মোঃ জাকির হোসেন, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ঃ যেকোনও অবৈধ জন্মই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সমস্যার। হোক তা সন্তান, সংগঠন, সরকার কিংবা রাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনকে ভেঙে কৌশলে ইসরায়েল নামে যে অবৈধ রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া হয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই অবৈধ ছিল। জন্মের পর থেকেই এটি আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুদ্ধ, সহিংসতা, মৃত্যু, বিভীষিকা, দখলদারিত্ব নিয়তি হয়ে উঠেছে। ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইল আয়তনের ফিলিস্তিন ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যানরা পরাজিত হলে ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়। ১৯২২ সালে জাতিপুঞ্জ ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনের দখলদার হিসেবে স্বীকার করে এবং জাতিপুঞ্জের পক্ষ হয়ে সাময়িকভাবে ফিলিস্তিন প্রশাসন পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সাময়িক ম্যান্ডেট প্রদান করে। উল্লেখ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ভূখণ্ড বা অঞ্চলের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় যেগুলো পুরোপুরি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র না হলেও তারা পরাধীন বা উপনিবেশ ছিল না। এগুলো হচ্ছে জাতিপুঞ্জের অধীন ম্যান্ডেটকৃত অঞ্চল ও জাতিসংঘের অধীন ট্রাস্টকৃত অঞ্চল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিজিত শত্রুপক্ষ অর্থাৎ জার্মানি, ইতালি ও তুরস্কের কাছ থেকে দখল করে নেওয়া উপনিবেশগুলো নিয়ে ম্যান্ডেটকৃত অঞ্চল ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজিত শত্রুপক্ষের কাছ থেকে দখল করে নেওয়া উপনিবেশগুলো ও ম্যান্ডেটকৃত অঞ্চল নিয়ে ট্রাস্টকৃত অঞ্চল গঠিত হয়। সাবেক জাতিপুঞ্জের অধীন ম্যান্ডেটভুক্ত ও জাতিসংঘের অধীনে ট্রাস্টকৃত অঞ্চলগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত সময়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য এসব অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত কোনও রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের অধীনে প্রদান করা হয়।
অনুরূপভাবে ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ সরকারের অভিভাবকত্বের অধীন করা হয়। এদিকে ইহুদিরা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র (তাদের ভাষায় Jewish National Home)গঠনের জন্য। ব্রিটিশরা ১৯১৭ সালে বেলফোর ডিক্লারেশন (ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম অনুসারে)-এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য ‘ইসরায়েল’ রাষ্ট্র গঠন করার অঙ্গীকার করে। রাষ্ট্র গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ইহুদি ফিলিস্তিনে না থাকায় ব্রিটিশরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসে এবং ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করতে থাকে। অন্যদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। এর মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। ফিলিস্তিনিদের জমিজমা ইহুদিরা দখল করে নেয়।
১৯২২ সালে ইসরায়েলে ইহুদি ছিল মাত্র ১২ শতাংশ, ১৯৩১ সালে তা হয় ২৩ শতাংশ, আর ১৯৪৭-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ শতাংশে। ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন আরবদের চরম বিরোধিতার মুখে পড়ে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনকে কেন্দ্র করে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ২ এপ্রিল নবগঠিত জাতিসংঘকে একটি চিঠি দেয় পরবর্তী সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিন ইস্যুকে এজেন্ডাভুক্ত করে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য সুপারিশ গ্রহণ করতে।
সাধারণ পরিষদ একই বছরের ১৫ মে ১০৬ নং সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ফিলিস্তিন বিষয়ে অনুসন্ধান করে উপযুক্ত সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য U.N. Special Committee on Palestine(UNSCOP)গঠন করে। UNSCOP ১৯৪৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত তার রিপোর্টে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উল্লেখ করেছিল তা হলো–
এক. ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বিভক্ত করে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে।
