আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গোলাম রব্বানী টিপুকে খুনের পরিকল্পনা ‘দুই মাস আগেই’ শুরু হয়েছিল বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
আলোচিত এ মামলায় গ্রেপ্তার তিনজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে পুলিশ বলছে, ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর ‘ক্ষমতার দাপট হারানো’ টিপুকে খুনের পরিকল্পনা করেন এক যুগ আগে খুন হওয়া পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি খুলনার নেতা হাজী শহীদুলের ভাতিজা শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পু।
গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে খুন হন খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু। সমুদ্র সৈকতের সি-গাল পয়েন্টে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পরদিন রব্বানীর ভগ্নিপতি ইউনুস আলী অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ মঙ্গলবার মৌলভীবাজার থেকে পাপ্পু (২৭), গোলাম রসুল ও ঋতু নামে এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করে।
আর র্যাব খুলনার সাবেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখার চালু ও টিপুর কক্সবাজারের বন্ধু মেজবাহ উদ্দিন ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ বলছে, এই অস্ত্র দিয়েই হত্যা করা হয় টিপুকে।
মৌলভীবাজার থেকে গ্রেপ্তার তিন আসামির মধ্যে পাপ্পু ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন জানিয়ে কক্সবাজার সদর থানার ওসি ইলিয়াস খান গণমাধ্যমকে বলেন, “জবানবন্দিতে তিনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। এ খুনের পেছনে আরো অনেকের নাম আছে, যাদের নাম বলেছেন পাপ্পু ও ঋতু।”
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘খুনের বদলা নিতেই’ গোলাম রব্বানী টিপুকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে ঋতুকে ‘ফাঁদ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
“চরমপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি খুলনার নেতা ছিলেন হাজী শহীদুল। ২০১৩ সালে তাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কাউন্সিলর টিপু। শহীদুল হত্যা মামলার চার আসামির মধ্যে একজনকে একইভাবে (টিপুর মত) ২০২২ সালে হত্যা করা হয়।”
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, পাপ্পু বুধবার বিকালে কক্সবাজার জেলার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, তার চাচা হাজী শহীদ এবং সাবেক কাউন্সিলর টিপু এক সময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কামরুলের অনুসারী ছিলেন। তবে তারা পরষ্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।
এ কারণে ২০১৭ সালে টিপু তার চাচা শহীদকে খুন করেছেন বলে পাপ্পুর অভিযোগ। তিনি বলেছেন, চাচার পক্ষে কথা বলায় তিনি টিপুর বিরাগভাজন হয় এবং তাকে জড়ানো হয় বিভিন্ন মামলায়।
২০২০ সালে টিপুর ব্যবসায়িক পার্টনার ইকবাল সরোয়ার হত্যা মামলায় এবং পরে আরেকটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পাপ্পু দুই দফায় কারাভোগ সর্বশেষ ২০২৪ সালে ১৮ এপ্রিল জামিনে ছাড়া পান।
পাপ্পুর জবানবন্দির বরাতে পুলিশ বলছে, স্থানীয় পুলিশের সাথে টিপুর সখ্য ছিল। তার সরকার ক্ষমতা থাকায় আগে কিছু করতে পারেননি পাপ্পু। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর টিপু পালিয়ে যাওয়ায় তিনি ‘প্রতিশোধ নেওয়ার কথা’ চিন্তা করেন। দুই মাস আগে আরেক বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন। সেই বন্ধুও হত্যাকাণ্ডের দিন উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারে।
অস্ত্র সংগ্রহের পর বিষয়টি নিয়ে গোলাম রসুলসহ আরও তিন জনের সঙ্গে পাপ্পুর আলাপ হয়, যারা টিপুর ‘অত্যাচারে অতিষ্ট’ ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের দিন তারাসহ মোট সাতজন কক্সবাজার ছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য।
