আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ বাংলাদেশে আগামী ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে অনুষ্ঠিতব্য অমর একুশে বইমেলা কোভিড সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে দুই সপ্তাহের জন্য পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গতকাল রবিবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২০২২ সালের এই বইমেলা পিছিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলে জানা গেছে। কোভিড মহামারির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হতে পারে এবারের বইমেলা।। যদি দুই সপ্তাহ পর অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হয়, তাহলেও এবারের মেলায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে জানা গেছে।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, সবার আগে ভাবতে হবে মানুষের জীবনের কথা। গত কয়েকদিন ধরে দেশে করোনা সংক্রমণের হার উর্ধমুখী রয়েছে। সেই বাস্তবতায় প্রাথমিকভাবে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ পর্যন্ত বইমেলার আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। তবে বইমেলা আয়োজনের প্রস্তুতি চলমান থাকবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বইমেলা আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
বইমেলা স্থগিতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে রবিবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে বইমেলা আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে কে এম খালিদ বলেন, মেলা শুরু হওয়ার পর কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নজরদারি করা হবে। দর্শনার্থী, প্রকাশক, বিক্রয়কর্মীসহ মেলা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন নিতে হবে। যারা মেলায় আসবেন তাদের সবার টিকার সনদ সঙ্গে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, বইমেলায় একসঙ্গে অধিক জনসমাগম রোধে অনলাইনে বুকিং দিয়ে মেলায় প্রবেশ করানো যায় কিনা সে বিষয়টি নিয়েও আমরা ভাবছি।
করোনা সংক্রমণের উর্ধমুখী পরিস্থিতিতে দুই সপ্তাহের জন্য বইমেলা স্থগিতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রকাশকরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, গত কয়েকদিন যেভাবে ক্রমাগত সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে গৃহীত এ সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে বইমেলার আয়োজন করতে হলে ফেব্রুয়ারি মাসেই শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে শুরু করা যেতে পারে। গত বছরের মতো মার্চ মাসে বই মেলা হলে সেটা হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভাল। তাই এবার মেলা যদি ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় তাহলে একটি সফল মেলার আশা করা যায়।
প্রকাশনা সংস্থা অন্য প্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলেন, দুই সপ্তাহের জন্য মেলা স্থগিত করা হলেও ফেব্রুয়ারি মাসেই মেলার আয়োজন করা উচিত। সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পর্যন্ত মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
কোভিড মহামারির কারণে গত বছর ২০২১ সালের বইমেলা একমাস পিছিয়ে ১৮ই মার্চ থেকে শুরু করা হয়েছিলো আর ১২ই এপ্রিল বইমেলা সমাপ্ত হয়েছিলো। গতবারের বইমেলা নিয়ে জনমনে প্রচুর হতাশা রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে সংশয় ছিল, সকল প্রতিষ্ঠান বইমেলা সকল প্রস্তুতি গ্রহণের পর স্থগিত করা হয়েছিলো।মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হলে পাঠক সমাগম ছিল হতাশা ব্যাঞ্জক।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ, কালের কণ্ঠ, ঢাকা ট্রিবিউন, বিডি২৪.কম
একুশে বই মেলার ইতিহাসঃ
১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বিক্রি শুরু করেন চিত্তরঞ্জন সাহা। তার আনা ৩২টি বই ছিল তার নিজ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী সাহিত্যিকদের লেখা বই।
১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি বই মেলা উপলক্ষে ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। বাংলা একাডেমির পাশাপাশি মুক্তধারা প্রকাশনী, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং আরও কয়েকজন বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের প্রকাশিত বই বিক্রি শুরু করে।
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তাদের নিজের প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মদ হবীবুল্লাহ। তখন একাডেমি প্রাঙ্গণ সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাই ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমি প্রাঙ্গনে নিজেদের পছন্দ মতো জায়গায় যে যার স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।
১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য কিছুটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলা একাডেমি। সেই নির্দিষ্ট স্থানে প্রকাশকেরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি দেয়নি বাংলা একাডেমি। এমনকি কোনো নামও দেয়নি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি এই সময়ে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানসূচিতেও এর কোন উল্লেখ নেই।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। তিনি বইমেলার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন। তার উদ্যোগে বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। শুরু হয় বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের।
১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উপর লক্ষ রেখে ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি এবং বইমেলার নামকরণ করে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’।
১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই নিয়মেই ‘একুশে গ্রন্থমেলা’ পালিত হয়।
১৯৮১ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলায় পরিবর্তন আনে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন ধার্য করে বাংলা একাডেমি। কিন্তু প্রকাশকরা বাংলা একাডেমির এ সিন্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তারা বাংলা একাডেমির এ সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের দাবি তুলে ধরে।
প্রকাশকদের এ দাবির মুখে ১৯৮২ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়ে পূণরায় মেলার মেয়াদ করা হয় ২১ দিন করে এবং মেলার উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলা একাডেমি সে মেলার আয়োজন করে। ১৯৮২ সালের ঐ মেলায় সহযোগি হিসেবে ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।
১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন কাজী মনজুরে মওলা। তিনি বিশেষ কারণে সহযোগি প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাংলা একাডেমি বাদ দিয়ে দেয়। কি কারণে বাদ দিয়ে দেয় সে তথ্য বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেনি। বরং বাংলা একাডেমি সে সময় প্রচার করে ‘একুশে বইমেলা’কে নতুন আঙ্গিকে প্রসার করার কারণেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ধুমধাম করে বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন শেষ করে কিন্তু স্বৈরশাসক এরশাদ-এর সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আবার ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন করে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে শহিদদের উপর আরও গভীর শ্রদ্ধা দেখাতে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামকরণ ১৯৮৩ সালে করলেও ১৯৮৪ সালে তার কার্যকর করা হয়। প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্টলের সংখ্যা বাড়ানো হয়, সেই সাথে মেলার পরিসরও বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র বিভিন্ন ফিচার সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহার ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র সে মেলাটি কালানুক্রমে বাঙালির প্রাণের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলাতে পরিণত হতে শুরু করে। পাঠকের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে চোখে পড়ার মতো হতে তাকে। এক সময় পাঠক এবং প্রকাশকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালেই বইমেলার সময়কাল বাড়িয়ে পুরো মাস ব্যাপি করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে বাংলা একাডেমি।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপেডিয়া