দুই. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপনান্তে আন্তর্জাতিক আইনে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এই অধিকারের মূল কথা হলো, প্রতিটি জাতির নিজের ভাগ্য নিজেরই নির্ধারণ করার অধিকার রয়েছে।
জাতিসংঘ সনদের ১(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে,‘জাতিসংঘের উদ্দেশ্য হলো: বিভিন্ন জাতির মধ্যে সম-অধিকার ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতির ভিত্তিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রসার ও বিশ্বশান্তি দৃঢ় করার জন্য অন্যান্য উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ। ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে দেওয়ার সময় ম্যান্ডেটে ফিলিস্তিনিদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত ছিল। এতদসত্ত্বেও ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের দোহাই দিয়ে ও ইহুদিদের জন্য Jewish National Home প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ফিলিস্তিনে কেবল আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রযোজ্য হবে না বলে UNSCOP সুপারিশ করে।
তিন. ফিলিস্তিনে মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ আরব আর ৩৩ শতাংশ ছিল ইহুদি। মোট ভূমির ৮৫ শতাংশের মালিক আরবরা আর ৭ শতাংশের মালিক ইহুদিরা। আরবদের নিয়ন্ত্রণে ৮৫ শতাংশ ভূমি থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের ৪৫.৫ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে আরব রাষ্ট্র আর ৫৫.৫ শতাংশ নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে বলে UNSCOP সুপারিশ করে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি এই UNSCOP-ই ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে তাদের রাষ্ট্র কেড়ে নেওয়া ও ফিলিস্তিন সমস্যা সৃষ্টির প্রধান অভিযুক্ত। UNSCOP রিপোর্টের সুপারিশের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে ব্রিটিশ সরকার বিবৃতি দেয়। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে UNSCOP রিপোর্টের সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয় ফিলিস্তিনের কোনও বিভক্তি কিংবা ইহুদি সংখ্যালঘুদের জন্য কোনও বিশেষ অধিকার সৃষ্টি করা হলে আরবরা সম্ভাব্য সকল উপায়ে তা প্রতিহত করবে। আরবরা ঘোষণা করে ম্যান্ডেটের বিধান অনুযায়ী সমগ্র ফিলিস্তিন নিয়ে আরব রাষ্ট্র গঠিত হবে যেখানে সংখ্যালঘু সকল সম্প্রদায়ের মানবাধিকার, স্বাধীনতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও পবিত্র স্থানগুলোয় সকলের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হবে।
আরবদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে ব্রিটিশ সরকার বিবৃতি প্রদান করে বলে আরব ও ইহুদি উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকার জোরালো ভূমিকা রাখবে না, তবে সাধারণ পরিষদ কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকার কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এমতাবস্থায় সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিন সমস্যার সঙ্গে জড়িত আইনগত বিষয়াবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য Ad Hoc Committee on the Palestinian Question গঠন করে। অ্যাডহক কমিটি ১৯৪৭ সালের ১১ নভেম্বর তার প্রতিবেদন সাধারণ পরিষদে জমা দেয়। কমিটি স্পষ্ট করে বলে, ফিলিস্তিনের ওপর আরব ও ইহুদিদের দাবির বৈধতা বিষয়ে UNSCOP রিপোর্টে যে যুক্তি উল্লেখ করা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইন ও সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা সমর্থনযোগ্য নয়। বরং, জাতিপুঞ্জ কর্তৃক ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটেনকে দেওয়া ম্যান্ডেট অবসান হলে ও ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তর হতে বাধা নেই। কেবলমাত্র ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরই ম্যান্ডেটের উদ্দেশ্যের যৌক্তিক পরিণতি লাভ করবে ও জাতিপুঞ্জের সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অ্যাডহক কমিটি আরও বলে, ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ব্যতীত সাধারণ পরিষদের আর কোনও সুপারিশ করার এখতিয়ার নেই। পর্যবেক্ষণে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা জাতিসংঘ সনদের নীতিমালার পরিপন্থী এবং নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। কমিটির পর্যক্ষেণে জোর দিয়ে বলা হয়, ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ সরকার নির্ধারণ করার ও একটি রাষ্ট্র ভেঙে একাধিক রষ্ট্র গঠন করার এখতিয়ার কেবলমাত্র ফিলিস্তিনের জনগণের। অ্যাডহক কমিটি তার সুপারিশে বলে ফিলিস্তিন নিয়ে