
আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন হাজারী মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেছেন তিনি । তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
হাসপাতালটির গণসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের এ খোদা আইরিশ বাংলাপোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ৭৮ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ কিডনি হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

জয়নাল হাজারীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ খান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

এক শোকবার্তায় প্রয়াত জয়নাল আবেদীন হাজারীর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।

ফেনী-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জয়নাল হাজারীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। নিজের ফেসবুক পেইজে শোক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন হাজারী ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা করি, মহান রাব্বুল আলামীন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন, আমিন।’
নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেছেন, মঙ্গলবার দুপুরে ফেনী সরকারি পাইলট হাই স্কুল মাঠে জয়নাল হাজারীর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
শোক জানিয়ে নিজাম বলেন, “আমি মর্মাহত। তিনি দলের প্রবীণ নেতা। তিনি আমার পরিবারের স্বজন।”
জয়নাল হাজারী ১৯৪৫ সালের ২৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। সাবেক সংসদ সদস্য ও আলোচিত এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম তিনি ফেনী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সময় থেকেই ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব ছিল তার হাতে। এরপর ১৯৯১ সালে দুটি আসন থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন ফেনী-২ আসন থেকে। দলে নিজের একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখতে ১৯৯৩ সালে গঠন করেন স্টিয়ারিং কমিটি। ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে বছর স্টিয়ারিং কমিটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ক্লাস কমিটি’।
গত এক যুগে ফেনী ছেড়ে ঢাকায় থেকে হাজারিকা প্রতিদিন নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করে চলছিলেন তিনি।
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৬ অগাস্ট রাতে যৌথবাহিনীর (বিডিআর-পুলিশ) তল্লাশির সময় পালিয়ে ভারতে চলে যান হাজারী।
দীর্ঘ আট বছর দেশের বাইরে থাকার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরলে দেশে ফেরেন তিনি।
অর্থ পাচারের একটি মামলায় জামিন চাইতে গেলে ওই বছর ১৫ এপ্রিল আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
পলাতক অবস্থায় হাজারীর বিরুদ্ধে মোট ২৭টি মামলা হয়, যার মধ্যে পাঁচটিতে সাজার রায় হলেও উচ্চ আদালত তাকে সবগুলোতেই খালাস দেয়।
বহু ঘটনায় বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনীর তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও সেগুলো বাতিল হয়ে যায়।
২০০১ সালের ১৬ আগস্ট রাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জয়নাল হাজারীর বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। তিনি তখন পালিয়ে ভারতে চলে যান। ২০০৪ সালে হাজারীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তিনি ভারত থেকে দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পদ পান তিনি।
একসময় দোর্দণ্ডপ্রতাপের সঙ্গে কাঁপিয়েছেন ফেনীর রাজনৈতিক অঙ্গন।‘এক জেলা, এক নেতা’ মূলমন্ত্রের
প্রয়োগ করতে গিয়ে হয়ে উঠেছিলেন জেলাটির একাধিপতি। আবার ক্ষমতার চূড়া থেকে পতনের পর রাজনীতির প্রকাশ্য ময়দান থেকে হারিয়ে যেতেও সময় নেননি।
জীবনের শেষ দিনগুলোয় মূলত নিজ মালিকানাধীন ‘হাজারিকা প্রতিদিন’ পত্রিকার প্রকাশনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন জয়নাল হাজারী। নিয়মিত ফেসবুক লাইভেও আসতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রোগব্যাধিতে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। চিকিৎসার খরচ মেটাতে ছুটতে হতো এখানে-সেখানে। সর্বশেষ করোনার আগে ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৪০ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান পেয়েছিলেন তিনি।
একসময় নিয়মিত সংবাদপত্রের শিরোনাম হতেন জয়নাল হাজারী। সাংবাদিক পেটানো, হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ নানা ইস্যুতেই তার নামে খবর প্রকাশ হতো নিয়মিতভাবে। পরিচিতি পেয়েছিলেন ফেনীর একচ্ছত্র গডফাদার হিসেবে। ২০০১ সাল পর্যন্ত চলে তার এ রাজত্ব। এরপর তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে দেশ ছাড়েন জয়নাল হাজারী। হারিয়ে ফেলেন ফেনীর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও। সেই থেকে নিজ জেলা ফেনী তার কাছে হয়ে উঠেছিল দূরের জনপদ। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটিতে ঠাঁই পেলেও রাজনীতিতে খুব একটা সরব হয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

