গল্প নয় সত্যি, প্রসঙ্গ করোনা টিকা

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ বৈশ্বিক মহামারী বদলে দিয়েছে পৃথিবীর হাল হকিকত। আনুষ্ঠানিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে সাত কোটি আর মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় সতের লক্ষ মানুষ। এগার মাসের প্রাণঘাতী এই যুদ্ধে কোভিড ভাইরাস এখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। ফাইজার-বায়োনটেক বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানি ইতিমধ্যে কোভিডের প্রতিষেধক টিকা বাজারজাত করেছে। অনেকেই এই টিকা আবিষ্কারের সংবাদকে “অলৌকিক” বলে প্রশংসা করেছেন। আপাততঃ মনে হচ্ছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই লড়াই মানুষের অনুকূলেই আসছে।টিকা আবিষ্কারের সংবাদ প্রকাশের পর তেলের দামের সাথে কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্রুত বেড়ে গিয়েছে। আকাশে ডানা মেলার আশা জাগ্রত হওয়ায় এয়ারলাইনগুলির শেয়ারের দামও বেড়েছে। 

এই টিকা আবিষ্কারের পিছনে যাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা আর অক্লান্ত পরিশ্রম কাজ করেছে তারা মূলতঃ একজোড়া দম্পতি, কাজ করছেন বায়োনটেক কোম্পানির হয়ে। এই তারকারা হলেন, ডাঃ উগুর শাহীন বয়স ৫৫ বছর আর তার স্ত্রী ৫৩ বছর বয়সী ডাঃ ওজলেম তুরেসি, বাস করেন জার্মানীর মেইঞ্জ শহরে। অভিবাসী এই দম্পতির অসামান্য সাফল্য গাথা গল্প মনে হলেও আমাদের সামনে আজ সত্যি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিন থেকে নীরবে নিভৃতে ল্যাবে কর্মরত এই চিকিৎসক দম্পতি এখন রাতারাতি হয়ে উঠেছেন খ্যাতির এবং বিত্তের শীর্ষে। দ্রুত গতিতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে তাদের আবিষ্কৃত টিকা বি টি এন ১৬২ (BNT162), একই সাথে ছড়িয়ে পড়ছে তাদের স্বীকৃতি আর পৃথিবীর মানুষের মধ্যে আবার জেগে উঠার আশা হয়েছে সঞ্চিত।

Inside the hunt for a Covid-19 vaccine: how BioNTech made the breakthrough  | Financial Times

অতীতে, এই দম্পতি ক্যান্সার চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছিলেন; তারা মনোনিবেশ করেছিলেন, শরীরের কোষের প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসা উন্নত করা নিয়ে। বিগত এক দশক ধরে, তাদের কোম্পানি কোন পণ্য বাজারে আনেনি। ২০১৮ সালে, বার্লিনে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের একটি সম্মেলনে, অধ্যাপক শাহিন একটি সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন: তিনি বলেছিলেন, তাঁর সংস্থা সম্ভবত বিশ্বব্যাপী মহামারীর ক্ষেত্রে তার “মেসেঞ্জার আর এন এ প্রযুক্তি” ব্যাবহার করে একটি ভ্যাকসিন দ্রুতই উপহার দিতে পারবেন।

তার ২০১৮ সালের সেই উদ্যমী ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে। এই দম্পতি ক্যান্সারের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, আজ তারা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জগতে অন্যতম বিজ্ঞানী হিসাবে অভিহিত হয়েছেন। মানবজাতিকে করোনা ভাইরাসের করাল থাবা মুক্ত করতে তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাক্সিন ইতিমধ্যে শেষ পর্য্যায়ের পরীক্ষায় সফল হয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডায় সরকারী অনুমোদন পেয়ে গনটিকা প্রদান শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই এই ভ্যাক্সিন আরও অনেক রাষ্ট্রে ব্যাবহৃত হবে। 