জাতিসংঘে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে সাধারণ পরিষদের এজেন্ডা থেকে বাদ দেওয়া সমীচীন হবে। এরপরও এ বিষয় নিয়ে কোনও বিরোধ হলে তা আন্তর্জাতিক আদালতের উপদেশমূলক মতামতের জন্য প্রেরণ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, আরব রাষ্ট্রগুলোও বারবার ফিলিস্তিন ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রেরণের দাবি করে আসছিল। সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক আদালতে অভিমতের জন্য না পাঠিয়ে ২৯ নভেম্বর ১৮১ নং সিদ্ধান্তে UNSCOP প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন ভাগ করে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (প্রস্তাবের পক্ষে ৩৩ ভোট, বিপক্ষে ১৩ ভোট আর ১০টি রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থাকে)। ১৮১ নং সিদ্ধান্তে ব্রিটেনসহ সকল সদস্য রাষ্ট্রকে সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়, আর নিরাপত্তা পরিষদকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ৯ ডিসেম্বর সভা আহ্বান করে। সভায় সিরিয়ার প্রতিনিধি Faris El-Khouri বলেন, সাধারণ পরিষদ কোনও বৈশ্বিক সরকার নয়, কোনও রাষ্ট্রের জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে ওই রাষ্ট্রকে ভাগ করার, বিধি-বিধান তৈরি করার, কোনও চুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার এখতিয়ার সাধারণ পরিষদের নেই। তিনি এ যুক্তিও তুলে ধরলেন, সাধারণ পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদকে যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করেছে তা জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের কাজের অন্তর্ভুক্ত নয়। এদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা Arab Higher Committee ১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবরে এক লিখিত আবেদনে জানায়, ফিলিস্তিন বিভাজনের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। জাতিসংঘ সনদের কোথাও সাধারণ পরিষদকে কোনও রাষ্ট্র বিভাজন করে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। ফলে সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত আইন ও ক্ষমতাবহির্ভূত বিধায় বাতিল। Arab Higher Committee ফিলিস্তিন বিষয়ে আইনগত মতামতের জন্য বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে প্রেরণেরও দাবি জানায়। কিন্তু সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক আদালতের মতামত গ্রহণের বিষয়টি কখনও পরিষদের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেনি। বরং জাতিসংঘের ১৮১ নং সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে আরব-ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাস্তব রূপ দিতে U.N. Palestine Commission গঠন করে। কমিশনকে দায়িত্ব হলো, ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটিশ সরকারকে প্রদত্ত ম্যান্ডেট হস্তান্তর করে নবগঠিত দুই রাষ্ট্রের সরকারের কাছে তা হস্তান্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এমতাবস্থায় Arab Higher Committee জাতিসংঘকে জানিয়ে দেয় ফিলিস্তিনি জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করে জবরদস্তিমূলক বিভাজন করে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলে Committee তাকে আগ্রাসন বলে বিবেচনা করবে এবং আত্মরক্ষার্থে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও এ অবৈধ সিদ্ধান্ত প্রতিহত করবে। এ সত্ত্বেও সাধারণ পরিষদ গঠিত U.N. Palestine Commission সাধারণ পরিষদের ১৮১ নং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিন ভাগ করে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ করে সামরিক বাহিনী সরবরাহের জন্য যাতে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অবসান ঘটিয়ে নবগঠিত দুই রাষ্ট্রের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। নিরাপত্তা পরিষদ এমন প্রস্তাব পাওয়ার পর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। সিরিয়ার প্রতিনিধি Faris El-Khouri প্রশ্ন তোলেন কোন রাষ্ট্র ভাগ করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সামরিক শক্তি প্রয়োগ নিরাপত্তা পরিষদের কাজের আওতাভুক্ত কিনা। বিতর্ক শেষে ঐকমত্য হয়, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ কেবল তখনই সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারে যখন আগ্রাসন বা অন্য কোনও কারণে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বা হুমকির মুখে পড়ে। রাষ্ট্র বিভাজনের পরিকল্পনা যা পক্ষগণ প্রত্যাখ্যান করেছে তা নিজেই শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হওয়ায় নিরাপত্তা পরিষদ কখনও এমন কাজে যুক্ত হতে পারে না। