গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেবে নতুন সরকার, প্রত্যাশা স্বজনদের

আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ সরকারি তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র আব্দুল কাদের মাসুম। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার নাখালপাড়ার বাসা থেকে বের হন। উদ্দেশ্য ছিল প্রাইভেট পড়াতে যাওয়া। কিন্তু আর ফেরেননি। পথে বসুন্ধরা এলাকা থেকে তাকে তিন ব্যক্তি র‍্যাব পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে তার খোঁজে বের হন মা আয়েশা আলী। দিনের পর দিন র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন দফতরে ঘুরেছেন। দৌড়েছেন কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ছেলের সন্ধান পাননি মা। আজ ১১ বছর হতে চলেছে। কিন্তু সেই মাসুমের খোঁজ নেই। মাসুম আর ফিরবেন কি না তাও জানা নেই তার মায়ের। তবু একবুক আশা নিয়ে শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজির হয়েছিলেন তিনি।

আয়েশা আলী বলছিলেন, ‘গুমের সরকার পালিয়ে চলে গেছে। গুমের সরকার আমার ছেলেকে গুম করেছে। নানা জায়গায় আমার ছেলেকে খুঁজেছি, কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি। আমার ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবে- এই আশা ছিল। কিন্তু গত ১১ বছর ধরে তার অপেক্ষায়। তার একটি প্যান্ট আমি এখনো আগলে রেখেছি। সে কখন এসে বলবে মা আমার প্যান্টটা দাও।’

তার মতোই স্বামীর খোঁজে এসেছিলেন তেজগাঁও এলাকার মিনু আক্তার। ২০১৩ সালের সেদিন রাজধানীর শাহীনবাগ এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আরও সাতজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সাতজনের একজন ছিলেন মোহাম্মদ কাওসার হোসেন। মিনু আক্তার তার স্বামীকে ১১ বছর ধরে খুঁজছেন, কিন্তু এখনো কোথাও খুঁজে পাননি। যেদিন কাওসারকে তুলে নেওয়া হয় সেদিন তার স্ত্রী মিনু আক্তার বাড়িতে ছিলেন না। পরে বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন স্বামীকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এরপর থানা পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি ও সরকারের বিভিন্ন দফতরে ঘুরেছেন। কিন্তু স্বামীর সন্ধান পাননি।

Gum2

মিনু তার স্বামীর জন্য রাত-দিন এখনো সমান তালে কেঁদে চলেছেন। এমন অবস্থা চোখের অশ্রুও শুকিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু স্বজনের খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি। এরই মধ্যে কয়েকজন আয়না ঘর থেকে ফেরত আসায় তিনিও অন্যদের মতো আশায় বুক বেঁধেছেন। হয়ত ফিরবেন তার স্বামী। এই আশায় দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

মিনুর স্বামী তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা ছিলেন। পাশাপাশি একটি ভাড়া গাড়ি চালাতেন। মিনু বলেন, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে র‌্যাব পরিচয়ে ওই বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় আমার স্বামীকে। সেদিন আমি বাসায় ছিলাম না। আমার স্বামীর সঙ্গে সেই রাতে আরও তিনজন ছিলেন, কিন্তু কাওসারকে নিয়ে গেলেও তার বন্ধুদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

মিনু আরও বলেন, ‘কোথায় আছে সে? আদৌ ফিরবে কি-না আমরা কিছুই জানি না। তবে আমরা বিশ্বাস করি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে সে। নিখোঁজের পর থেকে হন্যে হয়ে তাকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। র‌্যাব, থানা, ডিবি অফিস, সবার দ্বারস্থ হয়েছি, কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি কাওসারের।’

স্বামীর খোঁজ চেয়ে মিনু আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী যখন গুম হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। একটা মানুষ কোথায় হারিয়ে গেল, কেউ জানে না। আমি এই গুমের বিচার চাই। নতুন সরকারের কাছে আমার স্বামীর মতো যারা গুমের শিকার হয়েছে তাদের সন্ধান দাবি করি। তারা যেন সবাইকে খুঁজে বের করে দেন। এই পরিবারগুলোর অনিশ্চয়তা যেন কেটে যায়। আর কোনো লামিয়াকে যেন বাবার অপেক্ষায় থাকতে না হয়।’

শুক্রবার দুপুরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মায়ের ডাক’ নামক একটি সংগঠনের আয়োজনে জড়ো হয়েছিলেন ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে এর আয়োজন করা হয়।

Gum1

মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবেদন থাকবে, দ্রুততম সময়ে স্বজনদের কাছে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দিন। আমাদের সৌভাগ্য যে, আয়নাঘর থেকে মাইকেল চাকমা ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেকেই ফিরে আসেননি। দুঃখ হয়, যখন আমরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে কথা বলে এসেছি…তখন মন্ত্রীরা বলতেন- ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিদেরও নাকি আমরা গুম হিসেবে বিবেচনা করছি।’

বিভিন্ন সংগঠনের তথ্যমতে, গত ১৭ বছরে গুম হয়েছে ৬২৯ জন। এর মধ্যে কয়েকজন ফিরে এলেও বাকিদের এখনো হদিস মেলেনি।

জানা গেছে।

SHARE THIS ARTICLE