ইমিউনোথেরাপি বিশেষজ্ঞ

১৯৬৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তুরস্কের ইস্কেনদারুনে জন্ম নেয়া ডাঃ সাহিন একজন চিকিৎসক, ইমিউনোলজিস্ট এবং ব্যাবসায়ী। তার বয়স যখন ৪ বছর, তখন তার পরিবার জার্মানির কোলোনে চলে আসেন। তার বাবা ফোর্ডের একটি প্লান্টে কাজ করতেন। একজন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে দেখেই তিনি কোলোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসক হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯৩ সালে, টিউমার কোষে ইমিউনোথেরাপির অবদান সম্পর্কিত গবেষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি মেইঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সপেরিমেন্টাল অনকোলজির অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। ২০০৮ সালে তিনি এবং তার সহধর্মিনী ডঃ তুরেসী যৌথ উদ্যোগে গড়ে তুলেন স্বপ্নের বায়োটেকনোলজী কোম্পানি  “বায়োনটেক” আর দায়িত্ব নেন সেই কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহীর।

The headquarters of German biotech firm BioNTech

এদিকে ডাঃ ওযলাম তুরেসি, ইস্তাম্বুল থেকে জার্মানিতে পাড়ি দেয়া এক তুর্কি চিকিৎসকের মেয়ে। জার্মানির লেস্ট্রাপে ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করে তিনি প্রথমে নান হতে চেয়েছিলেন, মেডিকেল স্কুলে অধ্যয়ন করে চিকিৎসক হন আর তারপর জার্মানির অন্যতম অগ্রণী বিজ্ঞানী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হন। বর্তমানে তিনি বায়োনটেকের চিফ মেডিকেল অফিসার এবং অন্যতম পরিচালক।

এই জুটি প্রথমে গবেষণা এবং অধ্যাপনার দিকে মনোনিবেশ করেন। এক সময়ে ডঃ সাহিন, জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে রল্ফ জিংকার্নেগেলের গবেষণাগারে কাজ করেছিলেন, যিনি ১৯৯৬ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন, শরীরের ইমিউন সিস্টেম কিভাবে ভাইরাস আক্রান্ত কোষ চিনে নিতে পারে সেই পদ্ধতি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। 

২০০১ সালে, এই দম্পতি গ্যানিমেড ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠা করেন এবং মনোক্লোনাল এন্টিবডি ব্যবহার করে ক্যান্সারের চিকিৎসার ঔষধ তৈরি করেন। ২০০৮ সালে, তারা ক্যান্সার  চিকিৎসার জন্য মেসেঞ্জার আরএনএ সহ আরও বিস্তৃত প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়ে বায়োনটেক প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৬ সালে তারা গ্যানিমেডকে ১৪০ কোটি ডলারে বিক্রি করে দেন।

মহামারীর আগেও, বায়োনটেক এম আর এন এ গবেষণা কার্যক্রমের সাথে সক্রিয় ছিল এবং গবেষণার জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে পেরেছিল। বার্লিন সহ জার্মানীর অন্যান্য শহর, কেমব্রিজ এবং ম্যাসাচুসেটস-এ অফিস সহ বর্তমানে এই সংস্থার কার্য্যক্রমের সাথে ১,৮০০-এরও বেশি কর্মী রয়েছে।

Moderna Inc

২০১৮ সালে, এটি ফাইজারের সাথে অংশীদারিত্বের সূচনা করে। গত বছর, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এইচআইভি এবং টিবি’র চিকিৎসায় গবেষণার জন্য এই সংস্থাটিতে সাড়ে ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। 

২০১৯ সালে, ডঃ সাহিনকে মুস্তফা পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলমানদের জন্য দ্বিবার্ষিক ইরানি পুরস্কার। ২০২০ সালের জুনে, বায়োনটেক রূপান্তরযোগ্য বন্ডের ব্যক্তিগত স্থাপনার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের টেমাসেক হোল্ডিংস এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২৫ কোটি ডলার পেয়েছিল। আর আজ ফিনানশিয়াল টাইমস এই দম্পতিকে “পিপল অফ দা ইয়ার অর্থাৎ বছরের সেরা মানব” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 