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি চীনের প্রতিনিধি মত দেন, নিরাপত্তা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছে বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার জন্য। এটি খুবই দুঃখজনক হবে, রাষ্ট্রভাগের নাম করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে জাতিসংঘ নিজেই যদি যুদ্ধের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৫ মে ১৯৪৮ তারিখে ফিলিস্তিনের ওপর তাদের ম্যান্ডেট অবসানের ঘোষণা দেয়। ব্রিটিশ সরকারের ম্যান্ডেট অবসানের সময়সীমার মধ্যে প্যালেস্টাইন বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না হলে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশংকা করা হয়। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ওয়ারেন অস্টিন প্রস্তাব করে–
এক. ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অবসানের পর প্যালেস্টাইনের বিষয়ে তদারকি করার জন্য একটি ট্রাস্টিশিপ গঠন করা হোক যাতে আরব ও ইহুদিরা আরও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যে পৌঁছার সুযোগ পায়।
দুই. উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করে সমাধানের নতুন উদ্যোগ নেওয়া হোক।
তিন. বিশেষ অধিবেশনের সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রভাগের পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে U.N. Palestine Commission কে নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হোক। অন্যদিকে, কানাডার প্রতিনিধি আরও বিকল্প খোঁজার আহ্বান জানান। এমনকি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকারের নিশ্চয়তাবিধান করে এক রাষ্ট্র সমাধানকেও কানাডা সমর্থন করে বলে কানাডার প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদের সভায় মত দেন। এমন পরিস্থিতিতে ইহুদিদের সংগঠন Jewish Agency for Palestine এর পক্ষ থেকে প্যালেস্টাইনের তদারকির জন্য কোনও ট্রাস্টিশিপ গঠনকে সরসারি নাকচ করে দেওয়া হয় এ মর্মে যে, এটি ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধা। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি আরব ও ইহুদিদের সশস্ত্র গ্রুপের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করেন নিরাপত্তা পরিষদে। নিরাপত্তা পরিষদ এপ্রিল মাসে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর করতে যুদ্ধবিরতি কমিশন গঠনের পাশাপাশি দ্রুত জাতিসংঘের সাধারণ পরষিদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের প্রস্তাব পাস করে। উদ্বেগাকুল এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ১৪ মে ১৯৪৮ সালে ইহুদিরা একতরফাভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তাদের ঘোষণার ভিত্তি হিসেবে সাধারণ পরিষদের ১৮১ নং সিদ্ধান্তকে উল্লেখ করে যেখানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কথা রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুসারে (১৯৩৩ সালের মন্টিভিডিও কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১) একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকটি আবশ্যকীয় উপাদান প্রয়োজন। উপাদানগুলো হলো–(ক) একটি সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী; (খ) একটি সুনির্দিষ্ট সীমানা; (গ) একটি কার্যকর সরকার; এবং (ঘ) সার্বভৌমত্ব। ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়ার সময় একটি জনগোষ্ঠী থাকলেও সুনির্দিষ্ট সীমানা, একটি কার্যকর সরকার ও সার্বভৌমত্ব ছিল না। আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুসারে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা তাই অবৈধ। অন্যদিকে, ইহুদিদের প্রধান যুক্তি হলো ফিলিস্তিন তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি। ইহুদিদের এই যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Johns Hopkins School of Public Health এর গবেষক Dr Eran Elhaik তার জিনোম গবেষণার এক ফলাফলে দেখিয়েছেন যে, ইউরোপীয় ইহুদিরা (বিশ্বের ৯০% ইহুদিই হলো ইউরোপীয় ইহুদি) বংশধারার দিক থেকে ফিলিস্তিনি নয়। অর্থাৎ তাদের পূর্বপুরুষের বসবাস ফিলিস্তিনে ছিল না। ইউরোপীয় ইহুদিদের অধিকাংশের রক্তে বইছে ককেশাসের রক্তধারা। বাকিরা গ্রিক ও রোমান বংশোদ্ভূত। খুব অল্পসংখ্যক ইউরোপীয় ইহুদির রক্তে বইছে প্রাচীন ফিলিস্তিনিদের বংশধারা। অন্য ভাষায় বলা যায়, আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইহুদি অধিবাসীদের খুব সামান্য অংশই ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত বা সেমেটিক জাতির অংশ।
