কোভিডের টিকা কি মহামারিকে আদৌ পরাভূত করতে পারবে?


ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ কোভিড মহামারির এই পর্য্যায়ে আয়ারল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ বিধি নিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে, আরও যা আছে তা এই মাসের শেষের দিকে প্রত্যাহার করে নেবার কথা রয়েছে। এদিকে দুটি ডোজের টিকা সম্পুর্ন দেয়া হয়ে গেছে ৭২% মানুষকে তবুও কোভিড সংক্রমণ থেমে যায়নি। আয়ারল্যান্ডের কোভিড সংক্রমণের লেখচিত্রের (GRAPH) দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখবো যে, ২০২০ সালের মার্চে শুরু হয়ে কোভিড সংক্রমণের প্রথম তরংগ এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ সর্বোচ্চ শিখর দেখে, তখন একদিনে ১৫০৮ জন নূতন করে সংক্রমিত হয়েছিলো। তারপর ধীরে ধীরে সংক্রমণ কমে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে জুলাই মাসে তারপর ধীরে ধীরে আবার বেড়ে দ্বিতীয় তরংগের শিখর দেখা যায় অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে একদিনে ১২৮৩ জন সংক্রমিত হয়। এরপর সংক্রমণ আবার কমতে শুরু করে এবং ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধে আবার বাড়তে শুরু করে, এটাকে তৃতীয় তরঙ্গ বলা যায়। এই তরঙ্গে সংক্রমণের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে সর্বোচ্চ শিখরের একদিনে সংক্রমিত হয়েছেন ৮,২২৭ জন। তারপর আবার সংক্রমণ কমে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্য্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ৩০০-৫০০ জন নূতন সংক্রমন চলতেই থাকে। জুলাই মাসের শেষার্ধ থেকে আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে গতকাল সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ অবধি প্রতিদিন ১১০০ থেকে ১৫০০ জন নূতন করে সংক্রমিত হচ্ছেন।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিগত ১৮ মাসে আয়ারল্যান্ডে কোভিড সংক্রমণের সর্বমোট ৪টি তরংগ হয়েছে এবং প্রথম তিনটি তরংগের একটি করে শিখর ছিল। চতুর্থ তরংগ এখনো চলছে, কমে যাবার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছেনা। 



গতকাল ১৫ই সেপ্টেম্বর আয়ারল্যান্ডে নূতন করে সংক্রমিত হয়েছেন ১১৮৫ জন। গত সপ্তাহে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৪ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২৯২ জন। ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি আছেন ৬৫ জন। দুঃসংবাদ হলো, খুলে দেয়া স্কুলগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে, গত সপ্তাহ থেকে এই সপ্তাহে এই সংক্রমণের সংখ্যা ৩ গুণ। ডাঃ টনি হোলাহান বলেছেন, “আইসিইউতে ভর্তি হওয়া প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে প্রায় চারজন এবং কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনকে সম্পূর্ণ টিকা দেওয়া হয়নি। যারা এখনও কোভিড-১৯ টিকা নেন নি কিংবা পান নি তাদের জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা গ্রহণ করা জরুরি।”

মহামারির প্রাথমিক সময়ে আমরা সকলেই “হার্ড ইমিউনিটির” কথা শুনেছিলাম এবং এখনো শুনছি। হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের দুটি পদ্ধতি আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে যদি একটি অঞ্চলের সমগ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ সংক্রমিত হয়ে যাবার পর আরোগ্য লাভ করেন আর অন্য পদ্ধতি হচ্ছে যদি সমগ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ টিকা গ্রহণ করেন। অধিকাংশ বলার কারণ  হচ্ছে, এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা কত শতাংশ মানুষ আক্রান্ত কিংবা টিকাপ্রাপ্ত হলে হার্ড ইমিউনিটি হবে। যে সকল ভাইরাস অতিসংক্রমনশীল তাদের জন্য এই হার অনেক বেশী হবে যেমন আমরা জানি মিজলসের ক্ষেত্রে প্রজননের হার Ro ছিল ১২-১৮, যার কারণে বলা হয়েছিলো ৯৫% মানুষ আক্রান্ত কিংবা টিকা পেলেই ভাইরাস তার কার্য্যকরিতা হারাবে অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হবে। কোভিডের ক্ষেত্রে এই হার কত হবে তা সুনিশ্চিত করে বলা না গেলেও প্লস ওয়ানে গত মার্চ মাসে প্রকাশিত এক পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে দেখিয়েছে যে, ইউরোপে কোভিডের প্রজননের হার Ro ২.২ হওয়ার কারনে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য ৫৫% মানুষের টিকা গ্রহণ যথেষ্ট হওয়ার কথা। যদিও এর আগের বছর একই সময়ে চীনে কোভিডের প্রজননের হার Ro ৩.২ হওয়ার কথা প্রকাশিত হয় এবং সেই কারণে হার্ড ইমিউনিটির জন্য ৭০% মানুষের টিকা গ্রহণ কিংবা সংক্রমিত হওয়া যথেষ্ট বলে বলা হয়েছিলো। আমরা এই দুটো সূত্রকে যদি ব্যাবহার করি তাহলে ৫৫- ৭০% এই পরিসীমার মানুষকে টিকা দেয়া হলে কিংবা সংক্রমিত হলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হয়ে যাবার কথা। যদিও আমরা এখন দেখতে পারছি যে, ৭০% এর বেশী মানুষকে সম্পূর্ন টিকা প্রদানের পরও হার্ড ইমিউনিটি নামক সোনার হরিণ অর্জিত হয়নি।


 

এখানে একটি কথা বলে নেই, কেননা আপনারা ভাববেন আমি আয়ারল্যান্ডে থাকি বলেই আয়ারল্যান্ড নিয়ে ভাবছি। এই কথাতে কিছুটা সত্যতা আছে বটে তবে আমি আয়ারল্যান্ডকে একটি ইউনিট হিসেবে ভাবছি। আয়ারল্যান্ড ইউরোপের একটি দেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্গত। কোভিডের ব্যাপারে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশের অবস্থান কাছাকাছি, টিকা দেবার ব্যাপারেও কাছাকাছি অবস্থানে আছে এই সকল দেশ। তাই অন্তঃপক্ষে যে কোন একটি দেশকে ইউনিট ধরে আলোচনা করা হলে যে কোন দেশের একটি পরিমাপ আমরা করতে সক্ষম হবো।

আমরা যদি বাংলাদেশের কথা ভাবি তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে কেননা বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংক্রমিত হয়েছেন ১% এর মত আর ওয়ার্ল্ড ইন ডাটার সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে এক ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে ১২%, আর দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে ৮.৪৫% মানুষকে। তাই বাংলাদেশ কোনভাবেই হার্ড ইমিউনিটির ছিটেফোঁটা কাছে এখনো যেতে পারেনি। ভারত অবশ্য বাংলাদেশের তুলনায় বেশ অগ্রগামী তাদের জনগোষ্ঠীর ৪১% মানুষকে এক ডোজ আর ১৩% মানুষকে দুই ডোজ দেয়া সম্পন্ন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় টিকার দৌড়ে ভারত এখনো অগ্রগামী আছে।

আরও কিছু কথা বলে নেয়া প্রয়োজন, আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ আর ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার, এর মধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন ২ লক্ষ ৬২ হাজার। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এই দেড় বছরে সংক্রমণের মাধ্যমে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছেন ৫-৭% মানুষ আর মৃত্যুবরণ করেছেন সংক্রমিতের ১.৩৫% আর সুস্থ হয়ে উঠার সংখ্যা সংক্রমিতের ৭০% এর বেশী। যদি সংক্রমণের মাধ্যমে প্রতিরোধ অর্জনের চিন্তা করা হতো তাহলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আয়ারল্যান্ডেই মৃত্যতুবরণ করতে হতো ৫০ হাজারেরও বেশী মানুষকে। ভয়াবহ! যা ভাবাও যায়না। তাই একমাত্র জানা পদ্ধতি ছিল টিকার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন। এখন ৭০% মানুষকে টিকা দেবার পরও সেই হার্ড ইমিউনিটী অর্জিত হয়নি, এখনো সংক্রমণ চলছে, এর ব্যাখ্যা কি? তাহলে হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্ব কি ভুল? কোথায় ফাঁক কিংবা ফোকর?

আমরা যদি আরও একটি দেশের কথা বলি, সেই দেশ হচ্ছে ইউনাইটেড আরব এমিরেটস। দেশটিতে ইতিমধ্যে ৯০% বেশী মানুষকে এক ডোজ টিকা দেয়া হয়ে গেছে আর ৮০% এর বেশী মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়ে গেছে তবুও সেখানে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন।

আমরা যদি ব্রাজিলের মানাউস শহরের কথা শুনি তাহলে জানবো গত বছর শহরটির অধিকাংশ মানুষ সংক্রমিত হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তাও কিন্তু হার্ড ইমিউনিটী অর্জিত হয়নি। সেখানে মানুষ সংক্রমিত এবং পুনঃসংক্রমিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

আমরা ব্যাপারটাকে সহজ করে ফেলি, কারণ আমরা বৈজ্ঞানিক নই। বিজ্ঞানী না হলেও বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি আলোচনা, সমালোচনা এবং বিতর্ক সহজে উত্থাপন করা যায়। সেটাতেও অনেকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতে পারে। তাই তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশদ আলোচনা বাদ দিয়ে, সেই সকল তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা যদি নীচের কয়েকটি কথা এই মুহুর্তে প্রকাশ করি তাহলে বোধ করি সারবেত্তা বেরিয়ে আসবে।

১। “হার্ড ইমিউনিটি” একটি তত্ত্ব যা এখনো প্রমাণিত হয়নি। টিকার মাধ্যমে আদৌ হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সম্ভব হবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে টিকা আমাদেরকে প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েছে। টিকাপ্রাপ্তরা তাৎপর্য্যপূর্ন সংখ্যায় সুরক্ষিত থাকছেন।

২। যারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গিয়েছেন তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বল্পদিনের হতে পারে বিধায় তারা আবারো সংক্রমিত হবেন না এ কথা হলপ করে বলা যাচ্ছেনা। কেউ কেউ ইতিমধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন।

৩। টিকার কার্য্যকারিতা ভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি ডেল্টা প্রজাতির ক্ষেত্রে টিকার কার্য্যকারিতা কম ছিল। 

৪। কোভিড টিকার কার্য্যকরিতা প্রমাণিত। যারা টিকা নিয়েছেন তাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা তাৎপর্য্যপূর্নভাবে কম। টিকা নেবার পর যদি সংক্রমিত হয়ে যান তাহলে তাদের বেলায় ভীষণ অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম আর অতি নগণ্য সংখ্যক যারা ভীষণ অসুস্থ হবেন তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।

৫। যদিও প্রত্যাশিত নয়, তবুও যদি আর কোন নূতন প্রজাতির জন্ম হয় তাহলে সেটা টিকার প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেঙ্গে দিতে পারে। সেটা আমরা আশা করিনা, তবুও যদি ঘটনা ঘটেই যায় তাহলে সমস্যা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে।

৬। কিছু ক্ষেত্রে টিকা দ্বিতীয় ডোজ দেবার ৬-৯ মাসের মধ্যে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে বলে কিছু কিছু পরীক্ষায় বলা হচ্ছে। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের কিছু দেশ তৃতীয় ডোজ দেয়া শুরু করেছে। যদিও এখানে নৈতিক সমস্যার কথা বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান। তিনি বলেছেন, বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠী যখন এক ডোজ টিকা পায়নি সেখানে ধনাঢ্য দেশ তৃতীয় ডোজ নেয়াটা নৈতিক হবেনা। তিনি সার্বজনীন টিকা প্রদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

মন্তব্যঃ রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার এবং ব্যাক্তি যাই বলুক না কেন, টিকা গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের কোন গত্য্যন্তর আছে বলে এই মুহূর্তে মনে করার কোন অবকাশ নেই। টিকা গ্রহণ নিজেদের সুরক্ষিত করে অন্যদেরও সুরক্ষার সুযোগ করে দেবে। টিকা গ্রহণের পরও যেহেতু সংক্রমণ এখনো সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে যায়নি তাই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধূয়াধুয়ি করা এবং জনাসমগম হয় এমন স্থানে মাস্ক পরে রাখা এখনো আমাদের নিজেদের সুরক্ষিত রাখার হাতিয়ার হয়ে রইলো।
কোভিড টিকা আদৌ কি মহামারিকে সম্পুর্ন পরাজিত করতে পারবে? এই প্রশ্ন আমাদের মনে ঝুলন্ত হয়ে থাকলো।।

তথ্যসূত্রঃ জন হপকিন্স, ওয়ার্ল্ডোমিটার, আর টি ই, ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা, প্লস ওয়ান।
 

SHARE THIS ARTICLE