখানে দেখা যাচ্ছে, “প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তবে এই প্রতিক্রিয়া মূল ক্রিয়ার চেয়ে শতগুণ বেশী”। এখন আবার “ভরত” ক্ষমতায় “কৈকেয়ী” এবার “রাশিয়া” আর “মন্থরা” আবারো পাকিস্তান। রামচন্দ্র তবুও বনবাসে। এবারে দেখতে হবে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার ফলাফল আরও কত ভয়াবহ হতে পারে। দেশের জনগণ নিদ্রিত হলে, কি ভয়াবহ হতে পারে দেশের অবস্থা এটাই তার নমুনা। নিজের দেশের মানুষ যখন অন্তর্কলহ মিটাতে বহির্বিশ্বের সাহায্য নেয় তখন ফলাফল দেখেছি আমরা ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি দেশের বেলা। আফগানিস্তানের মানুষ যদি বিদেশী শক্তিকে গ্রহণ না করে, তাহলে কোন শক্তিই ঐ দেশে আসন গাড়তে পারেনা। তালেবানের কথাই দেখুন না, দেশটির ৩ লক্ষ মার্কিন প্রশিক্ষিত আর অস্ত্র সজ্জিত বাহিনী যখন এক তৃতীয়াংশ তালেবানের হাতে অস্ত্র সমর্পন করে আর জনগণ যখন রাস্তায় নামেনা তখন এটা বুঝে নিতে কারো কষ্ট হয়না যে সেই দেশের জনগণ কোথায়?

তাই আমি যেতে চেয়েছি, ইতিহাসের এই গুরুত্ত্বপূর্ন সময়ে যদি তার কুশীলবদের দেখতে পারি চর্মচক্ষে। তাই বলেছি, “আহারে যদি নিমন্ত্রণ পেতাম”। আমি দেখতে পারতাম কে আসলে আফগানিস্তান সরকার হচ্ছেন? আপনারা মনে করতে পারেন, “এটা আমার মানসিক সমস্যা।” এই সমস্যা হওয়ার যথেষ্ট কারণ যে নাই তা হলপ করে বলতে পারবোনা। তবে আমার যাওয়ার ইচ্ছার পিছনে আরও কয়েকটি বিশেষ কারণও আছে।
মোগল সম্রাট আকবর একদিন তার সভাসদ নিয়ে বসে আছেন। ঐ মুহূর্তে ইরানের শাহানশাহের পক্ষ থেকে একটা নিমন্ত্রণ পত্র এলো যে, তারা শুনেছেন আকবর বাদশাহের নবরত্নের একজন রত্ন আছেন বীরবল, যিনি প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন, তাই তারা বীরবলকে ইরান যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন। বাদশাহ আকবর প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে বীরবলকে ইরানের শাহেনশাহের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। বীরবল গেলেন তেহরানে, ইরানের বাদশাহর দরবারে। দরবারে ঢুকে বীরবলের মাথা গেলো, ঘুরে। তিনি দেখতে পেলেন সেখানে একইরকম দশটি সিংহাসনে একইরকম দশজন শাহেনশাহ বসে আছেন। তাদের প্রত্যেকের মাথায় একই রঙের পাগড়ী, একই রকম দাড়ি, একই রকম কোর্তা, একই রকমের আচকান আর চাদর। দ্রুত তিনি বুঝে নিলেন এটা তার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। কে যে আসল শাহেনশাহ সেটা তিনি নির্ধারন করবেন কিভাবে?