ফেনীতে থাকাকালে তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল জেলার মাস্টারপাড়ার ভবন শৈল কুঠির। তবে জয়নাল হাজারী অন্তরালে চলে যাওয়ার পর শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল বাড়িটিও। জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছিল সীমানা প্রাচীর। এক পাশে গড়ে উঠেছিল ঝোপঝাড়। বাড়ির ভেতরে জমেছিল ধুলোবালি। আনাগোনা ছিল না লোকজনেরও। অথচ এ বাড়িতেই একসময় স্টিয়ারিং কমিটির নিয়মিত বৈঠক বসত।
এ কমিটির হাতেই নিয়ন্ত্রণ হতো পুরো ফেনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন জয়নাল হাজারী। নিজের দোর্দণ্ডপ্রতাপের সময়টায় এ বাড়িতেই নিয়মিত বৈঠক করতেন তিনি। এ বাড়ি ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিশাল কর্মযজ্ঞ। দলে দলে মানুষ হাজারীকে কুর্ণিশ করত। তাদের মধ্যে ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। গত বছর বাড়িটির কিছু মাত্রায় সংস্কার করা হলেও ফিরে আসেনি তার রমরমা ভাব। বাড়িটির অবস্থাকে অনেকটা জয়নাল হাজারীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেরই রূপক প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখেছেন ফেনীর স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট বাড়িটিতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। তার আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ফেনীর সবকিছু। জেলাটিতে সবকিছু হতো তার ইশারায়ই।
বর্ণাঢ্য রাজনীতির অধিকারী জয়নাল হাজারী রাজনীতি করেছেন ছাত্রজীবন থেকেই। ছাত্রাবস্থায় ফেনী কলেজে তত্কালীন ছাত্র মজলিশের (বর্তমান ছাত্র সংসদ) জিএস ছিলেন তিনি। এরপর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যপদেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে ফেনীর রাজনীতিতে তার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা শুরু মূলত আশির দশকে।
জেলার ৪৩টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিল প্রায় ১৫ হাজার। এ কমিটি একসময় ফেনীর মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠে। চার খলিফার মাধ্যমে এসব কমিটি পরিচালনা করতেন হাজারী। সেই চার খলিফা হলেন ফেনী জেলা ছাত্রলীগের তত্কালীন সভাপতি আজহারুল হক আরজু, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সাজু, সহসভাপতি শাখাওয়াত হোসেন ও তত্কালীন পৌর যুবলীগ সভাপতি একরামুল হক একরাম। তাদের মধ্যে একরামুল হককে ২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরের একাডেমি এলাকায় প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয়। আজহারুল হক আরজু ও শাখাওয়াত এক পর্যায়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
২০০১ সালের ১৭ আগস্ট তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গভীর রাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সেলফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে তল্লাশি চালানো হয় জয়নাল হাজারীর মাস্টারপাড়ার বাড়িতে। তার আগেই পালিয়ে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৮টি মামলা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় ৮৫ বছরের সাজাও হয় তার। ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করলে হাজারী আট সপ্তাহের জামিন পান। একই বছরের ১৫ এপ্রিল নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় চার মাস কারাভোগের পর ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর মুক্ত হন তিনি।
১ কোটি ১৩ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করায় ২০০৮ সালে নিম্ন আদালত জয়নাল হাজারীকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন। পরে হাইকোর্ট তার সাজা বাতিল করেন। এরপর একে একে সব মামলা থেকে খালাস পান তিনি। কিন্তু হারানো রাজনীতির মাঠ আর ফিরে পাননি। দশম জাতীয় নির্বাচনে নিজাম হাজারী আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ফেনীর রাজনীতি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন জয়নাল হাজারী। পরে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পান তিনি। যদিও রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে আর জানান দিতে পারেননি তিনি।
ফেনীতে প্রতাপশালী থাকা অবস্থায় তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলেন সাংবাদিক টিপু সুলতানের ওপর হামলার ঘটনায়। বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০০১ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক টিপু সুলতানকে অপহরণ করে হাত-পা ভেঙে দেয়ার অভিযোগ ওঠে জয়নাল হাজারীর অনুগত ক্যাডারদের ওপর। ওই সময় এ ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হয়।
ওই সময় আরো দুটি আলোচিত ঘটনা হলো সোনাগাজীর চর ইঞ্জিমান ট্র্যাজেডি ও পূর্ব চন্দ্রপুর ট্র্যাজেডি। চর ইঞ্জিমানে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ১০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে হত্যার পর মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। পূর্ব চন্দ্রপুরে ট্রিপল মার্ডারেরও আসামি ছিলেন জয়নাল হাজারী। পরে এ মামলায় খালাস পান তিনি।
উল্লেখ্য, দেশের এই রাজনৈতিক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দেশ ও তার দলের জন্য অনেক কাজ করে গিয়েছেন। তার তাকে নিয়ে প্রায় সময় তার নিজ এলাকায় বেশ আলোচনা চলতো। তবে তিনি যখন না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন এমন সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে তখনি দলের সকল নেতাকর্মী তার বাসায় হাজির হয়েছেন। তার এমন চলে যাওয়ায় দলের সকল নেতাকর্মী শোক প্রকাশ করছেন।