করোনা ভ্যাকসিনের দৌড়ে – কে কোথায় আছে?

এ, কে, আজাদ- আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ সারা বিশ্বজুড়ে নানা দেশ ও সংস্থা নানা ভাবে করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে৷ করোনাভাইরাসের বিস্তার মোকাবিলায় ভ্যাকসিন তৈরির তোড়জোড় চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চলছে। তবে ভ্যাকসিন কে সবার আগে ছাড়বে, তা নিয়ে ব্রিটেন, আমেরিকা ও চীনের মধ্যে মর্যাদার লড়াই চলছে বলে মনে হচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন তৈরি করে রেখেছেন, যা নিরাপদ প্রমাণিত হলেই ছাড়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রকি মাউন্টেন ল্যাবরাটরিতে এইসব বানরদের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। তাদের ওপর বেশি মাত্রায় ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। ট্রায়ালের আগেই জেনার ইন্সটিটিউটের গবেষণাটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. সারাহ গিলবার্ট জানিয়েছিলেন, একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে যাচ্ছেন তারা। সেপ্টেম্বরের ভেতর ভ্যাকসিন প্রস্তুতের বিষয়ে তারা ৮০ শতাংশ আশাবাদী। প্রতিষ্ঠানটিরভ্যাকসিন তৈরির প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় ১০টি রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে অতীতে। যার সবগুলোই সফল হয়। ফলে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটির দিকে এখন ত্যাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব।
এর পরপরই চীনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের হাতেও শরতের আগেই ভ্যাকসিন থাকবে। চীন-মার্কিন ভ্যাকসিন-লড়াইয়ের মধ্যে সুখবর দিচ্ছেন লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, তাঁদের আশা, কম খরচে আগামী বছরের শুরুতেই বিশ্বের হাতে ভ্যাকসিন তুলে দিতে পারবেন তাঁরা।

দাতব্য সংস্থা কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের (সিইপিআই) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত ২২৪টি ভ্যাকসিন উন্নয়নে কাজ চলছে। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকাতেই চলছে ৪৯ শতাংশ প্রকল্প। তবে মানব শরীরের দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় ৫টি ভ্যাকসিন নিয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন।

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞানীরা আত্মপরিবর্ধনকারী আরএনএ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন তৈরি করছেন। তাঁরা ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য বিশেষ কোম্পানি তৈরি করছেন, যাতে তাঁদের ভ্যাকসিন সফল হলে গরিবদের কাছে সহজে তা পৌঁছে দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্র তাঁরা বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করছেন। এর বাইরে নিজস্ব সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ তৈরি করে তাঁরা ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে চাইছেন।
ইম্পেরিয়াল কলেজ ও হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মর্নিংসাইড ভেঞ্চার্সের উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকুইটি গ্লোবাল হেলথ নামের এ উদ্যোগের পরিচালক সিমন হেপওর্থ বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা পয়সা কামানোর চেয়ে সমস্যা সমাধানের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’

ইম্পেরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীদের তৈরি আরএনএ ভ্যাকসিন মূলত পেশিকোষে জিনগত নির্দেশ সরবরাহ করে, যাতে কোষ স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে পারে। এ প্রোটিনের উপস্থিতি রোগ প্রতিরোধী সক্ষমতাকে প্ররোচিত করে, যাতে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা তৈরি হয়। ভ্যাকসিনটি প্রথম ধাপের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় যাচ্ছে। ১৫ জুন থেকে ৩০০ মানুষকে নিয়ে দুটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হবে। প্রথম ধাপের পরীক্ষা সফল হলে ছয় হাজার মানুষকে নিয়ে আগামী অক্টোবরে দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষার পরিকল্পনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা আশা করছেন, আগামী বছরের শুরুতেই যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভ্যাকসিন দিতে পারবেন তাঁরা।
এদিকে চীনের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন পরীক্ষায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। দেশটির একজন বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, কয়েক মাসের মধ্যেই চীনে ‘জরুরি ব্যবহারের’ জন্য ভ্যাকসিন ছাড়া হতে পারে।
ডা. ঝং নানশান বলেন, এই শরতের প্রথম দিকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন পাওয়া যেতে পারে। তবে তিনি ভ্যাকসিন কোম্পানির নাম প্রকাশ করেননি। তিনি বলেছেন, এ বছরের মধ্যেই জরুরি ব্যবহারের জন্য ভ্যাকসিন ছাড়া হবে। খুব জরুরি প্রয়োজন হলে শরৎ বা শীতের মধ্যেই তা চলে আসতে পারে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীনের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত নানশান বলেন, হার্ড ইমিউনিটি নয়, ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচি এ মহামারি ঠেকাতে পারে। গত রোববার প্রকাশিত ‘ফাইটিং কোভিড-১৯: চায়না ইন অ্যাকশন’ শীর্ষক সরকারি এক শ্বেতপত্রে বলা হয়, চীনা গবেষকেদের তৈরি কমপক্ষে পাঁচটি ভ্যাকসিন মানবশরীরে পরীক্ষা চলছে। পাঁচটি ভ্যাকসিন পাঁচ ধরনের পথে এগোচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাকসিন,
রিকমবিন্যান্ট প্রোটিন ভ্যাকসিন, অ্যাটেনিউয়েটেড ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ভ্যাকসিন, অ্যাডেনোভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন ও নিউক্লিক অ্যাসিড ভ্যাকসিন।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেদের তৈরি পরীক্ষামূলক ‘এজেডডি১২২’ ভ্যাকসিনটির ব্যাপক উৎপাদন শুরু করেছে ব্রিটিশ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন উৎপাদনকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বী গিলিয়েড সায়েন্সের কাছে একসঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গিলিয়েড কোভিড-১৯ চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনে কাজ করছে। তাদের তৈরি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডিসিভিরই হলো প্রথম ওষুধ, যা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় রোগীদের উন্নতি দেখিয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও গিলিয়েডের মধ্যে চুক্তির বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর হতে পারে। দুটি কোম্পানি এক হলে তাদের বাজার মূলধন ২৩২ বিলিয়নে দাঁড়াবে।

অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রধান নির্বাহী প্যাকসেল সারিওট বিবিসি রেডিওকে বলেছেন, ‘আমরা এখনো পথেই আছি। আমরা এখন ভ্যাকসিন উৎপাদন করছি। ফলাফল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের এখনকার অনুমান হচ্ছে, এবারের গ্রীষ্মের আগেই তথ্য হাতে চলে আসবে। আগস্ট মাস নাগাদ বা সেপ্টেম্বর নাগাদ কার্যকর ভ্যাকসিন আছে কি নেই, তার ফয়সালা হয়ে যাবে।
ইতালির গবেষকেরা বলছেন, করোনার বিরুদ্ধে এটাই বিশ্বের প্রথম কার্যকর ভ্যাকসিন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান ও গবেষণামূলক সাইট সায়েন্সটাইমস ডটকমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি মোকাবিলায় কার্যকর ভ্যাকসিনের খোঁজে ছুটছেন গবেষকেরা। ইতালির গবেষকদের দাবি, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাকসিন তাঁরা তৈরি করে ফেলেছেন। তাঁদের দাবি অনুযায়ী, এমন ভ্যাকসিন তাঁরা আবিষ্কার করেছেন, যা মানুষের কোষে ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁরা অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ রক্ত থেকে সিরামকে আলাদা করে এ ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন। গ্রীষ্মে মানবদেহে এ ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।
এদিকে, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড-এ বৈশ্বিক জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিষয়ক সংগঠন কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই) সমর্থিত বিজ্ঞানীরাও টিকা তৈরির কাজ করছে। বিজ্ঞানীরা জানায়, তারা ‘মলিউকুলার ক্ল্যামপ’ পদ্ধতি অবলম্বন করছে। এ পদ্ধতিতে বিষাক্ত প্রোটিনগুলোয় একটি জিন যোগ করে সেগুলোকে স্থিতিশীল করা হয়। ওই প্রোটিনগুলো শরীরে প্রবেশ করিয়ে শরীরকে বোকা বানানো হয় যে, ওটা আসলে একটি ভাইরাস। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তখন সেটার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এর আগে ইবোলা ও অপর এক করোনা ভাইরাস মিডল ইস্ট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম (মারস)-এর ক্ষেত্রে এটি বেশ কার্যকরী ফলাফল দেখিয়েছে। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নোভাভাক্স ইতিমধ্যে মারস-এর বিরুদ্ধে একটি টিকা তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটি নতুন করোনা ভাইরাস নিয়েও কাজ করবে বলে জানিয়েছে।


তবে নতুন এই ভ্যাকসিনে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের খবরটি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এখনো ভাইরাস সংক্রমণের যে গতি তাতে এ মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ বলতে পারছে না৷
যথাযথ টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হলে এই ভাইরাস ফিরে ফিরে আসবে বলেও আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের৷ ফলে সবার মুখেই এখন এক প্রশ্ন, কবে আসবে টিকা?
সুত্রঃ বাংলা টিউবন, সময় টিভি, প্রথম আলো, বিবিসি বাংলা, আল জাজিরা, যুগান্তর ও আইরিশ টাইম

SHARE THIS ARTICLE