ইসলামে স্বাধীনতা

মানুষের সবচে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ধর্ম। ধর্মের ব্যাপারে চাপাচাপি ইসলামে নিষিদ্ধ। তবে ধর্মের দাওয়াত প্রচার প্রোগ্রামকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আর ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি মৌলিক স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা রক্ষায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। তাই অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঈমান বা বিশ্বাস গ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে কোনোরূপ জবরদস্তি ইসলামে বৈধ নয়। আমাদের বিশ্বাসের স্তম্ভ আল কোরআন সেই কথাই আমাদের বলছে এভাবে,

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

অর্থ: ‘দ্বীনের বিষয়ে কোনো জবরদস্তি নেই। হেদায়াতের পথ গোমরাহি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। এর পর যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, সে এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরলো, যা ভেঙ্গে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও সবকিছু জানেন।’ (সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত : ২৫৬)।

অনত্র মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন,

وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ

অর্থ: ‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই ঈমান আনতো। তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?’ (সূরা: ইউনুস, আয়াত : ৯৯)।

ধর্মীয় স্বাধীনতাকে কতটা ব্যাপক করেছে নিচের আয়াত থেকে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি। অন্য ধর্মকে গালি দেয়াকে পাপ বলে সাব্যস্ত করেছে আমাদের গর্বের দৌলত ইসলাম।

وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ مَرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থ : ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে (তাদের বিশ্বাসী কোন মাবুদ মূর্তি প্রতিমা ইত্যাদি) তারা ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না।’ কেননা পরিণামে তারা অজ্ঞাতবশত সীমালংঘন করে আল্লাহতেকও গালমন্দ করবে। (এভাবে দুনিয়ায় তো) আমি এভাবেই প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপকে সুশোভিত করে দিয়েছি। অতঃপর তাদেরকে নিজ প্রতিপালকের কাছেই ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তাদেরকে তারা যা কিছু করতো সে সম্বন্ধে অবহিত করবেন।’ সূরা : আনআম, আয়াত : ১০৮)।

ইসলামি রাষ্ট্রে বা ইসলামি সমাজে অমুসলিমদের ধর্ম পালনে শুধুই স্বাধীনতা দেয়নি দিয়েছে ধর্ম পালনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা। তাদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো প্রতিষ্ঠানগুলো সবগুলোকে নিরাপত্তা দেয়া ইসলামী রাষ্ট্রে বা ইসলামী সমাজের দায়িত্বশীলদের ধর্মীয় কাজ। ইসলাম এখানে কতটা উদার দৃষ্টিভঙ্গী লালন করেছে। আজ দেশে দেশে ইসলামের ওপর ইসলামের প্রতিষ্ঠান ও স্থাপত্যগুলো ওপর হামলা করছে অমুসলিম উগ্র সম্প্রদায়।

নিজের মত ব্যক্ত করার স্বাধীনতা

নিজের মত প্রকাশ করা প্রতিটি মানুষের মানুষ্য স্বভাব বা জন্মগত স্বভাব। ইসলাম পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে এই অধিকারকে রেখে সমন্বিত। ইসলাম বলে সকলকে তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দাও। তবে এই মতপ্রকাশ যেন অন্যকে আঘাত না করে।

ইসলাম সর্ববস্থায় ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যাওয়া দুষ্কর ও দুষ্প্রাপ্য যেখানে অন্যমতকে ভিন্নপথকে অবমাননা করা হয়েছে। একটি ঘটনা বলি, মসজিদে নববিতে একদিন জুমার খুতবায় হজরত ওমর ফারুক রাযি. বলেন, তোমরা বেশি পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ করো না। এ খুতবা একভদ্র নারী শুনে প্রতিবাদ করে বসলো, ‘আল্লাহ তো আমাদের দিয়েছেন আর আপনি কেড়ে নিচ্ছেন? আপনি কি জানেন না’, আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির কর এবং তাদের একজনকে অগাধ অর্থও দিয়ে থাক, তবুও তা হতে কিছুই প্রতিগ্রহণ করো না’। (সূরাতুন নিসা, আয়াত: ২০)

নারীর এ কথা শুনে হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, ‘নারী ঠিক বলেছে আর ওমর ভুল করেছে’। এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য। একজন রাজাকে তার প্রজা এভাবে ঠেকিয়ে দিতে পারে নির্দ্বিধায়। মতপ্রকাশের কতোটুকু স্বাধীনতা ইসলাম তার অনুসারীদের দিয়েছে।

চিন্তা ও চেতনার স্বাধীনতা

একজন সুস্থ ও অসুস্থ মানুষের মাঝে প্রথম পার্থক্য হলো চিন্তা ও চেতনা। যেখানে চিন্তা ও চেতনার স্বাধীনতার খর্ব করা হয় সেখানে মানুষগুলো আর সুস্থ থাকে না। অসুস্থ ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ইসলাম মানুষকে চিন্তা চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতা দিয়ে মানব অস্তিত্বে স্বাধীনতার বীজ বপন করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, মানুষকে চিন্তা করতে দাও। তার চিন্তার স্বাধীন সার্ভিসই তাকে ইসলামের পথে টেনে আনবে।
কোরআন আমাদের সেই কথা বলছে,

أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا

অর্থ : ‘তবে কি তারা কোরআন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছ হতে আসতো, তারা তাতে প্রচুর অমিল অসঙ্গতি পেত।’ (সূরাতুন নিসা : ৮২)।

চিন্তা চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাধীনতা দিতে হবে? এর উত্তর সহজ যদি কেউ চিন্তাকে স্বাধীনতা না দেয়; ওই মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। মেধা অকেজো হয়ে পড়বে। বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ বিজয় লাভ করতে পারবে না। এই কারণে ইসলাম সবাইকে চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে, যাতে সব মানুষ চিন্তায় লিপ্ত হয়। পশুপাখির কোনো চিন্তা নেই, তাই তাদের উদ্ভাবনী শক্তি নেই। আল্লাহ ঘোষণা করেন,

وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ

আল্লাহ বলেন, ‘আমি জাহান্নামের জন্য বহু জীন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তারা দেখে না।’ এরা সবাই চতুষ্পদ জন্তুর মতো। বরং তারচে বেশি ভ্রষ্ট। তারাই সব চিন্তাহীন। (সূরাতুল আরাফ : আয়াত নম্বর ১৭৯)।

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন,

قُلِ انْظُرُوا مَاذَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا تُغْنِي الْآيَاتُ وَالنُّذُرُ عَنْ قَوْمٍ لَا يُؤْمِنُونَ

‘হে নবী! বলুন, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করো। কিন্তু যেসব লোক ঈমান আনার নয় তাদের কাছে আয়াতসমূহ ও নির্দেশনা একেবারেই বেকার। (সূরাতু ইউনুছ : আয়াত নম্বর ১০১)।

শেষকথা স্বাধীনতা থেকে আমরা শিক্ষা নিই যে, আমরা আমাদের নাগরিক জীবনে এমন কোনো কাজের সঙ্গে জড়াবো না; যার দ্বারা দেশ জাতি স্বাধীনতা ও নাগরিক জীবন ক্ষতি বা হুমকির মুখে পড়ে।

SHARE THIS ARTICLE