নব্য আবিষ্কৃত টিকার বিশেষত্ব

অন্য সকল টিকার তুলনায় ফাইজার-বায়োনটেকের টিকা সম্পুর্ন নূতন পদ্ধতিতে তৈরি। অন্যান্য অনেক  ভ্যাকসিনের মতো- ইন্ট্রামাসকুলার ইনজেকশনের মাধ্যমে দিতে হলেও এতে একটি অ্যান্টি-ভাইরাল মেসেঞ্জার আর এন এ রয়েছে এবং এম আর এন এ ব্যাবহারের এই কৌশলটি কোনও রোগের বিরুদ্ধে অতীতে কখনও ব্যাবহার করা হয়নি।

এম আর এন এ ভ্যাকসিনের সিন্থেটিক জিনগুলি এমনভাবে “প্রোগ্রাম” করা হয়েছে যাতে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে মানব দেহের নিজস্ব প্রোটিন ব্যবহার করে ভাইরাস সদৃশ্য “নকল” ভাইরাস তৈরি করে (যেমন সারস-কোভি-২)। এই নকল ভাইরাসকে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ (ইমিউন) ব্যাবস্থা আসল মনে করে ভাইরাস বিরোধী এন্টবডি তৈরি করে শরীরকে প্রতিরোধ শক্তি প্রদান করে ।

আমরা সকলেই জানি, অতীতে যতগুলো টিকা সফলতা অর্জন করেছিলো তাদের মধ্যে একটি পদ্ধতি ছিল আংশিকভাবে জীবিত (অ্যাটেনিউটেড) ভাইরাসের ব্যাবহার, এই কৌশল ব্যাবহার করেই যুক্তরাজ্যের ডাঃ এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ সালে গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। আরেকটি পদ্ধতি হলো সালে মৃত (নিষ্ক্রিয়) ভাইরাসের ব্যাবহার, এই কৌশল ব্যাবহার করে বর্তমানে হেপাটাইটিস, পোলিও এবং ফ্লু এর টিকা বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই পদ্ধতিতে টিকা তৈরিতে অনেক সময় লাগে এবং এই টিকা শুধুমাত্র একটি স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কাজ করে অর্থাৎ রূপান্তর হয়ে গেলে আর তার কার্য্যকরীতা থাকেনা।

অন্যদিকে আগে কখনো ব্যাবহৃত হয়নি এমন এম আর এন এ পদ্ধতির একটি বড় ইতিবাচক দিক হচ্ছে: এই ভ্যাক্সিনটি একটি সফটওয়ারের সাহায্যে অতি দ্রুত লক্ষ কোটি ডোজ উৎপন্ন করা সম্ভব।

২০২০ সালের ১০ নভেম্বর মঙ্গলবার ভ্যাকসিনের সাফল্যের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় তাদের কোম্পানি বায়োনটেকের মূল্য ২১০ কোটী ডলারে উন্নীত হয়েছে। ডঃ সাহিন এবং ডাঃ তুরেসি এখন জার্মানীতে ১০০ জন ধনাঢ্য পরিবারের অন্যতম। এই দুই শত কোটী ডলারের মালিক দম্পতি তাদের একমাত্র কিশোরী কন্যাকে নিয়ে তাদের অফিসের কাছেই একটি সাধারণ এপার্টমেন্টে থাকেন আর মেইঞ্জ শহরে দুই চাকার সাইকেলে চলাফেরা করেন, তাদের ব্যাবহারের জন্য কোন গাড়ী নেই। এই কথাগুলো মোটেও গল্প নয় সত্যি।।

 

Cycling Is Most Efficient Way To Get Around Says Jab Doctor Worth $4.4  Billions
SHARE THIS ARTICLE