আসিফ মুকতাদির, যুক্তরাষ্ট্র থেকেঃ বর্ণবাদী আন্দোলনের জন্য নেলসন ম্যান্ডেলা, গরীব, অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করে মাদার তেরেসা, আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত হিসেবে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজন ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার জন্য মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিবর্গ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।
প্রত্যেকেই নিজ নিজ সময়ে সমাজে ন্যায্য প্রতিষ্ঠা ও অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন। আর এতে তাদের পড়তে হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি ও সংগ্রামের মুখে। পরাজয়ে ডরে না বীর বলে একটা প্রবাদ আছে। তাছাড়া যদি পরাজয় ও সমালোচনার ভয়ে অধিকার আদায়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হতেন তাহলে কি আজ দেশ, কালভেদে তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতো?
যুগ যুগ পরেও মানব সভ্যতার ইতিহাসে আমরা আমাদের বীরদের ভুলি নি। আজো আমাদের সমাজে তারা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান কিংবা মার্ভেল সিরিজ মুভির কোন স্পেশাল কারেক্টার নয় শৈশব থেকে আমরা অনেকেই এসব বীরদের বীরত্বগাঁথা পড়ে ও শোনে অজান্তেই তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন নিজেদের মধ্যে লালন করি।
সমাজের নানা অসংগতি ও প্রতিকূলতা দেখে সমাজ পরিবর্তনের আশায় কিংবা সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার নেশা আমাদের অনেকের মাঝেই পেয়ে বসে। তেমনই একজন ডা: জিন্নুরাইন জায়গিরদার। পেশায় একজন চিকিৎসক। চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে জনগণের সেবা করাই যার কাজ। কিন্তু সবাই কি আর শুধুমাত্র নিজ নিজ পেশায় নিজের জীবন পাখির মতো খাচায় বন্ধ করে রাখতে পারে? চিকিৎসক জিন্নুরাইনও পারেন নি। শৈশব থেকেই নিজেকে জড়িত করেছেন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে।সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার ছাপ রেখেছেন, পরিচয় দিয়েছেন সেই শৈশব থেকেই। চিকিৎসা সেবার বাইরেও সেই শৈশব থেকেই একজন নেতা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন।
শুধু চিকিৎসাবিদ্যা আর পড়াশোনার চার দেয়ালের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ব রাখেন নি জিন্নুরাইন। নজরুলের “বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র” এ পঙতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেন তিনি। লায়ন্স ক্লাবের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন তিনি। তাছাড়া জড়িত ছিলেন স্কাউট, রোভার স্কাউট, সিলেট সেন্ট্রাল লিও ক্লাবের সাথে। এসব কাজের সাথে জড়িত থাকার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও স্বীকৃতি মিলেছে। ১৯৮১ সালে লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রদত্ত বিশ্বের প্রথম ১০ টি লায়ন্স ক্লাবে জায়গা করে নেয় তাঁর ক্লাব এবং তিনি অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হোন।
কথায় আছে “শিকারি বিড়াল গোঁফে চেনা জানায়”। শৈশবের নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি দিয়ে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের পাশাপাশি নিজেকে সাংগঠনিক দিক দিয়েও দক্ষ করে তুলেছেন। বর্তমানে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশি এসোসিয়েশন (আয়েবা) এর সহসভাপতি হিসেবে ইউরোপে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সেবায় নিয়োজিত আছেন। অল বাংলাদেশি এসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড(আবাই) এর প্রথম নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘ এগারো বছর পর আবারো আবাই এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে তিনি একজন সভাপতি পদপ্রার্থী। নামের আগে কোন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে পরিচিত হলে হয়ত তা সেই ব্যক্তিকে অলংকৃত করে।
কিন্তু জিন্নুরাইনকে কি আর নতুন করে অলংকরণের কোন দরকার আছে? পেশাগত জীবনে নিজের কর্মদক্ষতায় নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়। ১৯৮৩ সালে মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়ার পর থেকে তাঁর সাফল্যযাত্রা চলছেই। বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করেছেন, মাঝখানে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের লেকচারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে ১৯৮৮-১৯৯৮ পর্যন্ত পিজি হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।জিন্নুরাইনের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে এনেস্থেসিওলজিস্ট এর একজন দিকপাল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা৷ এনেস্থেসিয়ার উপর বাংলাদেশে প্রথম চিকিৎসক হিসেবে তিনি ডক্টর অব এনেস্থেসিয়া, এফসিপিএস ও এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর আগে কেউ এ বিভাগের উপর একই সাথে তিনটি ডিগ্রি অর্জন করেন নি।
দীর্ঘকাল দেশে চাকরি করার পর ভিনদেশে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ১৯৯৭ সালে সৌদিআরবে চলে আসেন তিনি। সেখানে সৌদি সরকারের অধীনে আল রাস জেনারেল হাসপাতালে কনসালটেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে সৌদি আরব থেকে পাড়ি জমান আয়ারল্যান্ডে। আয়ারল্যান্ডে শুরুর দিকটা ছিল সংগ্রামের, চ্যালেঞ্জের। কিন্তু তিনি কখনো চ্যালেঞ্জের কাছে পরাজিত হন নি। প্রথমদিকে আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে ছয় মাস কিংবা এক বছর চাকরি করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কলেজ এন্ড এনেস্থেসিওলজিস্ট আয়ারল্যান্ড থেকে এফ সি এ, আর সি এস আই ডিগ্রি অর্জন করেছেন৷
হেপাটোবিলিয়ারি এবং লিভার ট্রান্সপ্যান্ট এর উপর ফেলোশিপ করেছেন। তখনো বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্যান্টের চিকিৎসা শুরু হয় নি৷ তাই ইচ্ছা ছিল দেশে ফিরে গিয়ে তিনি এ চিকিৎসা শুরু করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ফিরে যাওয়া হয় নি। ২০০৯ সাল থেকে আয়ারল্যান্ডে কনসালটেন্ট এর দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়ের মধ্যে আয়ারল্যান্ডে নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার স্বীকৃতি মিলেছে সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতাল থেকে ২০০৯ সালে শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণরত ডাক্তারের খেতাব পাওয়ার মাধ্যমে।নিজের পেশাগত কিংবা সামাজিক জীবনে আর নতুন করে কোন পালক যুক্ত করার হয়ত প্রয়োজন নেই তাঁর, কিন্তু জিন্নুরাইনরা এভাবেই ফিরে আসেন বিবেকের তাড়নায়, সমাজ পরিবর্তনের প্রত্যাশায়। দিনশেষে তাঁদের এ লড়াই, আত্মত্যাগই তাদের অমরত্ব দেয়।