ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ বিশ্বব্যাপী এখনো কোভিড মহামারি চলছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের সূত্রে এই মুহুর্তে বিশ্বে সংক্রমিতের মোট সংখ্যা ১৮ কোটি ৬০ লক্ষের কাছাকাছি, মৃত্যুবরণ করেছেন ৪০ লক্ষের বেশী মানুষ আর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১৭ কোটির বেশী মানুষ। এটি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশী বলেই আমাদের ধারনা।
এই অবস্থায় কোভিড ভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন (মিউটিশন) নিয়ে সকলেই চিন্তিত। বিশেষ করে সাম্প্রতিক ভারতীয় ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ। ডেল্টা ধরনের কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা এবং উপসর্গ, মূল কোভিড ভাইরাস থেকে অনেক বেশী এবং এটির বিরুদ্ধে বর্তমানে প্রাপ্ত চিকিৎসা এবং টিকার কার্য্যকারিতা পর্য্যাপ্ত নাও হতে পারে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে জানিয়েছে। এই ডেল্টা ধরন পূর্বে শনাক্ত আলফা (ইউ কে) ধরন থেকে আরও বেশী সংক্রামক বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। আশার কথা এই যে যারা ইতিমধ্যে টিকার দুটি পূর্নাংগ ডোজ পেয়েছেন তারা এই ডেলটা ধরন দিয়ে সংক্রমিত হলেও তাদের উপসর্গ মারাত্নক হবার সম্ভাবনা কম এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই কারণে, যদিও বিভিন্ন দেশে ডেল্টার সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে কিন্তু যারা টিকা পেয়েছেন তাদের মধ্যে মারাত্নক উপসর্গ কিংবা মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কম বলে প্রকাশিত হয়েছে।
এরকম উদ্বেগজনক সময়ে, ভাইরাসটি আবারো তার রূপ পরিবর্তন করেছে। এই নতুন ধরনের ভাইরাসের নাম দেয়া হয়েছে ল্যাম্বডা। ল্যাম্বডা ধরনটি ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন এটি একটি নতুন ধরনের মিউটেশন যা অন্যান্য মিউটেশন ভ্যারাইটি থেকে অত্যন্ত বেশি সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। এই ল্যাম্বডা ভেরিয়েন্ট পেরুতে মে মাসে প্রথম ধরা পড়ে। এই মুহূর্তে পেরুর প্রায় ৮২ ভাগ রোগী ল্যাম্বডা নামক ভেরিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমিত হচ্ছেন। এই নতুন ধরনের ল্যাম্বডা ভাইরাস ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় ২৯ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মূলত এটি দক্ষিণ আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা এবং ইউরোপের কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিশ্ব স্ব্যাস্থ্য সংস্থা ল্যাম্বডাকে উদ্বেগগজনক ধরন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এই ল্যাম্বডা নামক ভ্যারাইটি ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যেও কিছু কিছু সংক্রমণ করেছে বলে জানা গিয়েছে। গত জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ল্যাম্বডা শনাক্ত করতে পেরেছিল এবং তারা মনে করে যে এটা অধিকতর সংক্রামক। বর্তমানে প্রাপ্ত চিকিৎসা কিংবা টিকা এই ল্যাম্বডার বিরুদ্ধে কতটুকু কার্য্যকর তা এখনো সঠিক করে বলা যাচ্ছেনা।
আশার কথা যে, আয়ারল্যান্ডে ল্যাম্বডা ধরন দিয়ে সংক্রমিত কোন রোগী এখনো শনাক্ত হয়নি।
আমরা জানি, ইতিমধ্যে কমপক্ষে এই কোভিড ভাইরাসের ৮টি ধরন আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করেছে। তারমধ্যে আলফা, বেটা, গামা এবং ডেল্টা এই চারধরনের ভাইরাস বিশেষ উদ্বেগের কারণ ঘটিয়েছে। এই মুহূর্তে পঞ্চম ধরন হিসেবে ল্যাম্বডা চিকিৎসা জগতে নূতন উদ্বেগ সংযোগ করলো।
অনেকেরই প্রশ্ন এই নূতন নূতন ধরন থেকে কিভাবে আমরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারি। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলের অজানা নয়। ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব, ভাল বায়ু চলাচল এবং জনাকীর্ণ স্থান বা বন্ধ স্থান এড়ানো। এই পদক্ষেপগুলো সকল ধরনের ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস করে এবং ভাইরাসের নূতন মিউটিশনের সম্ভাবনা হ্রাস করে।
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে নতুন ধরনের বিরুদ্ধে টিকা কি আদৌ কার্য্যকর? এটা এখন বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত যে আবিষ্কৃত টিকা এই ভাইরাসের মূল প্রজাতির বিরুদ্ধে মানবজাতিকে সুরক্ষা দিতে সফল হয়েছে। আমরা যদি ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলেই এই সফলতার প্রমাণ দেখতে পাবো। সমস্যা হচ্ছে ভাইরাসের নূতন ধরন নিয়ে। এটা এখন প্রতীয়মান যে, কয়েকটি ধরনের বিরুদ্ধে এই টিকা মূল ধরনের মত সফল নয় তবে এমনকি ডেল্টা ধরনের মারাত্নক সংক্রমণের ক্ষমতা সম্পন্ন ধরনের বিরুদ্ধেও টিকার কার্য্যকারিতা প্রমাণিত। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন টিকার কার্য্যকারিতা কম অর্থাৎ মূল ধরনের বিরুদ্ধে ৯৫% কার্য্যকর হলেও ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে ৬৫% কার্য্যকর। তবে যে কোন ধরনে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু থেকে আমাদেরকে সুরক্ষিত করতে এই টিকা শতভাগ সফল হচ্ছে এবং উপসর্গের মারাত্নক পরিণতিও বহুলাংশে প্রতিরোধ করেছে এই টিকাগুলো। তাই টিকা কার্য্যক্রম ত্বরান্বিত করা, উৎপাদন বৃদ্ধি করে সারা বিশ্বে দ্রুত টিকা প্রদানে কার্য্যক্রম গ্রহণ অত্যাশ্যক।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিত্তশালী দেশগুলো স্বার্থপরের মত টিকা প্রদান করে নিজেদের সুরক্ষিত করেছেন ভাবলেও তৃতীয় বিশ্বে যতই সংক্রমণ বাড়বে ততই ভাইরাস মিউটেশন করে নিজেদের চরিত্র পরিবর্তন করে নূতন নূতন ধরনের জন্ম দেবে। ডেল্টা আর ল্যাম্বডা ধরনের সংক্রমণ যেমন ভারত আর পেরু থেকে সারা বিশ্বে আবার ছড়াচ্ছে ঠিক একই রকম আরও নূতন ধরন আরও ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে আবার বিশ্বকে বিপন্ন করে দিতে পারে। তাই বিত্তশালী বিশ্বকে ভাবতে হবে নিজেদের নয় সারা বিশ্বকে দ্রুত কিভাবে টিকা দিয়ে সংক্রমণ বন্ধ করা যায় আর সেটা সম্ভব হলেই, নূতন মিউটেশনের সম্ভাবনা রুদ্ধ করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ ওয়ার্ল্ডোমিটার, আইরিশ টাইমস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, যুক্তরাজ্য।