সেই যাত্রা মারাত্নক বুদ্ধিমত্তার জোরে বীরবল বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি সোজা গিয়ে একজনকে কুর্নিশ করে বাদশাহ আকবরের পাঠানো উপঢৌকন প্রদান করলেন। সবাই আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছিলো, কেননা উনি আসল শাহেনশার কাছেই গিয়েছিলেন। কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো? বীরবল খুব তীক্ষ্ণভাবে খেয়াল করলেন যে, মঞ্চে উপবিষ্ট সকলেই বীরবলের দিকে না তাকিয়ে মঞ্চে উপবিষ্ট একজনের দিকে তাকিয়ে আছেন আর সেই লোকই একমাত্র যিনি মঞ্চ থেকে বীরবলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি মুহূর্তেই বুঝে নিলেন যে, নকল সম্রাটরা দেখছিলেন আসল সম্রাট কি করেন, যাতে উনারা তাকে অনুসরণ আর অনুকরণ করতে পারেন, আর আসল শাহেনশাহ দেখছিলেন বীরবল কি করেন।
আমি ও আমার বুদ্ধিমাত্রা এবার পরখ করে দেখার একটা সুযোগ চাই। কে যে সরকার হচ্ছেন, সেটা দেখার বিষয়। মাঠে এবার রাশিয়া, চীন, তূর্কি, ইরান, পাকিস্তান ও কাতার। এ যেন এক কুরুক্ষেত্র! সিংহ আসনে ৬ জন শাহেনশাহ। মাঠে নেমেছেন মুল্লা বাহিনী। এই সরকারে সবাই মুল্লা, এদের অনেকের নামের সাথে আখুন্দ লাগানো আছে আর অনেকের নামের সাথে লাগানো আছে হাক্কানি। জানা দরকার এরা কি একই পরিবারের সদস্য নাকি এরা একই তরিকার সদস্য।
এদের অধিকাংশ সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্ব তেমন কিছুই জানেনা, এটা কেমন কথা? সেটাও দেখা দরকার। আবার, এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্য্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছিলেন অত্যন্ত কঠোরভাবে। এমন কঠোর যে, তারা দেশটির নারীদেরকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলো ঐ পাঁচ বছর? সেই সরকার শুধুমাত্র পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে স্বীকৃতি পেয়েছিলো। দেশটি তখন মোল্লা উমরের নেতৃত্বে দেওবন্দী ব্যাখ্যার ইসলামী শরিয়া আইন দ্বারা শাসিত হয়েছিলো। পশ্চিমা বিশ্বের প্রেসক্রিপশনের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছিলো উপক্ষিত। নারী ও মেয়েদের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কিংবা রাষ্ট্রে কাজকর্ম নিষিদ্ধ হয়েছিলো। পর্দা প্রথা এবং মাহরাম নিয়ে চলাচলের বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছিলো। আমি দেখতে চাই আধুনিক বিশ্বে এমন একটি দেশ যেখানে নারীরা তাদের ঐ ব্যাবস্থা মেনে চলছিলো। ঐ পাঁচ বছরে তালেবানরা কি করে নাই? তাদের শাসিত ৫টি বছর দেশটি ত চলেছিলো, ভেঙ্গে যায়নি কিংবা দুর্ভিক্ষও হয়েছে বলে শুনিনি। তাহলে দেশটা কোননা কোনভাবে তারা চালিয়েছিলো, কিন্তু কিভাবে?
তারা বিপুল বিক্রমে ভেঙে ফেলেছিল ১৫০০ বছর আগে বামিয়ান উপত্যকায় নির্মিত বৈরোকানা বুদ্ধ এবং গৌতম বুদ্ধের স্মারক মূর্তি। তালেবান সরকার মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের আদেশে ২০০১ সালের মার্চ মাসে মূর্তিগুলো উড়িয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ২০০১ সালের ৬ই মার্চ, টাইমস পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে মোল্লা উমর বলেছিলেন, “মুসলমানদের প্রতিমা ভাঙার জন্য গর্বিত হওয়া উচিত। এটা আল্লাহর প্রশংসা করেছে যে আমরা তাদের ধ্বংস করেছি।” সেই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াকিল আহমদ মুতাওয়াকেল বলেছিলেন, এটি দেশটির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ছাড়া অন্য কিছু ছিল: “আমরা ইসলামী আইন অনুযায়ী মূর্তি ধ্বংস করছি এবং এটি সম্পূর্ণরূপে একটি ধর্মীয় বিষয়।” বিংশ শতাব্দীতে এসে এধরনের কাজ করে আবার বুক ফুলিয়ে এসকল কথা বলার মত মানুষগুলোকে এক নজর দেখার আমার বড়ই শখ হচ্ছে। মোল্লা উমর আজ নেই কিন্তু তার সন্তান মোল্লা ইয়াকুব এই দেশটির ত্রানকর্তাদের অন্যতম।

ঐ দেশে জামাই আদরে থেকেই বিশ্বের রাজা মশাইয়ের মাথা ভেঙেছিলেন “ওসামা বিন লাদেনের আলকায়েদা।” আর সেই কারণে বিশ্বের চেহারা পাল্টে গিয়েছিলো। আমেরিকা আফগান সরকারের কাছে সেই একটি মানুষকে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়ের জামাই বলে কথা, তাকে কিভাবে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়া যায়। তাই তারা রাজী হয়নি।
২০০১ সালে যে তালেবানকে সরিয়ে দিয়ে দেশ দখল করেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ সেই তালেবানের হাতে মার খেয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পরাজিতের বেশে পালিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। ২০ বছর পর আজ আবার সেই তালেবানরা ফিরে এসেছে ক্ষমতায়। প্রতিশোধের স্পৃহা মাথায় নিয়ে কতদূর যাওয়া যায় সেটা দেখা আমার বড়ই ইচ্ছা। সেই তালেবানের “মোল্লা” সরকারকে দেখার আমার বড়ই ইচ্ছা।
আমার ইচ্ছা! দেখি, তালেবান সরকার
মনে মনে ভাবি আমি, দেখাটা ভীষণ দরকার
লাখে লাখে প্রাণ যায়, কাতারে কাতার!
মার্কিন মুলুক যেন, শক্তির আঁধার;
শক্তির মৃত্যু নেই, বিশ্ব এক অনন্ত বাজার
মনুষ্যত্ব-বিবেকহীন এক জিঘাংসার পাথার
আমার ইচ্ছা দেখি, এবারের তালেবান সরকার!!