আশেপাশের আরব দেশগুলো ইসরায়েলের এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে হামলা চালালে ইসরায়েল, ফিলিস্তিনের পুরোটাই দখল করে নেয় (শুধু গাজা মিশরের দখলে, এবং পশ্চিম তীর জর্ডানের দখলে ছিল)। আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমাগত তিক্ততা এবং সীমান্তে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে আবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়।
পাঁচদিনের যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, মিশরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এ প্রথমবারের মতো জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার যত আলোচনা পাঁচ যুগ ধরে হয়ে এসেছে, সেগুলোতে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে ১৯৬৭ সালের আগের অবস্থানে ইসরায়েলের পিছু হটার কথা বলা হয়েছে। ইসরায়েল একের পর এক জাতিসংঘের প্রস্তাব উপেক্ষা করে ১৯৬৭ সালে দখল করা ফিলিস্তিনি ও আরব ভূমি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এরপর ১৯৮০ সালে ইসরায়েল আবার পূর্ব জেরুজালেমের দখলিকৃত অংশকে ইসরায়েল সম্প্রসারিত অঞ্চল হিসেবে অধিগ্রহণের কথা ঘোষণা করে। ওই বেআইনি অধিগ্রহণকে নিরাপত্তা পরিষদ (৩০ জুন ১৯৮০, প্রস্তাব ৪৭৬) বাতিল বলে ঘোষণা করে। ইসরায়েলই হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্র, যার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশ্বশক্তিগুলো নির্বিকার। ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ৫৬ শতাংশ ভূমির বাইরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য প্রস্তাবিত এলাকায় নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ শুরু করে। ইতোমধ্যে সাবেক ফিলিস্তিনের ৮০ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। নিপীড়ক ইসরায়েল জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিদের বাসস্থান ও জমি-জমা কেড়ে নিতে সম্প্রতি ‘ব্রিচ অব লয়ালটি’ শিরোনামে একটি কালো আইন পাস করেছে। এই আইনের আওতায় ইসরায়েল যদি মনে করে জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি বাসিন্দার কারও ইসরায়েলের প্রতি পর্যাপ্ত আনুগত্য নেই, তাহলে তাকে তার বাড়িঘর ও জমিজিরেত থেকে উচ্ছেদ করা যাবে। তার যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া যাবে।অন্যদিকে দখলদার ইসরায়েল জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন বসতির ৩০ শতাংশ এলাকা অধিকৃত ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করার ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি অনুযায়ী গাজা উপত্যকা ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের অধীনে রয়েছে যা মূল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মাত্র ২০ শতাংশ। কিন্তু এখন ইসরায়েলের চোখ পড়েছে পশ্চিম তীরের দিকে, যা অসলো চুক্তির লঙ্ঘন। ক্যাম্পডেভিড, অসলো চুক্তিসহ ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকল প্রচেষ্টা সময়ক্ষেপণ ও প্রতারণাপূর্ণ। এরই মাঝে ট্রাম্প ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামক বিতর্কিত পরিকল্পনা উত্থাপন করেছেন। পরিকল্পনায় তেলআবিব থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করে বায়তুল মোকাদ্দাসকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেইসঙ্গে সিরিয়ার গোলাম মালভূমিকেও ইসরায়েলের অংশ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলের দুর্বৃত্তপনা বন্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিলেও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৩২ কোটি মুসলমানের বিপরীতে মাত্র ৭০ লাখ ইহুদির বাস ইসরায়েলে। প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনি মুসলিম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের চোখের সামনে। মুসলমানদের প্রথম ক্কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে বহুবার নামাজ আদায় বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। নামাজরত মুসুল্লিদের ওপর গুলি চালিয়েছে একাধিকবার। ফিলিস্তিনিদের দুঃখগাঁথা যেন শেষ হবার নয়। একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, যারা ফিলিস্তিনিদের কয়েক দশকের ভয়ংকর দুর্দশা থেকে মুক্তি দিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারতেন সেসব মুসলিম শাসকদের অধিকাংশই ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়নকারী, নির্যাতনকারী ইসরায়েল ও তাদের দোসরদের বন্ধু বানিয়েছেন নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে।