কোভিড টিকা প্রদানে কোন দেশ এগিয়ে আছে?

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ বিগত এক বছরের বেশী সময় ধরে বিশ্বে মহামারি চলছে, কোভিড-১৯ মহামারি। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী এই রোগে আক্রান্তের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা ১১ কোটির কাছাকাছি হয়েছে আর মৃতের সংখ্যা ২৪ লক্ষ অতিক্রম করেছে, সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৮ কোটির বেশী মানুষ। এই পরিসংখ্যান প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম সেটা নির্দ্বীধায় বলা যায়, কেননা পৃথিবীর অনেক দেশেই যথেষ্ট সংখ্যায় টেস্ট করা সম্ভব হয় নাই, অনেক দেশে মানুষ নিজেরাই টেস্ট করতে এগিয়ে আসে নাই ।

মহামারি থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে গিয়ে, বিশ্বে সমন্বিত কোন কর্মসূচী না থাকায়, দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। লক ডাউন, কোয়ারেন্টাইন আর আইসোলেশনের ফলে দেশে দেশে মানুষ ঘরে বন্দী হয়ে পড়েছে, ব্যাবসা-বানিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে, অর্থনীতি হয়েছে বিপর্য্যস্ত আর স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা ভেঙে পড়েছে।

আমাদের বর্তমান জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিধিতে, কোভিড মহামারীর অবসান ঘটানোর একমাত্র উপায় হলো, বিশ্বের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন করে তোলা। আর ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হচ্ছে একটি টিকা (ভ্যাক্সিন)। অতীতে বিভিন্ন সময়ে সংক্রামক রোগ থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য টিকা অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।

কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর ১২ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাফল্যের সাথে সার্স কোভ-২ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে এরকম বেশ কয়েকটি টিকা আবিষ্কার করে বাজারজাত করতে সক্ষম হয়েছে। এটা একটি ঐতিহাসিক সাফল্য।

মানবজাতির সামনে এসেছে, এখন নূতন চ্যালেঞ্জ, আর তাহলো বিশ্বের সকল প্রান্তে, সকল জনগোষ্ঠীর নিকট কত দ্রুত সম্ভব এই টিকা পৌঁছে দেয়া যায় এবং শুধু পৌঁছে দিলে হবেনা যাতে যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ তা গ্রহণ করে সেটা সুনিশ্চিত করা। এই টিকা যেন শুধুমাত্র ধনাঢ্য জাতির জন্য না হয়ে সার্বজনীন হয় সেটা সুনিশ্চিত করাও সফলতার চাবিকাঠি।

ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের গুটিকয়েক দেশে টিকা প্রদান কর্মসূচী শুরু করা হলেও এখন সেটা বিশ্বের বেশ কিছু দেশে শুরু হয়েছে। চলুন আমরা দেখি সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে কোন দেশ কতজন মানুষকে ইতিমধ্যে এই টিকা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। এই পরিসংখ্যান পাওয়া সহজ না হলেও ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা চেষ্টা করছে আমাদের জন্য সর্বশেষ তথ্য জোগাড় করে জানিয়ে দিতে। ইতিমধ্যে যা জানা গেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে বিশ্বের উচ্চবিত্ত দেশ আর নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশগুলোর মধ্যে টিকাপ্রাপ্তির ব্যাবধান মারাত্নক। দেখা যাচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত দেশগুলোর জনসংখ্যার তুলনায় উচ্চবিত্ত দেশগুলো মানুষ প্রায় ২৩ গুণ বেশী টিকা ইতিমধ্যে প্রদান করেছে। এই পরিসংখ্যান টিকার অসম বণ্টনের দৃশ্য চিত্রায়িত করেছে।

চলুন আমরা দেখি সেই তথ্যে কি আছে সর্বশেষঃ  (ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা)

গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্য্যন্ত বিশ্বে সর্বমোট ১৭ কোটি ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষকে ১ ডোজ করে টিকা দেয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, তার অর্থ হচ্ছে সারা বিশ্বের মাত্র ২.২১% শতাংশ মানুষকে ইতিমধ্যে শুধুমাত্র এক ডোজ টিকা দেয়া সম্ভব হয়েছে, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ৫ কোটি ৬ লক্ষ ৪০ হাজার, চীন ৪ কোটী, যুক্তরাজ্য ১ কোটী ৫০ লক্ষ, ভারত ৮২ লক্ষ ৬০ হাজার, ইসরায়েল ৬২ লক্ষ ৮০ হাজার, ব্রাজিল ৫০ লক্ষ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ৫০ লক্ষ, বাংলাদেশ ৭ লক্ষ ৩৬ হাজার ৭৮০ এবং আয়ারল্যান্ড প্রায় ৩ লক্ষ।

দেশগুলোর জনসংখ্যার অনুপাতে কতজনকে দেয়া হয়েছে সেটা যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো সবার আগে রয়েছে ইসরায়েল, তারা ইতিমধ্যে ৭২.৫৮% মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দিয়ে বিশ্বে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী রয়েছে, এরপর আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, তারা দিয়েছে ৫০.৬১% মানুষকে, যুক্তরাজ্য ২৮%, যুক্তরাষ্ট্র  ১৫.৩%, আয়ারল্যান্ড ৬%, ভারত ০.৬% আর বাংলাদেশ ০.৪৫%।

আশা করি এই কথা সকলেই অনুধাবন করতে পারছেন যে, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র টিকা প্রদানের ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে, যদিও সফলতার চুড়ায় আসা এখনো বাকি রয়েছে। ধনী নির্ধন অনেক দেশই টিকা প্রদান কর্মসূচীতে পিছিয়ে আছে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ পিছিয়ে আছে অনেকখানি। সকলকে এই কথা অনুধাবন করা জরুরি যে শুধুমাত্র নিজ দেশকে টিকা প্রদান করে কেউ একা নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারবেন না। তাই টিকার সার্বজনীন কর্মসূচী অত্যন্ত জরুরী। অন্ততপক্ষে কাছাকাছি সময়ে যদি বিশ্বের সকল মানুষের জন্য টিকা প্রাপ্তি সুরক্ষিত করা না যায় তাহলে এই মহামারি কোনভাবেই দমন করা সম্ভব হবেনা, এই কথা ধনী দেশগুলো যত দ্রুত অনুধাবন করতে পারবে তত দ্রুত বিশ্ব সুরক্ষিত হবে।

SHARE THIS ARTICLE