
আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ মক্কার মুশরিকদের অত্যাচার যখন বেড়েই চলেছিল তখন আল্লাহ তাআলার নির্দেশে নবীজি (স.) মদিনায় হিজরত করেন। দুনিয়া থেকে ইসলামকে চিরতরে মুছে দিতে মক্কার মুশরিকরা সব ধরনের পরিকল্পনা করেও ব্যর্থ হয়। তাদের এ প্রচেষ্টা হিজরতের পরেও চলমান ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে ইতিহাসের এক নজিরবিহীন অসম যুদ্ধের অবতারণা হয় বদরের প্রান্তরে। গুটিকয়েক মুসলমানদের একটি বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হয় মুশরিকদের বিশাল বাহিনী।
উহুদের যুদ্ধেও তেমন সুবিধা করতে না পেরে এবার তারা চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নবীজি (স.) মক্কার উপকণ্ঠে একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করলেন মুশরিকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। হুজুর (স.) দশ বারো জনের একটি দল অনুসন্ধানের জন্য তৈরি করলেন। তাদেরই একজন খুবাইব ইবনে আদি (রা.)।
তারা মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং মক্কার উপকণ্ঠে রাজি নামক একটি ঝর্ণার কাছে পৌঁছান। এমন সময় কিছু লোক তাদের দেখে ফেলে এবং গোপনে হুজাইন গোত্রের একটি শাখা বনু লেহিয়ান-এর লোকদের জানিয়ে দেয়। বনু লেহিয়ান এর লোকেরা শতাধিক তীরন্দাজের একটি দক্ষ বাহিনী তাদের আক্রমণের জন্য লেলিয়ে দেয়। তীরন্দাজের সেই দলটি সাহাবীদেরকে ঘিরে ফেলে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একে একে শহীদ হন সাত জন সাহাবি। জীবিত আছেন মাত্র ৩ জন। তাঁরা হলেন খুবাইব (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে তারিক (রা.) এবং জায়েদ ইবনে দাসিনা (রা.)।
তাঁদেরকে বেঁধে মক্কায় বিক্রি করার উদ্দেশ্যে পথ চলতে থাকে মুশরিকরা। পথিমধ্যে মাররুজ জাহারানে আব্দুল্লাহ ইবনে তারিক (রা.) হাতের বাধন খুলে ফেলেন এবং মুশরিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। লড়াই করতে করতে তিনি এক পর্যায়ে শহীদ হন।
হজরত জায়েদ ইবনে দাসিনা (রা.)-কে সফওয়ান ইবনে উমাইয়া পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে কিনে নেয়। আর খুবাইব (রা.)-কে কিনে নেয় হারিস-এর সন্তানরা। বন্দী অবস্থায় খুবাইব ইবনে আদি (রা.) একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হন। তার সেই ছোট্ট বন্দি জীবনে অনেক শিক্ষা রয়েছে মুসলিম উম্মাহর জন্য।
একদিন হারিসের কন্যা জানালার ফাঁক দিয়ে বন্দি খুবাইব (রা.)-কে দেখতে গিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা দেখতে পায়। সে দেখতে পায় তার সামনেই এক থোকা আঙ্গুর। অথচ তখন আঙ্গুরের মৌসুম নয়। এই রিজিক আল্লাহ তাআলাই তার কাছে পৌঁছিয়েছেন। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক বান্দাদের কাছে তা এভাবেই পৌঁছিয়ে থাকেন যেমনিভাবে তিনি হজরত মরিয়ম (আ.)-এর কাছে পৌঁছিয়েছিলেন।
হাদিসে ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হারিসের মেয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি খুবাইবের চেয়ে উত্তম কোনো বন্দিকে কখনো দেখিনি। আল্লাহর শপথ, একদিন আমি তাঁকে আঙুরের থোকা থেকে আঙুর খেতে দেখেছি। অথচ তখন তাঁকে লোহার শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাছাড়া মক্কায় কোনো ফলফলাদিও নেই। নিশ্চয়ই এ ফল আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল। খুবাইবের রিজিক হিসেবে তা পাঠিয়েছেন।’ (সহিহ বুখারি: ৩০৪৫)
বুখারিরর বর্ণনায় তাঁর আরেকটি ঘটনা এসেছে। খুবাইব (রা.) বন্দিশালায় মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি ঘরের মালিকানের কাছে একটা খুর চান। উদ্দেশ্য ক্ষৌরকর্ম সারা। দাড়ি-গোঁফ কাটবেন। এরই ফাঁকে মালিকানের ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা তাঁর কাছে চলে আসে। ঘরের মালিকান বলল, ‘হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম বাচ্চা নেই! সাথেসাথেই আমার মধ্যে একটা ভয়মিশ্রিত শিহরন খেলে গেল। আমার বাচ্চা কই গেল? চারপাশে খুঁজতে লাগলাম। খুবাইবের ওপর চোখ পড়তেই দেখলাম, তাঁর রানের ওপর আমার বাচ্চা বসে আছে। এই দৃশ্য দেখে আমি যেন ভেতরে মরে গেলাম। দেখলাম, তাঁর হাতে একটা ধারাল ছুরি এবং বাচ্চাটি তাঁর কোলে।
সে একজন বন্দি, মৃত্যুর প্রহর গুনছে। হতে পারে মক্কার মুশরিকরা তার সাথে প্রতারণা করেছে, সে তাঁর প্রতিশাধ নিতে বাচ্চাটাকে হত্যা করবে? খুবাইব (রা.) মহিলার বিপর্যস্ত দশা দেখে একটু মুচকি হাসলেন। বললেন, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন, আমি তাকে হত্যা করব? খোদার কসম! আমি তা করব না।
খুবাইব (রা.) নিজের জীবন, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি সবকিছুই আল্লাহর জন্য কোরবান করে দিয়েছেন। প্রিয়নবীর (স.) ভালোবাসায় পূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব। খাঁটি মুমিনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘তোমাদের কেউ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।’ (সহিহ বুখারি: ১৪)
খুবাইব (রা.)-কে হত্যা করার জন্য খোলা প্রান্তরে আনা হলো। তখন খুবাইব (রা.) তাদের কাছে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের অনুমতি চান। তারা অনুমতি দেয়; তিনি কিবলামুখী হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। অবাক ব্যাপার, তিনি নামাজ দীর্ঘ করেননি; স্বল্প সময়ের ভেতরেই শেষ করেন। তারপর মুশরিকদের দিকে এগিয়ে গেলেন। দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘যদি তোমরা এমন মনে না করতে যে আমি মৃত্যুর ভয়ে নামাজ দীর্ঘ করছি, তবে আমি আরও সময় নিয়ে নামাজ আদায় করতাম।
এই মহান শিক্ষা ও উন্নত মূল্যবোধই মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন। প্রথম যুগের মর্দে মুমিনরা যে অতুলনীয় গুণাবলি অর্জন করেছিলেন, তারই চর্চা হওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সাহাবিদের জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। পোক্ত ঈমানের দীক্ষা নিতে সাহাবিদের জীবনী পাঠ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।