গোলাম রব্বানী টিপু
‘ঋতুর ফাঁদ’
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কাউন্সিলর টিপুর ‘চরিত্র’ সম্পর্কে ধারণা থাকায় মাসখানেক আগে ঋতুকে দিয়ে টিপুকে ‘পটানোর’ পরিকল্পনা করেন পাপ্পুর এক বন্ধু, সেরকমটাই জবানবন্দিতে বলেছেন পাপ্পু।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ঋতু এক মাস আগে টিপুকে ফেইসবুকে বন্ধু হওয়ার বার্তা পাঠান। পরে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।
টিপু গত ২৯ ডিসেম্বর ঋতুকে ৭ অথবা ৮ জানুয়ারি কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তাব দেন। পাপ্পু সেটি জেনে কক্সবাজারে গিয়ে টিপুকে খুন করার পরিকল্পনা করেন বলে পুলিশের ভাষ্য।
হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি পাপ্পু কীভাবে জোগাড় করেছে সে বর্ণনাও দিয়েছেন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে।
তিনি দাবি করেছেন, টিপুকে খুনের পরিকল্পনাটি তিনি খুলনার অপর এক ব্যক্তিকে জানান। এসময় ওই ব্যক্তি তার কাছে অস্ত্র আছে কিনা, তা জানতে চান এবং ওই ব্যক্তিই তাকে কক্সবাজারে থাকার হোটেল ঠিক করে দেন এবং খরচের জন্য ১০ হাজার টাকা দেন।
জবানবন্দির বরাতে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, টিপুকে হত্যার পরিকল্পনার পর প্রয়াত হাজী শহীদুলের দেহরক্ষীর কাছ থেকে অস্ত্র চেয়েছিলেন পাপ্পু। তখন তিনি পরিচিত এক ব্যক্তিকে অস্ত্র দেওয়ার কথা বলে দেন। ৩ জানুয়ারি ওই ব্যক্তি পাঁচ রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল দেন পাপ্পুকে।
পাপ্পু এবং আরও তিন জন ৯ জানুয়ারি এবং গোলাম রসুল ৭ জানুয়ারি কক্সবাজারে যান। তারা সেখানে গিয়ে ‘কক্স কুইন রিসোর্টে’ ওঠেন। একই দিন তাদের আগে আরও দুই জন কক্সবাজার যান।
‘যেভাবে খুন’
পুলিশ বলছে, পাপ্পু যার সাথে মিলে টিপুকে খুনের পরিকল্পনা করেছেন, সেই বন্ধুর সঙ্গে ঋতুর ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ হত এবং টিপুর অবস্থান সম্পর্কে তিনি তথ্য জানাতেন।
গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে খুন হন খুলনার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা টিপু।
ঋতুকে নিয়ে টিপু ৯ জানুয়ারি ভোরে কক্সবাজারে যান, ওঠেন ‘গোল্ডেন হিল’ হোটেলে। সেদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে তারা সৈকতে বেড়াতে যান।
পাপ্পুর জবানবন্দির বরাতে পুলিশ বলছে, গোলাম রসুল ও অপর দুই জন টিপু ও ঋতুকে অনুসরণ করার জন্য হোটেলের সামনে গিয়েছিলেন। গোলাম রসুল সাড়ে ৬টার দিকে টিপু ও ঋতুর সৈকতে যাবার তথ্য জানালে পাপ্পু তার সঙ্গে আরও তিন জনকে নিয়ে সৈকতে যান। গোলাম রসুলরা তখন টিপুকে দেখিয়ে দিয়ে দূরে সরে যান।
রাত ৮টার দিকে টিপু হোটেলে ফেরার সময় মোবাইলে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন। আর টিপুর চার অথবা পাঁচ হাত সামনে হাঁটছিলেন ঋতু। সীগাল হোটেলের কাছে পৌঁছার পর অন্ধকারে টিপুর মাথার পেছনে গুলি করেন পাপ্পু। টিপু মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর গোলাম রসুলরা একটি রিকশায় চড়ে হোটেলে চলে যান।
হোটেলে গিয়ে বাথরুমের উপরে অস্ত্রটি লুকিয়ে রেখে হোটেল রুমের চাবি নিয়ে রাত ৯টার দিকে বাস টার্মিনালে যান তারা। সেখানে ঋতু ও তাকে যিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন সে ব্যক্তিও ছিল।
৯ জানুয়ারি রাতেই পাপ্পু, ঋতু, গোলাম রসুল এবং অপর ব্যক্তি ঢাকায় চলে যান। পরদিন সকালে তারা কাকরাইলের একটি হোটেলে ওঠেন এবং বিকালে তিন জন মৌলভীবাজারে এবং অন্যজন খুলনায় চলে যান বলে পুলিশের ভাষ্য।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি ইলিয়াস খান জানান, পাপ্পু ও গোলাম রসুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় তাদের রিমান্ড আবেদন করা হবে।